বেল বাজতে ফ্ল্যাটের দরজা খুললেন নিজেই। দেওয়ালে তাঁর আঁকা ছবি। একটু বাদেই আড্ডা শুরু...
পত্রিকা: ফেলুদা করতে না পারার আফসোস কিরীটী করে মিটল?
চিরঞ্জিত: খুব ইচ্ছে ছিল ফেলুদা করার। কী আর করব? নিল না। তবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পরে সব্যসাচী চক্রবর্তী, যখন ফেলুদা করল তখন কিন্তু মনে হয়েছিল এটাই ঠিক। পরে ব্যোমকেশ, ফেলুদা দুটোই আবীর করল। ভাল করেওছে। তবে মনে হয় ব্যোমকেশ একটু বয়স্ক। তাই উত্তমকুমারকে দারুণ মানিয়েছিল।
পত্রিকা: ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত কিরীটী করলেন। আরও ‘কিরীটী’ হচ্ছে। সেখানে আপনি কেন ঢুকলেন?
চিরঞ্জিত: আসলে নীহাররঞ্জন গুপ্ত-র সঙ্গে আমাদের পারিবারিক যোগাযোগ। ছোটবেলা থেকেই গোলপার্কে ওদের ‘উল্কা বাড়ি’-তে যাই। ওখানে নীহাররঞ্জনকে দেখতাম সকলের চেয়ে আলাদা। পরে মনে হয়েছে আর কেউ না, উনিই কিরীটী। আমার বাবা (শৈল চক্রবর্তী) কিরীটীর কভার পেজ ডিজাইন করতেন। সেখান থেকেই মুগ্ধতা শুরু। অঞ্জন দত্তকে অনেক দিন আগে বলেছিলাম ‘কিরীটী’ করার জন্য। কৌস্তভদেরও (প্রযোজক কৌস্তভ রায়) বলেছিলাম। সবাই কিন্তু বলছে আমাকে নাকি দারুণ মানিয়েছে। ছোটবেলা থেকে ক্লিন্ট ইস্টউড, গ্যারি কুপার-য়ের হিরো ওয়ারশিপে পাগল আমি। কিরীটীর মধ্যেই সেই হিরোইজমটা খুঁজে পাই। আর কমার্শিয়াল ছবির চেয়ে দেখছি গোয়েন্দা গল্পের চাহিদা অনেক বেশি। এই সব মিলিয়েই কিরীটী করলাম।
পত্রিকা: ২০১৬-র বাংলা ছবির রিপোর্ট কার্ডটা কেমন হল বলে মনে হয়?
চিরঞ্জিত: কমার্শিয়াল ছবি গত বছর একটু খারাপ গেছে। সমস্যাটা এখানেই। কমার্শিয়াল ছবি হিট না হলে ইন্ডাস্ট্রি বাঁচবে না। স্টার তৈরি হবে না। এ নিয়ে দেবকে অনেক বুঝিয়েছি আমি। আর্ট ফিল্মে স্টার তৈরি হয় না। ঋত্বিক চক্রবর্তী যদি কমার্শিয়াল সিনেমার স্টার হয়ে যেত, তা হলে এখন যে ইন্টারেস্টিং চরিত্রগুলো করছে, তার একটাও পেত না। (অভিনয় করে দেখাতে দেখাতে) সিগারেট ছুড়লে এ ভাবে মুখে আটকে যাবে। চশমা এমন ভাবে ঘোরাতে হবে দর্শক দেখে নড়তে পারবে না। বুঝলেন? এটাই কমার্শিয়াল ছবি। আমি তো আজও আমার সংলাপের জন্য বিখ্যাত। কালও একটা চ্যানেলে খবর শুনছিলাম, নিউজ রিডার বলছেন— কেঁচো খুঁড়তে কেউটে। সাপের প্রবাদটা সবাই ভুলেই গেল। একটা ছবির সংলাপ ভাষাটাকেই পাল্টে দিল। এটা আগে ঘটেনি। আর এই সংলাপ নিয়ে মীর থেকে খরাজ (মুখোপাধ্যায়) মিমিক্রি করে দর্শক মাতাচ্ছে।
পত্রিকা: ‘চতুষ্কোণ’-য়ের মতো ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড উইনিং ফিল্মে সৃজিত মুখোপাধ্যায় তো আপনার সংলাপ পরমব্রতকে (চট্টোপাধ্যায়) দিয়ে বলিয়েছেন।
চিরঞ্জিত: এটাই তো আসল মজা। শুনুন, আমি যদি দীপক হয়ে বলতাম, (খানিকটা উত্তাপশূন্য, আবেগহীন গলায়) ‘বউ হারালে বউ পাওয়া যায়...’ —শুনতে ভাল লাগত। কিন্তু হিট হতো না। চোখে জল এনে, নাক টেনে আবেগ দিয়ে বলতে হবে। দেব যখন ‘বুনোহাঁস’ করতে গেল, তখন কিন্তু ওর স্টার ভ্যালু চলে গেল। ভেঙে দেওয়া হল দেবকে। ও ফুটপাথে কাঁদছে, হাঁটছে, একটা লোকের কাছে চড় খাচ্ছে। স্টার মরে যাচ্ছে। অভিনেতা বেঁচে উঠছে। আর ইন্ডাস্ট্রি শুকিয়ে যাচ্ছে।
পত্রিকা: তা হলে, কেউ নিউএজ ছবি করবে না বলছেন?
চিরঞ্জিত: বাংলা ছবির প্রজেকশন হাউস সাতশো পঞ্চাশ থেকে দুশো চল্লিশে নেমে এসেছে। সুচিত্রা সেন শোনা যায় ‘সপ্তপদী’তে কাজ করার জন্য দু’ লক্ষ টাকা নিয়েছিলেন। ছবির পঞ্চাশ বছর পার হল। টাকার হিসেব করলে এখন সেই পারিশ্রমিক দাঁড়াবে দু’ কোটি চৌষট্টি লক্ষ টাকা। সেখানে আজ একজন হিরোইনকে দু’লক্ষ টাকা দিয়ে ছবিতে সই করানো হয়। বলা হয় ছবি ‘কান’ বা বার্লিনে যাবে। দুর্ধর্ষ ছবি। করে দাও। অঙ্ক কষলে দেখা যাবে তার পাওনা ছিল দু’কোটি চৌষট্টি লক্ষ। অথচ মুম্বই দেখুন। দেবানন্দ ধরে নিলাম পাঁচ লক্ষ টাকা নিতেন। এখন সেটা হিসেব করলে চার কোটি। কিন্তু সলমন? তিরিশ কোটি কামাচ্ছে। এইখানেই গোলমাল। আমরা এমনিতেই মরে যাচ্ছি। এ অবস্থায় জিৎ, দেব, এরা কী চাইবে? এরা ভাববে পয়সাটা তো দারুণ কিছু হচ্ছে না। একটা ভাল অ্যাক্টর হিসেবে নামটা অন্তত পাই। সলমনকে দেখুন, ও কাউকে গিয়ে বলছে না, আমায় ফেস্টিভ্যাল ছবিতে কাস্টিং করুন, কমে করে দেব। শাহরুখও বলছে না। ওরা তিরিশ কোটিতে চলে গেছে। ওদের মিডিয়ার দরকার নেই। চাইলে ওরা কাগজটাই কিনে নিতে পারে।
পত্রিকা: এই বাজারেও কিন্তু ‘বেলাশেষে’, ‘প্রাক্তন’য়ের মতো ছবি সুপারহিট হচ্ছে! এ নিয়ে আপনি কী বলবেন?
চিরঞ্জিত (উত্তেজিত): শিবু (শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়) প্যারালাল ট্র্যাকে চলছে। এটাই গত দশ বছর ধরে আমি বলে আসছি। ন’ কোটির পশ্চিমবঙ্গে দু’লাখ লোক আছে, যারা কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শব্দ’ দেখবে। এ বার সেই জায়গা থেকে শিবু-নন্দিতা (নন্দিতা রায়) দু’ লাখ দর্শক থেকে বারো লাখ দর্শক তৈরি করেছে। এটাই মিডল রোড সিনেমা। কমার্শিয়ালও নয়, আর্টও নয়। এই ইন্ডাস্ট্রির শিবু-নন্দিতার মতো আরও পাঁচজন পরিচালক চাই। আমি বরাবর বলেছি, লুঙ্গির ফ্যাক্টরি তৈরি করতে হবে। এই ফ্যাক্টরি ছ’কোটির ব্যবসা দেবে। তার মধ্যে একটা কোনায় এসি ঘরে ধুতি বিক্রি হোক না!
পত্রিকা: এত কথা বলছেন, আপনি নিজেই তো খুব কম ছবি করেন...
চিরঞ্জিত: আরে ভাই, সিনেমার বাইরে অন্য অনেক কাজ আমার ভাল লাগে। ছবি আঁকি, গান শুনি। অন্য লোকের কাজ দেখি। বই পড়ি। শুধু ছবি ভাবব, ছবি খাব, ছবি শোব, এ রকমটা না। তবে হ্যাঁ, গল্প ভাল লাগলে আমি অবশ্যই ছবি করব। এই যেমন রঞ্জন ঘোষের চারটে গল্প নিয়ে ছবি হচ্ছে। আমি করছি। দেবের সঙ্গে ‘চ্যাম্প’-য়ের শ্যুটিং তো চলছেই। জিৎ-য়ের সঙ্গে ‘বস২’ করছি। কমার্শিয়াল সেটআপকে নষ্ট করা চলবে না।
পত্রিকা: আপনি সেই ঘুরেফিরে ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’র পক্ষে?
চিরঞ্জিত: এখনও বলছি ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’-র হাজারটা প্রিন্ট বের করা হোক। আবার হিট হবে। সাতাশ বছর হয়ে গেল ছবিটার। তাতে কী! লোকের কাছে ওটাই আমার পরিচিতি। কিন্তু চুপি চুপি একটা কথা বলে রাখি। আমি নিজে দু’বারের বেশি ওই ছবিটা দেখতে পারব না। আমি ‘বাড়িওয়ালি’, বা ‘চতুষ্কোণ’ দেখব। চিরঞ্জিত নই, আসলে আমি সেই দীপক।