Monsoon Special

Rain in Melbourne: মেলবোর্নের বর্ষা, কাচ থেকে স্লো মোশনে গড়িয়ে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটা

আমি যখন প্রথম প্রথম মেলবোর্নে আসি, তখন অস্ট্রেলিয়ায় জলবায়ু নিয়ে একেবারেই সম্যক ধারণা হয়নি। শুধু শহরগুলির নামের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে— লিখেছেন অভ্র পাল

Advertisement

সংগৃহীত প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০২২ ০৮:৩৪
Share:

মেঘের ঘনঘটা মেলবোর্নের আকাশে, ছবি: শাটারস্টক

বৃষ্টি নিয়ে কিছু বলতে গেলেই ছোটবেলায় ‘শ্রীকান্ত’ থেকে পড়া সেই দিনটার কথা মনে পড়ে যায়। সারাদিন বৃষ্টি হয়েও শেষ হয়নি, পড়তে বসার অবাধ্যতা এবং শব্দের যাদু - সব মিলে পুরনো দিনের বাংলা গদ্যে এমন এক অমোঘ আকর্ষণ ছিল, যা কিছুতেই ভোলবার নয়। আমাদের যেমন কবিতা মুখস্থ করতে বলা হত, তেমনি গদ্যের কিছু লাইন যেন কোন অমোঘ নিয়মে গেঁথে যেত মনের মধ্যে, “সে দিনটা আমার খুব মনে পড়ে। সারাদিন অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপাত হইয়াও শেষ হয় নাই। শ্রাবণের সমস্ত আকাশটা ঘন মেঘে সমাচ্ছন্ন হইয়া আছে, এবং সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইতে না হইতেই চারিদিক গাঢ় অন্ধকারে ছাইয়া গিয়াছে। সকাল সকাল খাইয়া লইয়া আমরা কয় ভাই নিত্য প্রথামত বাহিরে বৈঠকখানার ঢালা-বিছানার উপর রেড়ির তেলের সেজ জ্বালাইয়া বই খুলিয়া বসিয়া গিয়াছি।”

Advertisement

আমার মনে হয় বৃষ্টির সব থেকে মজার ব্যাপারটা হল এই যে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির চরিত্র বদলাতে থাকে - আমার কাছে ছোটবেলার বৃষ্টি যেমন অবাধ্যতা বা কৈশোরের বৃষ্টি মানে খিচুড়ির সঙ্গে প্রথম পরিচয়, যৌবনের বৃষ্টি মানে যেমন প্রেম তেমনি একটা সময় এমনও এসেছে, যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা অবিরাম বৃষ্টি দেখে ঘরে বন্দি থাকতে থাকতে মনে হয় বৃষ্টি নিয়ে এই সব রোমান্টিকতা নিছকই বাতুলতা। আসলে বৃষ্টির চরিত্রায়ন তো করেছি আমরাই। অস্ট্রেলিয়ানরা সেদিক থেকে দেখতে গেলে অনেক বেশি বাস্তববাদী। বৃষ্টি নিয়ে তাঁদের কোনও অহেতুক আবেগ নেই।

মেলবোর্নে বারি ধারা, ছবি: অভ্র পাল

আমি যখন প্রথম প্রথম মেলবোর্নে আসি, তখন অস্ট্রেলিয়ায় জলবায়ু নিয়ে একেবারেই সম্যক ধারণা হয়নি। শুধু শহরগুলির নামের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। আমার এক বয়স্ক সহকর্মীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল মেলবোর্ন নিয়ে। আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই যে শুনি মেলবোর্ন খুবই সংষ্কৃতিমনস্ক শহর, অস্ট্রেলিয়ার কালচারাল ক্যাপিটাল - এরকম কেন’? উনি হেসে উত্তর দিলেন, ‘তুমি তো নতুন - একটা বছর থাকলেই বুঝে যাবে। মেলবোর্নে প্রায় গোটা বছর জুড়েই ঠাণ্ডা থাকে, ফলে বাড়ি থেকে বের হওয়া মুশকিল হয়ে যায়। আর বাড়ি থেকে বেরোতে না পারলে আর কি হবে, সংস্কৃতিই হবে’। তা কথাটা উনি খুব ভুল বলেন নি। যে সময়টা শীতকাল, সেটুকু তো শীত বটেই, আবার গ্রীষ্ম-শরত-বসন্ত যে কোনও সময়েই ঠাণ্ডা পড়তে পারে।

Advertisement

আসল মজাটা বুঝলাম আরও কিছুদিন যাওয়ার পর। বৃষ্টির পরিমাণ দেখতে গেলে মেলবোর্নে খুব বেশি বৃষ্টি যে হয় তা নয়, কিন্তু বছরের চারটে ঋতু (গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত, বসন্ত) একই দিনের মধ্যে দেখা যেতে পেরে এমন এক অদ্ভুত শহর হল মেলবোর্ন। এর কারণ আর কিছুই না — এর ভৌগলিক অবস্থান। এক দিকে মাউন্ট ম্যাসিডন রেঞ্জ, অন্যদিকে দক্ষিণ মহাসাগর - আরেকদিকে মরুভূমি। কখনও প্রচণ্ড গরমের মধ্যে আসতে শুরু করে শীতল বায়ুস্রোত, কখনও প্রবল শীতের মধ্যে জেগে ওঠে ফুটফুটে একটা দিন। এর মধ্যে অতিমারি চলাকালীন আরও এক মজার অভিজ্ঞতা হল।

আমি যেদিকে মুখ করে কাজ করতে বসতাম, সেদিকটা উত্তর দিক - আর আমার বাড়ি শহরের উত্তর পশ্চিম দিকে। ফলে আমার জানলা দিয়ে বাইরে দেখা যেত মাউন্ট ম্যাসিডন। আমার বস মাঝে মধ্যেই আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, আজকের আবহাওয়া কীরকম দেখছ? আমিও বলতাম - আজকে মেঘলা, বা আজকে আকাশ পরিষ্কার। একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি যে আমাকে এরকম প্রশ্ন কর রোজ, সেটা এমনিই কর - নাকি কোনও কারণে? তাতে তিনি বললেন, মেলবোর্নের আবহাওয়া নাকি পশ্চিম থেকে পূব দিকে একটু একটু করে বয়ে আসতে থাকে। অর্থাৎ আজকে পশ্চিমের আবহাওয়া দেখে কালকে পূব দিকের আন্দাজ পাওয়া যায়। এর পর থেকে জিজ্ঞেস না করলেও আমি আবহাওয়া দফতরের কাজটা সেরে নিতাম সকাল সকাল।

গোধুলি শহর, ছবি: অভ্র পাল

মেলবোর্নের বৃষ্টি নিয়ে শুরু করেছিলাম। সত্যিই এক একটা দিন এমন আসে, যখন প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, এই বন্দিদশা থেকে মুক্তি কবে পাব। বারান্দায় টবের গাছগুলো অঘোরে ভিজতে থাকে। প্রবল ঝড়ে বাড়ির মেলা কাপড় উড়ে যায় আরেকজনের বাড়িতে। পাশের বাড়ির বেড়ালটা মনমরা হয়ে বসে থাকে জানলার গায়ে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো স্লো মোশনে গড়িয়ে পড়তে থাকে কাচের দেওয়াল বেয়ে। আর হঠাৎ করেই যেন বয়স কমে যায়।

স্কুল বাসের কাচের জানলাগুলি ছিল খুবই ঠুনকো। সামনে পিছনে দু’টো সিটের মধ্যে লড়াই লেগেই থাকত — কে বেশি জানলার হাওয়া পাবে। লড়াই, মারামারি, জানলা দু’পাশ থেকে ঠেলতে গিয়ে যাবতীয় শক্তি-প্রদর্শন। আবার একটু বৃষ্টি হয়ে গেলে উল্টোটা। তখন কাচটা পুরোপুরি বন্ধ করে কে তার ওপর নিজের নাম লিখতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক করে হওয়ার পিছনে কাচটাও একটা অপ্টিমাম ঠাণ্ডা হওয়ার ব্যাপার আছে তখন তো আর বুঝতাম না - তাই নিয়েও আবার লড়াই। একদিন স্কুল ফেরত একটা জানলার ধারের সিট কোনওমতে ধরেছি। কিন্তু আমার এক বন্ধু আমার পাশে বসে সন্তুষ্ট নয়। তারও জানলার ধার চাই। ব্যাপারটা প্রবল অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়াল। বন্ধুটির বাবা সেদিন সঙ্গে ছিলেন, তিনি আর কোনও উপার না পেয়ে শেষমেশ বিধান দিলেন, বাড়ি গিয়ে যত খুশি জানলার ধারে বসিস। ভাবছেন এটা মেলবোর্নের গল্প কি করে হয়?

বৃষ্টির কাচ থেকে স্লো মোশনে গড়িয়ে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটা

আসলে জানলার ওপারে স্লো মোশনে বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে দেখে মনে হয় ইস্কুল বাসে জানলার ধারে একটা সিট পেয়েছি কোনওমতে। বাসটা লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে তো চলছেই। মাঝে মধ্যে ভুলে যাই আসল স্লো-মোশন তো আর ক্যামেরায় না, স্মৃতিচারণাতেই লুকিয়ে আছে এর আসল রহস্য।

এই প্রতিবেদনটি সংগৃহীত এবং ‘আষাঢ়ের গল্প’ ফিচারের একটি অংশ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন