সংক্ষিপ্ত দুই জীবনের সমীকরণ

পটকে ভিন্ন অনুষঙ্গে ও স্পেসের আয়তনকে বিন্যস্ত করে মূল রচনার পরিকাঠামো সম্পর্কে সচেতন থাকা জরুরি— এই সত্যটি গভীর ভাবে উপলব্ধি করেই তিনি কম্পোজ়িশন করেছেন।

Advertisement

অতনু বসু

শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০১৮ ০১:২১
Share:

রোমাঞ্চকর: ‘বারাণসী’ প্রদর্শনীতে ডেভিড মালাকারের কাজ। সোসাইটি অব কনটেম্পোরারি আর্টস গ্যালারিতে

বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিত্রকলায় স্নাতকোত্তর ডেভিড মালাকার এ বছরই উত্তীর্ণ হয়েছেন এবং প্রথম একক প্রদর্শনী করলেন সোসাইটি অব কনটেম্পোরারি আর্টসের গ্যালারিতে। প্রদর্শনীটির নাম ছিল ‘বারাণসী’। কাশী বা বারাণসীর কিছু অভিজ্ঞতার টুকরো জীবনকে সংগ্রহ করে, বিভিন্ন রূপবন্ধে প্রকৃতির উদ্দামতা, রহস্য রোমাঞ্চের কিঞ্চিৎ ভাবনা, বহুরূপী জীবন, রাতের অন্ধকার ও জ্যোৎস্নালোকিত আবহ, নিদ্রিত শহর, শব্দ-নৈঃশব্দ্যের অদ্ভুত আঁধার, কোলাহল ও নীরবতা একাকার করা মুহূর্তগুলি তাঁর পেন্টিংয়ের বিষয় হিসেবে ভেবেই কম্পোজ়িশন করেছেন।

Advertisement

পটকে ভিন্ন অনুষঙ্গে ও স্পেসের আয়তনকে বিন্যস্ত করে মূল রচনার পরিকাঠামো সম্পর্কে সচেতন থাকা জরুরি— এই সত্যটি গভীর ভাবে উপলব্ধি করেই তিনি কম্পোজ়িশন করেছেন। এ সব ক্ষেত্রে অনাবশ্যক বাহুল্য যেমন পরিহার করতে পেরেছেন, তেমনই প্রয়োজনীয় রূপবন্ধের বিন্যাসকেও যথাযথ প্রয়োগ করেছেন। এখানেই তৈরি হয়েছে স্পেসের নেগেটিভ তত্ত্ব ও তাকে উজ্জীবিত করার কৌশল।

প্যাস্টেল, ক্রেয়ন, ড্রাই প্যাস্টেল, চারকোল, পেনসিল স্টিক মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করলেও কোথাও একটু অ্যাক্রিলিকের হাল্কা টোন দিয়ে নিডেব্‌ল পুটি রবার ঘষে কালচে ভাব তুলে দেওয়া, ঘষামাজার ফলে চমৎকার সব টেক্সচার বার করে আনার টেকনিকও ছবিকে প্রাণবন্ত করেছে। কিছু কাজে যে রোম্যান্টিক মুহূর্ত ও সুররিয়্যালিজ়মের প্রকাশ অনুভূত হয়, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। থাকার কথাও নয়।

Advertisement

শিল্পী রিয়্যালিজ়মের পর্যবেক্ষণে সফল পথ অতিক্রম করতে গিয়ে কাশীর জীবনের কিছু মুহূর্তকে দর্শকের চোখে একটি পেন্টিংয়ের প্রকৃত উন্মোচনকেই পরিদর্শন করিয়েছেন নিজস্বতার এই করণকৌশলে। ড্রয়িংয়েও সিদ্ধহস্ত শিল্পীর মতোই মানব শরীরের মোহ-নির্মোহ, অভ্যেস-অনভ্যেসের চৈতন্যকে তুলে ধরেছেন।

কলকাতায় থাকাকালীন বাড়ির পাশের কারখানার কোলাহল, কালো ধোঁয়া, রহস্য, পরে বারাণসী ঘাটের রাতের কুকুরের চিৎকার, মারামারি, নির্জন রাতের ঘাট, তার নৈঃশব্দ্য— বারবার তাঁকে আচ্ছন্ন করেছে।

সব মিলিয়েই দুই জীবনের সংক্ষিপ্ত সময়ের দিনপঞ্জি রং-রেখার খসড়ায় মনের অভ্যন্তরেই তৈরি করে ফেলেছিল কিছু ছবির ভাবনাকে। তারই এক পরিশীলিত রূপ রূপক হিসেবে অথবা বাস্তবকেই টানটান করে খুলে দেখানোর মঞ্চ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন পেন্টিংগুলো।

রোমশ শরীরের নগ্ন সাধু, বৃহৎ ঝুঁটি ও আপাদমস্তক গাছের শাখার মতো জটা, দু’হাতে বিরাটকায় ডমরু নিয়ে দীর্ঘ সিঁড়িতে হাত-পা ছড়ানো অবস্থায় নাচছে, অসাধারণ কম্পোজ়িশন। এই ড্রয়িংটি ছাড়াও পৃথুল, বৃহৎ উদর, নগ্নপ্রায় শরীর, বাঁ হাতে লাল সিঁদুরপাত্র নিয়ে দশাশ্বমেধ ঘাটে বসা শ্মশ্রু-গুম্ফ লম্বা চুলের সাধু, একই ঘাটে তুলসী মঞ্চ কাঁটা ঝোপঝাড়ে ভর্তি, এখনও বর্তমান, পিছনে সাদা আকাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন, মঞ্চের মাঝে লাল টুকটুকে হনুমানের রিলিফ— সাদা-কালো এই ড্রয়িংগুলো অনবদ্য।

বহুরূপী সিরিজ় বেশ কিছু ফ্রেমে রচনাবদ্ধ। কখনও পুরো নীলাকাশে সাদা মেঘ ভেসে যাওয়া ঔজ্জ্বল্য, আবার কখনও ওই মেঘই অন্য রঙের সঙ্গে মিশে রোম্যান্টিক মুহূর্ত তৈরি করছে ফ্রেমভাঙা মধ্যবর্তী অংশে। প্রসাধনে আচ্ছন্ন বহুরূপী বিড়ির ধোঁয়া উড়িয়ে দিচ্ছে, কাঠের বাক্সে বসা তার মাল্যবান রূপটি বেশ ধরেছেন শিল্পী। একই সঙ্গে পাশে আয়নায় সাঁটানো ফণা তোলা সাপের স্টিকার, নীচের ফ্রেমের পাশে শিব। অন্য ছবিতে দুই ফ্রেমের নীলাকাশ ও ঘষামাজা মেঘের চমৎকার সহাবস্থান। এক পাশে বহুরূপীর লাল কৌপীন উড়ে যাচ্ছে, কোমরবন্ধনীর সরু লাল রেখা বেশ একটা ভারসাম্য এনেছে ছবিতে। এই হলদে, বাদামি ও নীলের বৈপরীত্যের মধ্যে ফ্রেমের অলঙ্কারসদৃশ গাঢ় ড্রয়িং ছবিকে একটা অন্য মাত্রা দিচ্ছে।

এ ছাড়া বড় ফ্রেমে রাজবাড়ির ঝাড়লণ্ঠনের নীল দোলাচলের নীচে অনেক ঘটনা, ফ্রেমের বাইরে প্রসাধনরত বহুরূপী, ভিতরের প্রতিবিম্বিত দর্পণের মাঝখানে বারাণসীর ঐতিহ্যময় সব প্রতীক, বাইরে বহুরূপীর সিগারেট খাওয়ার মুহূর্ত...

আসলে ডেভিড বিভিন্ন ছবির মাধ্যমেই অদ্ভুত জীবনের গল্পে তৈরি করেছেন এই আশ্চর্য ডকুমেন্টেশন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন