রক্তের উপাদান অমিল, সঙ্কটে হিমোফিলিয়া রোগীরা

দরিদ্র হিমোফিলিয়া রোগীদের কথা ভেবেই কলকাতার দুই মেডিক্যাল কলেজে তাঁদের চিকিৎসার জন্য অতি প্রয়োজনীয় এবং দামি রক্তের উপাদান ‘ফ্যাক্টর-৮’ নিখরচায় দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল রাজ্য সরকার। উদ্দেশ্য মহৎ হলেও সরকার কথা রাখতে পারেনি বলে অভিযোগ উঠেছে। কারণ, গত প্রায় দেড় মাস কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ এবং নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে ফ্যাক্টর-৮ মিলছে না।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৪ ০২:৩৮
Share:

দরিদ্র হিমোফিলিয়া রোগীদের কথা ভেবেই কলকাতার দুই মেডিক্যাল কলেজে তাঁদের চিকিৎসার জন্য অতি প্রয়োজনীয় এবং দামি রক্তের উপাদান ‘ফ্যাক্টর-৮’ নিখরচায় দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল রাজ্য সরকার। উদ্দেশ্য মহৎ হলেও সরকার কথা রাখতে পারেনি বলে অভিযোগ উঠেছে। কারণ, গত প্রায় দেড় মাস কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ এবং নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে ফ্যাক্টর-৮ মিলছে না। দিশাহারা অবস্থা রোগী ও তাঁদের বাড়ির লোকজনের।

Advertisement

যেমন আঠেরো বছরের সৌরভ দত্ত। তাঁর দুই হাঁটুর ভিতরে ক্রমাগত রক্তক্ষরণ হচ্ছে। হাঁটু ফুলে ঢোল, অসম্ভব যন্ত্রণা। গত পনেরো দিন ধরে হাঁটাচলা বন্ধ। শুধু কাতরাচ্ছেন। চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিয়েছেন, আর কিছু দিন এই ভাবে চললে চিরকালের মতো হাঁটার ক্ষমতাই হারাবেন সোদপুর পানশিলার বাসিন্দা হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত সৌরভ।

হিমোফিলিয়া-আক্রান্ত রোগীর রক্ত সহজে জমাট বাঁধে না। ফলে যখন-তখন যে কোনও অঙ্গ থেকে রক্তপাত শুরু হতে পারে। সহজে থামে না। তখন চিকিৎসার জন্য ফ্যাক্টর-৮ দিতে হয়। সৌরভেরও তা অবিলম্বে দরকার। কিন্তু পাচ্ছে না। কেনারও ক্ষমতা নেই। ফলে ধুঁকছেন। বিছানা থেকে উঠতে পারছেন না।

Advertisement

কসবার বাসিন্দা প্রশান অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। বয়স তেরো। হিমোফিলিয়ার রোগী। সপ্তাহে অন্তত দু’বার কম করে হাজার ইউনিট ফ্যাক্টর-৮ লাগে। প্রশানের মা টুকটুকিদেবীর অভিযোগ, গত এক মাস অন্তত ছ’বার মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে শুনেছেন, ফ্যাক্টর-৮ আসেনি। খালি হাতে ফিরেছেন। এ দিকে প্রশানের খেলাধুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নেতিয়ে পড়েছে। প্রশানের বাবা গাড়িচালক। বাজার থেকে ফ্যাক্টর-৮ কেনার মতো আর্থিক ক্ষমতা তাঁর নেই।

খিদিরপুর ফ্যান্সি মার্কেটে এক দোকানের কর্মচারী ২০ বছরের মহম্মদ ফয়জলও সরকারি হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে গত এক মাস ফ্যাক্টর-৮ পাননি। বললেন, “হাত-পায়ের সন্ধিস্থলের যন্ত্রণায় ঘুমোতে পারছি না। সামান্য আড়াই হাজার টাকা মাইনের চাকরি করি। ফ্যাক্টর-৮ কেনার সামর্থ্য আমার নেই। বলেন, “আমাদের মতো গরিব হিমোফিলিয়া রোগীদের এ বার বোধহয় বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে হবে।”

স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, রাজ্যে হিমোফিলিয়া রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। শুধু পুরুষেরাই এই রোগে আক্রান্ত হন। রোগের বাহক হন মেয়েরা। হিমোফিলিয়া সোসাইটির কলকাতা শাখায় ৯২৩ জন রোগীর নাম নথিভুক্ত রয়েছে। এঁদের ৮০ শতাংশেরই ফ্যাক্টর-৮ প্রয়োজন হয়। কিন্তু সরকারি দুই হাসপাতালে এর সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এঁদের মধ্যে ৪-৫ জন ছাড়া আর কেউই নগদ টাকা দিয়ে তা কিনতে পারেননি।

সংস্থার সচিব রবি ওঝা জানিয়েছেন, বাজারে এক ইউনিট ফ্যাক্টর-৮-এর দাম ১২-১৫ হাজার টাকা। এক জন প্রাপ্তবয়স্ক হিমোফিলিয়া রোগীর এক সপ্তাহ পর-পরই দিনে অন্তত এক থেকে দেড় হাজার ইউনিট ফ্যাক্টর-৮ লাগতে পারে। দু’-তিন বছরের শিশুরও টানা কয়েক দিন ধরে দিনে ২৫০-৩০০ ইউনিট ফ্যাক্টর-৮ প্রয়োজন হতে পারে। রবিবাবুর কথায়, “আমাদের সংস্থায় প্রতি ইউনিট ফ্যাক্টর-৮ সাড়ে ন’টাকা নেওয়া হয়। কম দাম হলেও সেই টাকাও গরিব রোগী দিতে পারেন না।”

হাসপাতালে সরবরাহ বন্ধ হওয়ার কারণ সম্পর্কে স্বাস্থ্য দফতরের মুখপাত্র সুমন বিশ্বাসের বক্তব্য, “ফ্যাক্টর-৮ স্বাস্থ্য দফতরের ক্যাটালগ-ভুক্ত। একটি নামী সংস্থার থেকে এটি কেনা হত। সম্প্রতি ওই সংস্থার সঙ্গে অন্য একটি সংস্থা যুক্ত হচ্ছে, ফলে ওদের অন্তর্বর্তী কিছু পরিবর্তন হচ্ছে। তাতে ওরা এত ব্যস্ত যে, আমরা তিন-তিন বার ফ্যাক্টর-৮ চেয়ে পাঠালেও ওরা পাঠায়নি। জানিয়েছে, এই মাসের শেষের দিকে পাঠাবে। আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু করার নেই।”

চিকিৎসকেরা জানান, ফ্যাক্টর-৮-এর অভাবে রোগীকে প্লাজমা বা রক্তরস দেওয়া যায়, কিন্তু বেশির ভাগ হিমোফিলিয়া রোগী সেটা সহ্য করতে পারেন না। রক্ত-বিশেষজ্ঞ প্রসূন ভট্টাচার্যের কথায়, “রক্তরস থেকে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে, তা ছাড়া রক্তরস নিলে অনেক হিমোফিলিয়া রোগীর শরীরে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। ফলে হাসপাতালে রক্তরস পাওয়া গেলেও অনেককে দেওয়া যাচ্ছে না।”

মেডিক্যাল কলেজে হেমাটোলজি বিভাগের দায়িত্বে থাকা প্রান্তর চক্রবর্তী জানিয়েছেন, তাঁদের কাছে ৫৫০ জন হিমোফিলিয়া রোগী নথিভুক্ত রয়েছেন। এ ছাড়াও প্রতিদিন ৫-৭ জন করে আসেন, যাঁদের তৎক্ষণাৎ ফ্যাক্টর-৮ দরকার। কাউকেই গত এক মাস ধরে তা দেওয়া যাচ্ছে না। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে হেমাটোলজির প্রধান চিকিৎসক মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, যাঁরাই ফ্যাক্টর-৮ নিতে আসছেন, তাঁদের এ মাসের শেষে খোঁজ নিতে বলা হচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন