এত দিন কানাঘুষো শোনা যেত। এ বার রোগীকল্যাণ সমিতির বৈঠকে প্রকাশ্যে এসএসকেএম কর্তৃপক্ষ স্বীকার করলেন, তাঁদের হাসপাতালে সাধারণ রোগীদের বঞ্চিত করে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সুপারিশ করা রোগীর জন্য আগাম শয্যা, বিশেষ করে আইসিসিইউয়ের শয্যা সংরক্ষণ করা হয়। এবং ওই বৈঠকেই রাজ্যের দুই প্রথম সারির মন্ত্রীর উপস্থিতিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, এ বার থেকে তাঁরা আর আগাম এ ভাবে শয্যা বুকিং করবেন না।
গত ২৬ জুনের এই বৈঠকে রাজ্যের দুই মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এবং মদন মিত্র উপস্থিত ছিলেন। ফিরহাদ এসএসকেএমের রোগীকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান এবং মদনবাবু কো-চেয়ারম্যান। যেহেতু রোগীভর্তির সুপারিশ সবচেয়ে বেশি আসে বিভিন্ন নেতা-মন্ত্রীর কাছ থেকেই, তাই শাসকদলের দুই মন্ত্রীর উপস্থিতিতে সর্বসম্মত ভাবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়াকে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এসএসকেএমের অধ্যক্ষ প্রদীপ মিত্রের কথায়, “যেহেতু এটা রাজ্যের একমাত্র সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল, তাই সুপারিশের চাপে আমরা ধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সকলেই নিজেদের পরিচিত রোগীকে এখানকার আইসিসিইউ-য়ে ভর্তি করাতে চান। হাসপাতাল চালানো অসম্ভব হয়ে উঠেছিল।”
এসএসকেএমে শুধু গত জুন মাসেই একাধিক নেতা-মন্ত্রী থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পাঠানো ‘ক্যাচ কেস’-এসেছে ৩১টি। হাসপাতালে গড়ে ৩০% শয্যা এই কেসগুলির জন্য ধরে রাখতে বাধ্য হতেন কর্তৃপক্ষ। অর্থাৎ এই আসনগুলি খালি হলেও তাতে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে আসা রোগী বা আউটডোরে আসা রোগী ভর্তি হতে পারেন না। আবার এসএসকেএমেরই ভিতরে সাধারণ শয্যায় ভর্তি কোনও রোগীকে যদি আইসিসিইউ-য়ে স্থানান্তরিত করার প্রয়োজন হয়, তা-ও করা যায় না। তার বদলে আইসিসিইউ-তে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পাঠানো কেস ভর্তি করতে হয়।
কোনও-কোনও সময়ে সেই ‘বিশেষ’ রোগীদের জন্য টানা এক দিন বা দু’দিন শয্যা আটকে রেখে দেওয়ার নজিরও রয়েছে। ফলে বারবার অসুস্থ রোগীর বাড়ির লোকের বিক্ষোভের মুখে পড়তে হচ্ছিল হাসপাতালকে। প্রদীপবাবু বলেন, “আমরা তাই মন্ত্রীদের উপস্থিতিতেই শয্যা আটকে রাখার এই অভ্যাস বদলের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। উপরের মহল থেকে ভর্তির শত চাপ এলেও তা এ বার মানা হবে না।”
কিন্তু রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক মহল থেকে চাপ এলে এই সিদ্ধান্তে কি সত্যি অটল থাকতে পারবেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বা স্বাস্থ্য দফতর?
স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় এর উত্তরে বলেন, “একটা চেষ্টা শুরু করা হল। এটা সফল করার দায়িত্ব যেমন ডাক্তারদের, তেমন মন্ত্রীদেরও।” আর মন্ত্রীরা কী বলছেন?
মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, “নিশ্চয়ই পারবে। এতদিন যা হয়েছে তা হয়েছে, এ ভাবে আর চলবে না। আমি, মদন বা অন্য কোনও মন্ত্রী বা যত বড় কেউ হোন না কেন, তাঁদের সুপারিশ করা রোগীর জন্য আগে থেকে কোনও শয্যা আটকে রাখা যাবে না। শয্যা খালি হলে ওই হাসপাতালে আসা রোগীরা তাতে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবেন।”
ফিরহাদ আরও জানান, এ বার থেকে সুপারিশ করা রোগীদের নামের একটা আলাদা তালিকা করা থাকবে। কোনও শয্যা খালি হলে তাতে ভর্তির জন্য হাসপাতালের কোনও রোগী যদি লাইনে না থাকেন, একমাত্র তখনই তালিকায় থাকা রোগীরা নম্বর অনুযায়ী ভর্তির সুযোগ পাবেন। আর মন্ত্রী মদন মিত্রের কথায়, “এসএসকেএমে ক্যাচ কেস আগে ভর্তির ব্যবস্থা এ বার থেকে বন্ধ। হাসপাতালের অনেক চিকিৎসক এবং দালালেরা এতে যুক্ত ছিলেন। তাঁরা যেমন এ ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন, তেমনই আমাদের মতো রাজনীতিকদেরও সতর্ক থাকতে হবে।” তবে স্বাস্থ্য দফতরের একটা বড় অংশ মনে করছেন, যতই মন্ত্রীরা সমর্থন করুন, বিভিন্ন মহলের চাপে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আদৌ খুব বেশি দিন নিজেদের সিদ্ধান্তে টিকে থাকতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।