পাভলভ

স্বনির্ভরতার দিশা, লন্ড্রি চালাবেন সুস্থ হয়ে যাওয়া মনোরোগীরা

সরকারি সাহায্যে এই প্রথম সরাসরি জীবিকা অর্জনের সুযোগ পাচ্ছেন সরকারি মানসিক হাসপাতালে চিকিত্‌সার পরে সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীরা। পাচ্ছেন আত্মবিশ্বাস নিয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার দিশা। এত দিন হাসপাতালের বিছানা-চাদর-বালিশের ওয়াড়, রোগীদের জামাকাপড়, চিকিত্‌সকদের অ্যাপ্রন কাচার কাজ করত বেসরকারি সংস্থা। এ বার সেই কাজেরই দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে সেরে ওঠা এই মানুষদের।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০১৫ ০৩:১৫
Share:

সরকারি সাহায্যে এই প্রথম সরাসরি জীবিকা অর্জনের সুযোগ পাচ্ছেন সরকারি মানসিক হাসপাতালে চিকিত্‌সার পরে সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীরা। পাচ্ছেন আত্মবিশ্বাস নিয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার দিশা।

Advertisement

এত দিন হাসপাতালের বিছানা-চাদর-বালিশের ওয়াড়, রোগীদের জামাকাপড়, চিকিত্‌সকদের অ্যাপ্রন কাচার কাজ করত বেসরকারি সংস্থা। এ বার সেই কাজেরই দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে সেরে ওঠা এই মানুষদের। সরকারি হাসপাতালের মধ্যেই প্রায় এক হাজার বর্গফুটের লন্ড্রি চালাবেন তাঁরা। পার্ক সার্কাসের পাভলভ মানসিক হাসপাতালে এই ‘ধোবি ঘর’ প্রকল্পের জন্য জায়গা, বিশেষ ধরনের পরিশুদ্ধ জল, বিদ্যুত্‌ সব কিছুই দিচ্ছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। বিদ্যুত্‌ ও জলের বিশেষ লাইনের জন্য ইতিমধ্যে সরকার ৬৫ লক্ষ টাকা খরচ করেছে। যন্ত্রপাতি এবং কর্মীদের দৈনিক ভাতার ব্যবস্থা করছে সরকারি হাসপাতালে মানসিক রোগীদের নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠন। ন্যূনতম মজুরি আইন মেনে কর্মীরা এই লন্ড্রিতে দৈনিক ২৩২ টাকা পাবেন। এই টাকা সঞ্চয়ের জন্য নিকটবর্তী ব্যাঙ্কে প্রত্যেককে জিরো ব্যালান্স অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া হচ্ছে। ২ মার্চ এ নিয়ে ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে মউ সই হয়েছে স্বাস্থ্য দফতরের।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে বলেন, “একে আমরা এক্সপেরিমেন্ট হিসেবে দেখছি। এঁরা দীর্ঘদিন পাভলভে রয়েছেন। সুস্থ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও বাড়ির লোক তাঁদের ফিরিয়ে নিতে চান না। অদ্ভুত সামাজিক সমস্যা এটা। যা থেকে বেরোনোর একমাত্র পথ মানুষগুলিকে স্বনির্ভর করা।” তাঁর কথায়, “প্রথমে শুধু পাভলভের চাদর-জামাকাপড় এই লন্ড্রিতে পাঠানো হবে। যদি দেখা যায় তাঁরা ভাল কাজ করতে পারছেন, তখন অন্য হাসপাতালের কাপড়ও পাঠানো হবে। কাপড় কাচা নিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা হামেশাই টালবাহানা করে। পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখে না, চাদর-জামা ছিঁড়ে ফেলে, হারিয়ে ফেলে। তার বদলে যদি সরকারি হাসপাতালের সেরে ওঠা রোগীদের দিয়ে লন্ড্রি চালাতে পারি, এর থেকে ভাল কিছু হয় না।”

Advertisement

মানসিক রোগীদের নিয়ে কাজ করা ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তরফে রত্নাবলী রায় এই প্রকল্পকে ‘দৃষ্টান্ত’ বলে দাবি করেছেন। তাঁর কথায়, “পরিবারের লোকেরা এঁদের ব্রাত্য করেছেন, ফিরেও দেখেননি। প্রত্যেকেই ৬-৭ বছর কাটিয়েছেন মানসিক হাসপাতালের ভিতরে। এটা তাঁদের ঘুরে দাঁড়ানোর, তাঁরা কী করতে পারেন, তা দুনিয়াকে দেখানোর লড়াই।” ঠিক হয়েছে, দেড় বছর তাঁরা কী ভাবে কাজ করছেন তা নজরদারি করবে স্বাস্থ্য দফতরের বিশেষ কমিটি। কমিটি যদি মনে করে সব ঠিক আছে, তখন বাড়ির লোকের সই ছাড়াই মানসিক হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে ওই কর্মীদের। হাসপাতালের কাছাকাছি বাড়ি ভাড়া করে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করবে মানসিক রোগীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনটি। এ ভাবে ক্রমশ আত্মনির্ভর করে সমাজের মূল স্রোতে মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হবে তাঁদের। মনোবিদ মোহিত রণদীপের মতে, এই ধরনের ‘অকুপেশন থেরাপি’ বা ‘ওয়ার্ক থেরাপি’ সেরে ওঠা মনোরোগীদের আত্মমর্যাদা বোধ, আত্মশক্তি বাড়াতে ম্যাজিকের মতো কাজ করে।

প্রাথমিক ভাবে লন্ড্রির কাজের জন্য পাভলভ হাসপাতালের পুরুষ-মহিলা মিলিয়ে ১২ জন রোগীকে বাছাই করা হয়েছে। তাঁরা শনি-রবি এবং সরকারি ছুটির দিন বাদ দিয়ে বাকি দিন ৫-৬ ঘণ্টা করে কাজ করবেন। তবে জরুরি প্রয়োজনে ছুটির দিনেও কাজ করতে হতে পারে। কবে সেই কাজ শুরু হবে, তার জন্য দিন গুনছেন প্রদীপ ঘোষ, অনুপ বসু, বিপ্লব রায়-রা।

ফুলবাগানে বাড়ি ছিল অনুপবাবুর। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সে চাকরি করতেন। মানসিক সমস্যা হওয়ায় ৬ বছর আগে দাদারা পাভলভে ভর্তি করে দেন। তার পরে আর কেউ দেখতে আসেননি। বছর দুয়েক আগে নিজেই হাসপাতাল থেকে পালিয়ে বাড়ি গিয়েছিলেন। জানালেন, দাদারা ঢুকতে দেননি। তাই ফিরে আসেন পাভলভেই। প্রায় একই অভিজ্ঞতা প্রদীপ-বিপ্লবদেরও। জানেন, আর ফিরিয়ে নেবে না পরিবার। তাঁদের ভরসা করে কাজও দেবে না কেউ। সুস্থ হওয়া সত্ত্বেও ‘পাগল’ বলে দূর করে দেবে। লন্ড্রির কাজকে হাতিয়ার করে তাই জীবনের লড়াইয়ে ফিরতে চান তাঁরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement