মানবিক স্পর্শের ‘হাতে’ নতুন জীবন

অনাত্মীয় কিছু মানুষের এগিয়ে দেওয়া হাতই জয়শ্রী চক্রবর্তীর হারানো ডান হাত ফিরিয়ে দিল! প্রায় চার বছরের প্রতিবন্ধকতার যন্ত্রণা জুড়িয়ে গেল নিতান্ত অল্প পরিচিত কয়েক জনের মানবিক চেষ্টার প্রলেপে। বুধবার দুপুরে সদ্য লাগানো নকল ডান হাতে সযত্নে বাঁ হাত বুলোতে-বুলোতে জয়শ্রীদেবী বলছিলেন, পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে ঘেন্না করে বলে জেদ করে বাঁ হাতে লেখা শিখেছিলেন।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৪ ০০:৩৩
Share:

জয়শ্রীদেবীর জন্য জার্মানি থেকে আনা হয়েছে এই নকল হাত। সঙ্গে তাঁর স্বামী বরুণবাবু ও ছেলে শুভদীপ। বুধবার। ছবি: দেবাশিস রায়।

অনাত্মীয় কিছু মানুষের এগিয়ে দেওয়া হাতই জয়শ্রী চক্রবর্তীর হারানো ডান হাত ফিরিয়ে দিল! প্রায় চার বছরের প্রতিবন্ধকতার যন্ত্রণা জুড়িয়ে গেল নিতান্ত অল্প পরিচিত কয়েক জনের মানবিক চেষ্টার প্রলেপে।

Advertisement

বুধবার দুপুরে সদ্য লাগানো নকল ডান হাতে সযত্নে বাঁ হাত বুলোতে-বুলোতে জয়শ্রীদেবী বলছিলেন, পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে ঘেন্না করে বলে জেদ করে বাঁ হাতে লেখা শিখেছিলেন। ওই হাতেই সব্জি কাটা, ঘরের কাজ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাতেন। তবু সব কিছু সম্ভব হত না।

দক্ষিণ কলকাতার বাড়িটায় এ দিন অনেক মানুষের আনন্দ-হইচইয়ের মধ্যে একটি সোফায় পাশাপাশি বসে ছিলেন তিন জন। বছর পঁয়তাল্লিশের জয়শ্রীদেবী, তাঁর স্বামী বরুণ চক্রবর্তী আর তাঁদের একমাত্র সন্তান চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র শুভদীপ। স্মৃতিচারণে তাঁরা বারবার ফিরে যাচ্ছিলেন ২০০৯ সালের ২৫ অগস্টের সেই ভয়াবহ দিনে। সে দিনও বেহালার বাড়ি থেকে তিন জনে সকাল-সকাল বেরিয়েছিলেন হাওড়ায় ডাক্তার দেখাতে যাবেন বলে। বসেছিলেন মিনিবাসের ডান দিকে আগুপিছু সিটে, জানলার ধারে। অন্য একটি বেসরকারি বাসের সঙ্গে মিনিবাসের রেষারেষিতে সেই বাসের গায়ের লোহার পাত খুলে এসে কেটে দেয় বরুণবাবু আর জয়শ্রীদেবীর ডান হাত। কোনওমতে বেঁচে যায় পাঁচ বছরের শুভদীপ।

Advertisement

প্রায় চার মাস এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন দু’জনে। জয়শ্রীদেবীর আঘাতের তীব্রতা ছিল মারাত্মক। তাঁর ডান কাঁধের মাংস এতটাই কাটতে হয়েছিল যে, কোনও নকল হাতই বসানো যাচ্ছিল না। অত্যাধুনিক হাল্কা হাতের জন্য প্রায় লাখ দেড়েক টাকা জোগাড় করতেও পারেননি মধ্যবিত্ত ওই দম্পতি। তার পরেই আচমকা ম্যাজিকের মতো মোড় নেয় জীবন। যাদবপুরের বল পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় বরুণ-জয়শ্রীর। তাঁদের জীবন কিছুটা মসৃণ করে তোলার পণ করে বসে বল পরিবার। শুরু হয় দুই অপরিচিত পরিবারের ‘আশ্চযর্’ আত্মীয়তা।

২০১১ সালে বরুণবাবুর জন্য একটি নকল হাতের ব্যবস্থা করেছিল রাজ্য পুলিশ। সাহায্য করেছিল কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সেই হাতটি অত্যাধুনিক হলেও ওজন ছিল প্রায় ১ কেজি ৬০০ গ্রাম। ফলে সব সময়ে সেটি লাগিয়ে কাজ করতে সমস্যা হচ্ছিল বরুণবাবুর। সেই সূত্রে প্রায়ই তৎকালীন ডিজি (আর্মড পুলিশ) গৌতমমোহন চক্রবর্তীর দফতরে যাতায়াত করতেন বরুণ-জয়শ্রী। গৌতমবাবুরও মনে আছে সে কথা। বললেন, “যে সংস্থা বরুণবাবুর হাত বানিয়েছিল, তারা জানিয়ে দিয়েছিল ওজন কমানো যাবে না। কারণ, তার মধ্যে অনেক রকম যন্ত্রপাতি রয়েছে। আমি তখন ওঁকে হাতটা পরে অভ্যাস করতে বলেছিলাম।”

সেই সময়ে গৌতমমোহনবাবুর ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন সুশান্ত বল (এখন অবসর নিয়েছেন)। চক্রবর্তী দম্পতির অসহায় অবস্থা প্রথম নাড়া দিয়েছিল তাঁকে। তাঁদের পরিবার সূত্রের খবর, এক দিন বাড়িতে পরিবারের ছোট-বড় সকলকে নিয়ে আলোচনায় বসেন সুশান্ত। বলেন বরুণ আর জয়শ্রীর কথা। তাঁর নিজের কথায়, “সরকারি জায়গা থেকে ওঁরা কবে আবার হাত পেতেন, কে জানে। তাই বলে ওঁরা এত অসহায় হয়ে দিন কাটাবেন, মানতে পারিনি। আমার ইচ্ছায় সায় দিয়েছিলেন স্ত্রী শুক্লা, দাদা অজয় এবং বৌদি রীণা।”

নিজেরা টাকা দেওয়ার পাশাপাশি, চার বছর ধরে নিজেদের আত্মীয়-পরিজন-বন্ধু-পরিচিতদের থেকে এই কাজের জন্য অর্থ সংগ্রহ করে বল পরিবার। জমানো হয় দেড় লক্ষ টাকা। তা দিয়েই জয়শ্রীদেবীর জন্য কেনা হয় জার্মানির একটি সংস্থার তৈরি ডান হাত। এর ওজন অনেক কম এবং কনুই থেকে ভাঁজও করা যায়। হাত বসানোর পরে বুধবার প্রথমেই সপরিবারে বল পরিবারের বাড়ি গিয়েছিলেন জয়শ্রীদেবী। বল পরিবারের অন্যতম সদস্য বর্ষীয়ান অজয় বলের কথায়, “রাস্তাঘাটে কত অল্পবয়সী গরিব প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়ে দেখি যারা টাকা অভাবে নকল হাত বা পা লাগাতে পারে না। অথচ সকলে একটু একটু করে টাকা দিলে তারা আর প্রতিবন্ধী থাকে না।”

সব শুনে উচ্ছ্বসিত গৌতমমোহনও। বললেন, “প্রতিষ্ঠানের মুখাপেক্ষী না হয়ে মানুষ যে বিবেকের তাড়নায় অনেক বড় কিছু করে ফেলতে পারে, সুশান্তরা সেটা দেখিয়ে দিল।” আর কান্না-হাসিতে ভেসে জয়শ্রী-বরুণ বলেছেন, সমস্যার সময়ে এমন আত্মীয়তা পেয়ে নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে করছে তাঁদের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন