মেডিক্যালে জিতেন্দ্রপ্রসাদ। নিজস্ব চিত্র।
কলকাতার বাসিন্দা এক যুবকের রক্তে জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের জীবাণু মিলেছে। জ্বর ও খিঁচুনি নিয়ে তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের ১১৮ নম্বর শয্যায় ভর্তি। ঘটনাটি তিন দিন আগের হলেও ১৪ অগস্ট রাতের আগে তা প্রকাশ্যে আসেনি। এনসেফ্যালাইটিস সংক্রান্ত তথ্য চেপে যেতে স্বাস্থ্যভবন চাপ তৈরি করছে বলে সরকারি চিকিৎসকদের একাংশ বুধবার যে অভিযোগ করেছিল, এই ঘটনায় কি তারই সমর্থন মিলল?
যেখানে এই রক্ত পরীক্ষা হয়েছে সেই স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান নিমাই ভট্টাচার্যের দাবি, ৮ অগস্ট ওই রক্তের নমুনা পান। বিভিন্ন কারণে পরীক্ষায় দেরি হয়েছে। ১১ অগস্ট সেই রক্ত পরীক্ষা করে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস পাওয়া যায়। ১৩ অগস্ট সেই রিপোর্ট সই করে স্বাস্থ্যভবনে পাঠান। কিন্তু স্বাস্থ্যভবনের কর্তারা ১৪ অগস্ট রাত পর্যন্ত কিছুই জানতেন বলে দাবি করেছেন। পরে খোঁজখবর নিয়ে স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “কলকাতার ওই যুবকের রক্তে জেই -র ভাইরাস পাওয়ার খবর সত্যি।”
তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, কলকাতার এক যুবক ‘অ্যাকিউট এনসেফ্যালাইটিক সিনড্রোম’ (এইএস) নিয়ে ২৯ জুলাই মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হলেন, ৮ অগস্ট রক্ত পরীক্ষার জন্য ট্রপিক্যালে গেল, অথচ ২৯ জুলাই থেকে ১৪ অগস্ট, ১৬ দিনের মধ্যে স্বাস্থ্য দফতর থেকে প্রকাশিত দৈনিক রিপোর্টে যুবকের উল্লেখ হল না কেন? ৮ থেকে ১১ অগস্ট পর্যন্ত ওই রক্তের নমুনা পরীক্ষা না-হয়ে পড়ে রইল কেন? ১১ অগস্ট জেই পাওয়ার পর কেন তখনই জরুরি ভিত্তিতে ট্রপিক্যাল সেই তথ্য জানায়নি স্বাস্থ্যভবনকে? কেন ১৩ অগস্ট রিপোর্ট স্বাস্থ্যভবনে যাওয়ার পরেও স্বাস্থ্যঅধিকর্তা সেই রিপোর্ট সম্পর্কে অবগত নন? এতে কি তথ্যগোপনের প্রয়াসই প্রকট হচ্ছে না?
বিশ্বরঞ্জনবাবু বলেন, “ওই যুবক ২৯ জুলাই মেডিক্যালে অ্যাকিউট এনসেফ্যালাইটিক সিনড্রোম নিয়ে ভর্তি হলেও সেই তথ্য মেডিক্যাল জানায়নি। ৮ অগস্ট তাঁর রক্ত পরীক্ষার জন্য ট্রপিক্যালে পাঠানো হলেও মেডিক্যাল আমাদের কিচ্ছু বলেনি। মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষের কাছে এর কারণ জানতে চেয়েছি।” তাঁর বক্তব্য, “১৩ অগস্ট স্বাস্থ্য ভবনে রক্তপরীক্ষার রিপোর্ট এসেছিল। ব্যস্ত থাকায় তা খোলা হয়নি। এর বেশি ব্যাখ্যা দেব না।” মেডিক্যালের অধ্যক্ষ তপনকুমার লাহিড়ী বলেন, “সব জানানো হয় স্বাস্থ্যদফতরকে। সেখানকার কর্তাদের জিজ্ঞাসা করুন।”
ট্রপিক্যালের যিনি ওই রিপোর্ট দিয়েছেন সেই নিমাই ভট্টাচার্যের যুক্তি, ৮ অগস্ট ওই যুবকের রক্তের নমুনা পাওয়ার পর ৯ ও ১০ তারিখ যথাক্রমে শনি ও রবিবার থাকায় নমুনা পরীক্ষা করা হয়নি। ১১ তারিখ রক্ত পরীক্ষায় জাপানি এনসেফ্যালাইটিস মিললেও সে দিন রিপোর্ট খুব একটা যথার্থ মনে হয়নি তাঁদের। ফলে ১২ অগস্ট আবার রক্ত পরীক্ষা হয়। তাতেও জেই পাওয়া যায়। ১৩ তারিখ তিনি রিপোর্ট সই করে স্বাস্থ্যভবনে পাঠান।
৮ তারিখই কেন স্বাস্থ্যভবনকে রক্ত পরীক্ষার কথা জানানো হয়নি? নিমাইবাবু বলেন, “মেডিক্যালের জানানোর কথা।” ১২ তারিখ জেই পাওয়ার পরেই কেন টেলিফোনে স্বাস্থ্যভবনকে হুঁশিয়ার করলেন না? জবাব দিতে পারেননি নিমাইবাবু।
ট্রপিক্যাল জানায়, রক্তে মিললেও যুবকটির সেরিব্রোস্পাইন্যাল ফ্লুইড (সিএসএফ)-এ জেই মেলেনি। বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দীর মতে, “রক্তে জেই ভাইরাস খুব বাড়লে রোগ নিয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে।” বিশ্বরঞ্জনবাবুর কথায়, “সাত দিন পরে ওই যুবকের রক্ত আবার পরীক্ষা হবে। জাপানি এনসেফ্যাাইটিসের জীবাণু আগের থেকে চার গুণ বাড়লে রোগ নিয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে।”
বৃহস্পতিবার মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, পুরুষ ওয়ার্ডের ১১৮ নম্বর শয্যায় জিতেন্দ্রপ্রসাদ নামে বছর ছাব্বিশের ওই যুবক শুয়ে। খিঁচুনি হচ্ছে। জ্বর রয়েছে। তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন। মা তেতরি দেবীর সঙ্গে থাকেন ইডেন হসপিটাল রোডে মেডিক্যাল কলেজের চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের কোয়ার্টারে। তেতরি দেবী মেডিক্যালের সাফাইকর্মী। ২৯ জুলাই খিঁচুনি আর জ্বর নিয়ে তাঁর ছেলেকে মেডিক্যালে ভর্তি করা হয়। রোগাক্রান্ত হওয়ার আগে অসম বা বিহারের মতো এনসেফ্যালাইটিস-প্রবণ এলাকায় গিয়েছিলেন জিতেন্দ্র? তেতরিদেবী বলেন, “জুন-এর প্রথমে ছেলে দিন কুড়ির জন্য বিহারের আরা জেলায় দেশের বাড়ি গিয়েছিল। ওর জ্বর, খিঁচুনি শুরু হয় ২৬ জুলাই থেকে।”
ভাইরোলজিস্ট, পতঙ্গ বিশেষজ্ঞদের মতে কারও দেহে মশা মারফত জেই ভাইরাস প্রবেশের ২-১০ দিন বা খুব বেশি হলে ১৫ দিনের মধ্যে রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। কিন্তু জিতেন্দ্রপ্রসাদের ক্ষেত্রে জুন মাসের মাঝামাঝি বিহার থেকে ভাইরাস প্রবেশ করলে রোগের লক্ষণ দেখা দিতে এক মাসের বেশি লাগবে কেন সেই প্রশ্ন উঠছে। তা হলে কি কলকাতা থেকেই ভাইরাস ঢুকেছে? শতপথীর জবাব, “ওই যুবকের বিহারের মতো এনসেফ্যালাইটিস-প্রবণ এলাকায় বার বার যাওয়ার ইতিহাস রয়েছে। রোগের লক্ষণ ধরা পড়ার ঠিক কত দিন আগে উনি বিহার যান, জানতে হবে।”
মুর্শিদাবাদের দু’টি শিশু এসএসকেএমের পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ভর্তি হয়েছে। সন্দেহ, দু’জনেই জাপানি এনসেফ্যালাইটিসে আক্রান্ত।