ওজন কমাতে বেরিয়াট্রিক সার্জারি করিয়েছিলেন এক মহিলা। কিন্তু অস্ত্রোপচারের জন্য তাঁকে মেডিক্লেমের টাকা দিতে অস্বীকার করেছিল এক সরকারি বিমা সংস্থা। দু’বছর ধরে মামলা চলার পরে ওই বিমা সংস্থার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে কলকাতার ক্রেতা-সুরক্ষা আদালতের ইউনিট-১ শাখা।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি দেওয়া রায়ে নিউ আলিপুরের বাসিন্দা মীনাক্ষি লাহাকে মেডিক্লেমের ১ লক্ষ ৩৫ হাজার টাকা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় ওই বিমা সংস্থাকে। কোর্ট তার রায়ে বলে, বিমা সংস্থা এ ক্ষেত্রে আইন মেনে কাজ করেনি। মেডিক্লেমের টাকা ছাড়াও আদালত মামলা চালানোর খরচ বাবদ গ্রাহককে ৫ হাজার টাকা এবং গ্রাহকের যে হেনস্থা হয়েছে, তার জন্য আরও ২০ হাজার টাকা ওই সংস্থাকে তিরিশ দিনের মধ্যে দিতে বলেছে।
মীনাক্ষিদেবীর অস্ত্রোপচার হয়েছিল মিন্টো পার্কের এক নার্সিংহোমে। তাঁর চিকিৎসক তাপস চক্রবর্তীর কথায়, “অস্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধির সঙ্গে সুগার, প্রেসার, কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইড মারাত্মক বেড়ে গিয়েছিল মীনাক্ষিদেবীর। হাঁটাচলা করতে পারতেন না। ঘুমের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে যেত। এই ধরনের রোগীর প্রাণসংশয় হতে পারে। তখন অস্ত্রোপচার করে তাঁর পাকস্থলীর একটা অংশ বাদ দেওয়া হয়, যাতে খিদে উদ্রেককারী হরমোন ক্ষরণ কমে।” কিন্তু বিমা সংস্থা দাবি করে, এটি ‘কসমেটিক সার্জারি।’ না-করলেও রোগীর ক্ষতি হবে না। তাই টাকা দেওয়া হবে না। তাদের দাবি ভুল প্রমাণিত হল ক্রেতা-সুরক্ষা আদালতের রায়ে।”
মীনাক্ষিদেবীর অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বিমা সংস্থার কাজকর্মের উপরে নজরদারির জন্য গঠিত ‘ইনসিওরেন্স রেগুলেটরি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অথরিটি অব ইন্ডিয়া’র (আইআরডিএ) কর্তারাই জানিয়েছেন, অনেক গ্রাহক মেডিক্লেমের পাওনা টাকার জন্য নাস্তানাবুদ হচ্ছেন। এই রকম অজস্র অভিযোগ তাদের কাছে জমা পড়ছে।
যেমন, বুকে সর্দি বসে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছিল দুর্গানগরের বাসিন্দা দু’বছরের অনুভার। অক্টোবরের শেষে তাকে বেলেঘাটা মোড়ের এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অনুভার বাবা রঞ্জন বিশ্বাসের অভিযোগ, হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার দিন বিমা সংস্থার নিযুক্ত ‘থার্ড পার্টি অ্যাডমিনিস্ট্রেটর’ (টিপিএ) জানান, অনুভার ‘রেসপিরেটরি ট্র্যাক ইনফেকশন’ ক্রনিক সমস্যা। তাই এর চিকিৎসার টাকা মেটানো হবে না।
আইআরডিএ-র কর্তারা জানান, অনেক সময়ে কেমোথেরাপি-র মতো গুরুত্বপূর্ণ ও খরচসাপেক্ষ চিকিৎসাকে ‘ডে কেয়ার ট্রিটমেন্ট’ দেখিয়ে মেডিক্লেমের টাকা আটকে দেওয়া হয়। আবার রোগী যে রোগের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, চিকিৎসা চলাকালীন তাঁর অন্য কোনও শারীরিক সমস্যা দেখা দিলেই তার খরচ দিতে বিমা সংস্থা বেঁকে বসে। তখন সেই চিকিৎসার খরচ গ্রাহককে পকেট থেকে মেটাতে হয়। অনেক সময়ে আবার ‘রুম রেন্ট ক্যাপিং’ এবং ‘প্রোপোরশনেট ডিডাকশন’ নামে কিছু নিয়মের মাধ্যমে গ্রাহকদের সমস্যায় ফেলা হচ্ছে।
আইআরডিএ-র এক কর্তা জানান, পলিসির টাকার অঙ্ক অনুসারে কোন গ্রাহক হাসপাতালের কত টাকার ঘরে থাকতে পারেন, তা ঠিক করা থাকে। কিন্তু অভিযোগ, হাসপাতালে ভর্তির সময় এ ব্যাপারে গ্রাহককে ভাল ভাবে বোঝায় না বিমা সংস্থার প্রতিনিধিরা। ফলে অনেক রোগী প্রাপ্য ঘরের থেকে বেশি দামের ঘরে ভর্তি হয়ে যান। ছাড়া পাওয়ার সময়ে সেই ঘরভাড়া বাবদ মোট বিলের উপর ৬৭ শতাংশ টাকা কেটে নেয় বিমা সংস্থাগুলি। ফলে বাকি বিপুল টাকা রোগীকে মেটাতে হয়।
সরকারি বিমা সংস্থাগুলির অবশ্য দাবি, এগুলি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। ন্যাশনাল ইনসিওরেন্স কোম্পানির এক মুখপাত্রের কথায়, “সেই ক্লেমই বাতিল হয় যার মধ্যে প্রকৃত গোলমাল থাকে। এখন তথ্যপ্রযুক্তির যুগে কম্পিউটরে সব রেকর্ড থাকে। গ্রাহককে ফাঁকি দেওয়া অত সহজ নয়। ১০০টা ক্লেম-এর মধ্যে ৯৫টিরই টাকা দেওয়া হয়। এক-দু’টি ক্ষেত্রে টিপিএ-দের গাফিলতিতে ন্যায্য প্রাপ্য আটকে যায়।” ইউনাইটেড ইনসিওরেন্সের এক কর্তার দাবি, “অনেক এজেন্ট মেডিক্লেম করার সব শর্তাবলী গ্রাহককে স্পষ্ট করে বলেন না। পরে টাকা বাতিল হলে তাঁরা বিমা সংস্থার উপরে দোষ চাপান।” ইউনাউটেড ইন্ডিয়া ইনসিওরেন্সের এক কর্তার দাবি, “কিছু গ্রাহক অন্যায্য দাবি করেন। যে ধরনের অসুস্থতায় বিমার টাকা মিলবে না বলে ঘোষণা করা থাকে, সেগুলির জন্যই টাকা দাবি করেন। তা না-পেলে বিমা সংস্থাকে দুর্নীতিবাজ বলে গালিগালাজ করেন।”
আইআরডিএ-র অন্যতম সদস্য আর কে নায়ারের কথায়, “আমরা বারংবার প্রচার করছি, মেডিক্লেম করানোর সময় গ্রাহকেরা যেন পুঙ্খানুপুঙ্খ নিয়মকানুন জেনে তবে করেন। তার পরেও সমস্যা হলে আইআরডিএ-র কাছে অভিযোগ জানানো যেতে পারে।”