হাসপাতালে জাকির হোসেন।—নিজস্ব চিত্র।
বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক যেখানে অস্ত্রোপচারের ‘ঝুঁকি’ নেয়নি, মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সফল হয়েছে সেই অস্ত্রোপচার।
বহরমপুর লাগোয়া হরিহরপাড়া ব্লকের লালনগর গ্রামের ৭৫ বছরের জাকির হোসেন ‘ফ্রন্টাল সাইনাস পায়োসিল’ রোগে ভুগছিলেন। ঠান্ডা লাগার ফলে দীর্ঘ দিন ধরে সর্দি জমে কপালে পুঁজ তৈরি হয়। সেখান থেকে শুরু হয় অসহ্য ব্যথা। ওই ব্যথার উপশমের জন্য গত দেড় বছর ধরে তিনি কলকাতার মেডিক্যাল কলেজ-সহ বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে চক্কর কেটেছেন। কিন্তু হতাশা ছাড়া কিছুই জোটেনি।
শেষ পর্যন্ত মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজে হাসপাতালের ‘ইএনটি অ্যান্ড হেড-নেক’ সার্জারি বিভাগের শিক্ষক-চিকিৎসক গৌতম বিশ্বাস মঙ্গলবার জটিল ওই অস্ত্রোপচার করেন। এখন সুস্থ রয়েছেন ওই রোগী। মঙ্গলবার প্রায় চার ঘণ্টা ধরে ওই অস্ত্রোপচার চলেছে। গৌতমবাবু বলেন, “ফ্রন্টাল সাইনাসের পিছনের দিকে পর্দার মতো একটি হাড় থাকে, যা মস্তিষ্ক থেকে আলাদা করে রাখে। জমে থাকা পুঁজের থলির চাপে ওই হাড় ক্ষয়ে গিয়েছিল। ফলে অস্ত্রোপচার না হলে ওই সংক্রমণ সরাসরি মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়লে রোগী মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হতেন। রোগীর যা বয়স, তাতে মস্তিষ্কের সংক্রমণ হলে অস্ত্রোপচারের কোনও সুযোগ থাকত না।”
গৌতমবাবু জানান, অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রটি ছিল মস্তিষ্কের সঙ্গে যুক্ত। এ ছাড়াও অস্ত্রোপচারের পরে ‘রিকনস্ট্রাকশন’ করার জন্য ওই রোগীর বিভিন্ন শরীরের অংশ নেওয়া হয়। এজন্য ওই রোগীর পেটে ও কানেও অস্ত্রোপচার হয়েছে। সব মিলিয়ে ছ’জন চিকিৎসকের মেলবন্ধনে জটিল ওই অস্ত্রোপচার শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছে। গৌতমবাবুর সঙ্গে অস্ত্রোপচারে সহায়তা করেন চিকিৎসক রুবেল গঙ্গোপাধ্যায় ও অভিজিৎ রায়। অস্ত্রোপচার চলাকালীন অপারেশন থিয়েটারে ছিলেন সার্জারি বিভাগের প্রধান প্রফেসর অনাদি আচার্য। গৌতমবাবুর কথায়, “ওই ধরণের অস্ত্রোপচারে অ্যানাসথেসিস্টের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। চিকিৎসক সোমনাথ ভট্টাচার্য ও সিদ্ধার্থ ভৌমিক সেই ভূমিকা দায়িত্বের সঙ্গে পালন করেছেন। মস্তিষ্ক যুক্ত থাকায় অস্ত্রোপচারে একটু ভুল হয়ে গেলেই রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারত।”
অস্ত্রোপচারের পরে রোগী কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। ছেলে মন্টু শেখ বলেন, “কলকাতার বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক অস্ত্রোপচার করার ঝুঁকি নেয়নি। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে করতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। গত এক বছর ধরে বহরমপুর-কলকাতা যাতায়াত করতে আর্থিক দিক থেকে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি। তেমনি ভোগান্তিও কম পোহাতে হয়নি।”
এই প্রথম নয়, এর আগেও গৌতমবাবু ওই ধরণের জটিল অস্ত্রোপচারে সফল হন। মেডিক্যাল কলেজে হাসপাতালের সুপার তথা সহ-অধ্যক্ষ মণিময় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে গেলেও ওই রোগীকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে শুনেছি। বিভিন্ন পরীক্ষার নামে অস্ত্রোপচার করতে টালবাহানাও হয়েছে। পরিকাঠামোর অভাব থাকলেও চিকিৎসকের সদিচ্ছা থাকলে জটিল অস্ত্রোপচার করাও সম্ভব। শিক্ষক পদে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা এই ধরণের জটিল অস্ত্রোপচার করলে সাধারণ মানুষের বা ছাত্রছাত্রীদের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।”
সেই সঙ্গে অনাবশ্যক রেফার বন্ধ হলে চিকিৎসা পরিষেবার পাশাপাশি হাসপাতালের মান উন্নয়নও সম্ভব হবে।