কল্পায়ন: ‘গ্রুপ নাইনটি নাইন’-এর প্রদর্শনী। সম্প্রতি, গগনেন্দ্র প্রদর্শশালায়
আগে আরও ছ’টি দলবদ্ধ প্রদর্শনী করেছে এই দলটি। বর্তমান প্রদর্শনীর মান দেখে অবশ্য মুহূর্তের জন্যও মনে হয় না সেই কথা। প্রদর্শনী উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ করে একটি দলকে। সেখানে এমন কিছু বিষয় থেকে শিল্পী-ভাস্কর অভিজ্ঞতাপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন যে আশা করাই স্বাভাবিক, আগে পাঁচ-ছ’টি দলীয় প্রদর্শনী করেছেন যখন, নিশ্চয় কিছু তাগিদ অনুভব করেছেন পরের প্রদর্শনীর জন্য, যা আরও জমাট এক ফলপ্রসূ উপলব্ধির নিদর্শন দেখাতে সক্ষম হবে। যদিও এই প্রদর্শনীতে তেমন কিছু দেখা যায়নি তো বটেই, বরং গগনেন্দ্র প্রদর্শশালায় ‘গ্রুপ নাইনটি নাইন’-এর পাঁচ দিনের এই প্রয়াস আমাকে আহতই করেছে, সন্দেহ নেই!
তেরো জনের মধ্যে কেউ কেউ কাজের মধ্যে আছেন বোঝা গেলেও, কয়েক জনের কাজ দেখে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, তাঁরা নিজেদের কাজের ধারাবাহিকতার ফাঁকটুকুও উপলব্ধি করিয়েছেন অন্যকে। এমনটা কেন হবে? যেখানে এক যুগেরও বেশি আগে তাঁরা পাশ করেছেন নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। আশ্চর্য হতে হয় এই ভেবে যে, চোদ্দো বছর আগে উত্তীর্ণ হয়েও এখনও এত দুর্বলতা? এখানেই ধারাবাহিক চর্চার অভাব।
অভীক চক্রবর্তীর ক্ষেত্রে পেন্টিংয়ের দুর্বলতা প্রকট। পাহাড় এঁকেছেন, ঝর্ণা এঁকেছেন, একটি মেয়েও। সব মিলিয়ে এত শিশুসুলভ ফিনিশিং? কোথায় ড্রয়িংয়ের কিংবা ব্রাশিংয়ের পরিণত বোধ? তাঁর চেষ্টার অভাব দৃষ্টিগোচর হল!
পায়েল সরকার অনেক পুরনো একটি ক্যানভাসের কাজ রেখেছেন। মিশ্রমাধ্যমের নিসর্গ। খুবই বিমূর্ত। জানা নেই, এই বিমূর্ত ছবির ক্ষেত্রে অ্যারেঞ্জমেন্ট ও রূপারোপের ব্যবহার বুঝেছেন কি না! না বুঝে করে থাকলে ছবির অন্তর্নিহিতে প্রবেশ করা কঠিন হবে। দর্শক কতটা বুঝবেন? বরং তাঁর কাজে রূপারোপকে সম্পূর্ণ অন্য ভাবে ব্যবহার করলেও, তাদের অস্তিত্ব যে নিজস্ব ধারণায় কিছু পরিবর্তিত হয়েও প্রাণিত, তা বেশ বোঝা যায়। ড্রাই প্যাস্টেলের কাজ হিসেবে চলেই যায়।
সঞ্জীব সাহা সাদা-কালো ব্রাশিংয়ে ড্রয়িং-সদৃশ বাড়িঘরের স্থাপত্যময় কিছু সংগঠনকে দেখিয়েছেন। অতি সামান্য কিছু হালকা টোনের ব্রাশিং। কার্পণ্য না ভয়? মিত তুলিচালনার প্রাবল্য ছায়াতপ অথবা হাইলাইটকে হয়তো স্বাগত জানাচ্ছে। কিন্তু বড্ড বেশি ‘স্কেচি’ ভাব দেখাতে গিয়ে ঘর-বাড়ির কাঠামোগত সামর্থ্য মার খেয়েছে। এমনিতে এই কাজ আপাতদৃষ্টিতে দ্রুত তুলির টানটোনের স্কেচকে মনে করায়। আসলে অতি সরলীকরণ নয়, অত্যল্প কাজও কখনও কখনও নড়বড়ে হয়ে যায়। স্ট্রাকচারের ধর্মকে খুব গভীর ভাবে অনুধাবন করতে হবে সঞ্জীবকে।
নারায়ণ সাহুও অতি বিমূর্ততার এক ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে গিয়েছেন। চিন্তাভাবনায় কোনও গভীরতা নেই। তাঁর রূপবন্ধগুলির সৃষ্টির পিছনে কালার ওভারল্যাপিংয়ের ভূমিকাই প্রধান। কখনও রঙের চাপা দেওয়া অংশ থেকেই তৈরি হচ্ছে বিমূর্ততার অমন স্টাইল। ছবি তৈরির পিছনে আদৌ কোনও অন্বেষণ আছে কি? সেই অধ্যয়নের জন্যও অবশ্য যথেষ্ট জোর চাই।
শুভরঞ্জন চক্রবর্তী এবং নরোত্তম রায়ের জলরংগুলোয় প্রাণ কোথায়? এত দুর্বল জলরং একটি প্রদর্শনীর ক্ষেত্রে বেমানান। মাধ্যমটিকে নিজের আয়ত্তে এনে তবেই তো দ্বিমাত্রিকতায় তাকে উজ্জ্বল করতে হবে। যখন জলরঙের মুনশিয়ানা দেখে দর্শক আদ্যোপান্ত মজবেন!
প্রদর্শনীতে কমল মণ্ডলের ফাইবার গ্লাসের একটি ভাস্কর্য ছিল, যা এই প্রদর্শনীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ। হাতে গোলাপ, পায়ে জুতো পরে বিশেষ স্টাইলে দাঁড়ানো কিছু আঁশযুক্ত দেহের এক বহুরূপী। তার লালচে সোনালি ও তামাটে শরীরের নীচের দিকে গাঢ় খয়েরি রং। বাবুয়ানা দেখানো এই দণ্ডায়মান গিরগিটিসদৃশ বহুরূপীটিকে অসাধারণ গড়েছেন কমল। বাপ্পা মাজি এমসিলে কাজ করেছেন এবং পাতিনাও করেছেন— গণেশ নিয়ে সূক্ষ্ম নকশায় বেশ ছোট রিলিফ ওয়র্ক করেছেন। মন্দ নয়। এ ছাড়াও প্রদর্শনীতে ছিলেন সায়ন্তন মুখোপাধ্যায়, ঋত্বিক ভৌমিক, শ্যামলী হালদার পাল, গার্গী চট্টোপাধ্যায় এবং সুদীপা বিশ্বাসের কাজও।
অতনু বসু