সচেতনতা শিকেয়, হাতুড়ের পাল্লায় পড়ে প্রাণ গেল সদ্যোজাতের

প্রচারের ঢক্কানিনাদই সার। এখনও গ্রামীণ এলাকার ভরসা সেই হাতুড়ে চিকিত্‌সক! জননী ও শিশু সুরক্ষা যোজনা থাকা সত্ত্বেও প্রাণ হারানোর ঘটনা ঘটল সদ্যোজাতের। মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন মা’ও। শেষ পর্যন্ত মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপতালে মাকে ভর্তি করায় বেঁচে যান তিনি।

Advertisement

মেদিনীপুর

নিজস্ব সংবাদদাতা শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৪ ০১:৫৭
Share:

মেদিনীপুর মেডিক্যালে ভর্তি ধনি হাঁসদা।—নিজস্ব চিত্র।

প্রচারের ঢক্কানিনাদই সার। এখনও গ্রামীণ এলাকার ভরসা সেই হাতুড়ে চিকিত্‌সক!

Advertisement

জননী ও শিশু সুরক্ষা যোজনা থাকা সত্ত্বেও প্রাণ হারানোর ঘটনা ঘটল সদ্যোজাতের। মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন মা’ও। শেষ পর্যন্ত মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপতালে মাকে ভর্তি করায় বেঁচে যান তিনি। বিধানচন্দ্র রায়ের জন্ম-মৃত্যু দিবসে বিফলতার এই চুড়ান্ত চিত্র দেখা গেল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায়।

ঠিক কী হয়েছিল? বৃহস্পতিবার সকালে কেশপুর ব্লকের আমড়াকুচি গ্রামের ধনি হাঁসদার প্রসব যন্ত্রণা শুরু হয়। গ্রামে থাকা এক হাতুড়ে চিকিত্‌সককে দেখানো হয়। চিকিত্‌সক পরামর্শ দেন, বিকেলের মধ্যে সাধারণ ভাবেই প্রসব হয়ে যাবে। দুশ্চিন্তার কারণ নেই। জটিলতা দেখা দিলে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। হাতুড়ের পরামর্শ মেনে ওই মহিলার পরিবারের লোকেরা তাঁর চেম্বারে তক্তাপোশে রোগীকে শুইয়ে রাখেন। বিকেলের দিকে প্রসব যন্ত্রণা বাড়ে। সাধারণ ভাবে প্রসব শুরু হলেও পরবর্তীকালে জটিলতা দেখা দেয়। অনেক টানাহ্যাঁচড়া করেও বাচ্চাকে বের করতে অক্ষম হয়ে ওই চিকিত্‌সক অস্ত্রোপচার করেন। কিন্তু হাতুড়ের টানাহ্যাচড়ার চোটে সদ্যোজাত পুত্র সন্তান বাঁচেনি। অস্ত্রোপচার করে বাচ্চা তো হল, এবার সেলাই করার দরকার। গলগল করে রক্ত যে বেরিয়েই চলেছে। সেলাইও করেন হাতুড়ে। রক্ত বেরোনো কিছুটা কমলেও একেবারে কমছিল না। ওই অবস্থাতে হাতুড়ে চেম্বারে থাকা তক্তাপোশেই দু’দিন রাখা হয় রোগীকে। রবিবার মেদিনীপুরে ওই মহিলা এক চিকিত্‌সককে দেখান। তিনি দেখার পর তাঁকে মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি করাতে পরামর্শ দেন। চিকিত্‌সকেরা পরীক্ষা করে দেখেন, রোগীর দেহে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ মাত্র ৪। সেলাইও করা হয়েছে সাধারণ সুতো দিয়ে। অর্থাত্‌ ফের অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন রয়েছে। দু’দিন রক্ত দেওয়ার পর মঙ্গলবার ফের অস্ত্রোপচার করা হয়। রোগীর মা শম্বরী মুর্ম্মু বলেন, “হাতুড়ে ডাক্তার এমন পরামর্শ দেওয়ার জন্যই তো রেখে দিয়েছিলাম। তাই নাতিকে হারাতে হল।” কিন্তু বর্তমানে যে সরকারি হাসপাতালে চিকিত্‌সা করালে মা ও শিশুর কোনও খরচ লাগবে না, এমনকি শিশুর ১ বছর পর্যন্ত চিকিত্‌সা খরচ লাগবে না, তা কী জানা ছিল না? ধনির স্বামী সুকুমার হাঁসদার কথায়, “সাধারণ প্রসবের ক্ষেত্রে আগে তো সমস্যা হয়নি। তাই গ্রামের চিকিত্‌সক যখন বললেন সাধারণ ভাবেই প্রসব হয়ে যাবে, তাই হাসপাতালে নিয়ে যায়নি।” এর জন্য কত টাকা নিয়েছেন ওই হাতুড়ে চিকিত্‌সক? সুকুমারবাবুর কথায়, “চিকিত্‌সককে ১১০০ টাকা দিতে হয়েছে।”

Advertisement

অথচ, জননী সুরক্ষা যোজনায় আগে ছিল, সাধারণ প্রসবের ক্ষেত্রে মায়ের ৪৮ ঘন্টা ও সিজারের ক্ষেত্রে ৭ দিন এবং সন্তানের ১ মাস নিখরচায় চিকিত্‌সা ব্যবস্থা। মায়ের ক্ষেত্রে একই থাকলেও সন্তানের জন্য এখন তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১ বছর। বড়ি থেকে মাতৃযান হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার খরচ লাগবে না, সব ধরনের পরীক্ষা, ওষুধ- সব কিছুই নিখরচায় পাওয়া যাবে। জটিলতার কারণ এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তরিত করতে হলে অ্যাম্বুল্যান্সের খরচও দেবে সরকার। এত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দুরে ও কেশপুর গ্রামীণ হাসপাতাল থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরে আমড়াকুচিতে কেন এখনও হাতুড়ের উপর নির্ভর করে থাকেন গ্রামের মানুষ। মূলত, সচেতনতার অভাবেই টাকা খরচ করার পাশাপাশি যে ঝুঁকি নিয়েও হাতুড়ের উপর ভরসা করেন তা স্বীকার করে নিয়েছেন সুকুমার। সুকুমারের কথায়, “অনেকে হাসপাতালে যেতে বলেছিলেন। হাতুড়ে চিকিত্‌সকও বলেছিলেন, সমস্যা হলে হাসপাতালে নিয়ে যাবেন। যেহেতু আগে অনেকেই এখানে প্রসব করিয়েছেন, সমস্যা হয়নি, তাই আমিও স্ত্রীকে ওখানেই রাখি।” মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসাপাতালের যে চিকিত্‌সক পুনরায় ধনির চিকিত্‌সা করেছেন সেই সব্যসাচী রায়ের কথায়, “বর্তমানে সমস্ত সরকারি হাসপাতালেই এই ধরনের চিকিত্‌সার যাবতীয় পরিকাঠামো রয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবে সরকারি কত সাহায্যও রয়েছে। তবু এখনও অনেকে কেন এমন ঝুঁকি নেন বুঝতে পারছি না। রোগীর যে অবস্থা হয়েছিল তাতে মায়েরও মৃত্যু হতে পারত। এভাবে সাধারণ সুতো দিয়ে যা হোক করে কেউ সেলাই করে!” জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরিশচন্দ্র বেরাও। তিনি বলেন, “আমরা লাগাতর প্রচার চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু তার মধ্যেও জেলার কয়েকটি জায়গায় এখনও হাতুড়েদের প্রভাব রয়েছে। তাঁরা গ্রামের মানুষের মনে এমন প্রভাব বিস্তার করেছেন যে তাঁদের উপরেই অগাধ আস্থা জন্মে গিয়েছে। ফলে এরকম ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। এর থেকে ওই সব মানুষকে বের করতে প্রচারে আরও জোর দেওয়া হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন