যন্ত্রণা, জীবন ও জ্যামিতিতে ঋদ্ধ এক জিনিয়াস

চিত্রকূট আর্ট গ্যালারিতে তাঁর ৪৩টি বিভিন্ন মাপের কাজ নিয়ে একক প্রদর্শনীটি শেষ হল। চিত্রকূটে এটি নিখিলের চতুর্থ একক। আগে এখানে ওঁর আরও ৩টি প্রদর্শনী হয়েছে। এর কর্ণধার প্রকাশ কেজরিবাল সেই সত্তরের দশক থেকেই সংগ্রহ করছেন নিখিলের কাজ। শিল্পীর জীবদ্দশায় ও তাঁর প্রয়াণের পরেও প্রচুর প্রদর্শনী হয়েছে দেশে ও বিদেশে। ডেসড্রেনের হালে মিউজ়িয়ামে ওঁর পেন্টিং সযত্ন-রক্ষিত বিশ্বখ্যাত চিত্রকরদের সঙ্গে। এমনকি পিকাসোর ছবির সঙ্গেও ঝুলছে তাঁর কাজ! বর্তমান প্রদর্শনীটির নাম ‘দি আনটেম্‌ড জিনিয়াস’।

Advertisement

অতনু বসু

শেষ আপডেট: ২৫ অগস্ট ২০১৮ ০০:০০
Share:

বিমূর্ত: নিখিল বিশ্বাসের কাজ। সম্প্রতি, চিত্রকূট আর্ট গ্যালারিতে

এত দ্রুত তাঁর জন্য মৃত্যুর বিছানা পাতা হবে? হয়েছিল। মাত্র ছত্রিশেই তরবারি-সদৃশ তুলিকলম নিঃশব্দে নামিয়ে রেখে, শিল্পকলার অন্তরীক্ষকে প্রায় নিঃস্ব করেই চলে গিয়েছিলেন নিখিল বিশ্বাস। অবিশ্বাস্য ক্ষমতা ও তুখড় শিল্পচৈতন্যের নানা সাদা-কালো এবং রঙিন পটভূমির সুদীর্ঘ ক্যানভাস তাঁর সৃষ্টির অসম্পূর্ণতায় সকল শিল্পরসিকের বুকে এক নিঃশব্দ রক্তক্ষরণ! ১৯৩০ থেকে ১৯৬৬— এই স্বল্পায়ু জীবনেও কী বিস্ময়কর সব ড্রয়িং ও পেন্টিংয়ের ইতিহাস! আর সম্মোহনের ক্ষমতা? প্যাশন, অনির্দিষ্ট যন্ত্রণা, অব্যক্ত হয়েও ভীষণ ভাবে ব্যক্ত বিষাদের বিহ্বলতার গভীরে অবগাহন... এমন বহু কিছুই নিখিলের রক্তের অন্তর্গত সত্তাকে তোলপাড় করেছিল। না হলে ক্ষিপ্র, দুর্নিবার অথচ নমনীয় কিন্তু আশ্চর্য রকম ধীর ব্রাশিং, ধাতব নিবের সূক্ষ্ম রেখাঙ্কন, কাগজের টেক্সচারের উপর দুর্ধর্ষ অত্যাচারের পরে অমন নিসর্গ! ঠিক এ ভাবে কে-ই বা উপলব্ধি করিয়েছেন?

Advertisement

চিত্রকূট আর্ট গ্যালারিতে তাঁর ৪৩টি বিভিন্ন মাপের কাজ নিয়ে একক প্রদর্শনীটি শেষ হল। চিত্রকূটে এটি নিখিলের চতুর্থ একক। আগে এখানে ওঁর আরও ৩টি প্রদর্শনী হয়েছে। এর কর্ণধার প্রকাশ কেজরিবাল সেই সত্তরের দশক থেকেই সংগ্রহ করছেন নিখিলের কাজ। শিল্পীর জীবদ্দশায় ও তাঁর প্রয়াণের পরেও প্রচুর প্রদর্শনী হয়েছে দেশে ও বিদেশে। ডেসড্রেনের হালে মিউজ়িয়ামে ওঁর পেন্টিং সযত্ন-রক্ষিত বিশ্বখ্যাত চিত্রকরদের সঙ্গে। এমনকি পিকাসোর ছবির সঙ্গেও ঝুলছে তাঁর কাজ! বর্তমান প্রদর্শনীটির নাম ‘দি আনটেম্‌ড জিনিয়াস’।

আর্ট কলেজে ছাত্র আন্দোলন পর্বে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর দলে নিখিল অগ্রগণ্য প্রায়। অর্থকষ্ট ছিল, তেমন ভাবে চিকিৎসাও করাতে পারেননি। দেহকে নিঃশেষ করে দেওয়া রোগের সঙ্গে তাই যুঝতে পারেননি শেষ পর্যন্ত!

Advertisement

উজ্জ্বল প্রগাঢ়, আবার স্তিমিত হয়ে আসা রং দিয়ে অনুজ্জ্বলের গহীনে উজ্জ্বলতার মন কেমন করা নিসর্গ ও চিত্রের অন্দরের নানা জ্যামিতিদৃপ্ত রচনা যেন দর্শককে অবিরাম টেনে নিয়ে যায় এক গভীরতর প্রকোষ্ঠে! নিসর্গের নিস্তব্ধতায় হারিয়ে যেতে যেতে নিখিল নিজেই কি পড়ে নিতেন কোনও গূঢ় কবিতা? জানা নেই। তবু নিখিলের নানা নিসর্গ অনুভব করতে করতেই মনে হয়, এ যেন হুবহু সেই শামসুর রাহমান:

‘দুপুরেই অকস্মাৎ চতুর্দিকে কেমন আঁধার হয়ে আসে। মেধার কিরণে স্নান করে শব্দাবলী অন্ধকারে কাকে ডাকে? উন্মথিত নগর, বনানী, উপত্যকা এবং পাহাড়ী পথ স্বপ্নে কথা বলার মতন সাড়া দেয়, শব্দাবলী অভ্যাসের সীমা ছিঁড়ে যায়।’

পেন্টিংয়ের নিজস্ব ভাষায় শব্দাবলি তৈরি করে নিয়েছিলেন নিখিল। ঘোড়া নিয়ে অসংখ্য কাজ করেছিলেন। দুরন্ত রেখা, ঝড়ের মতো ব্রাশিং— কালো, খয়েরি, বাদামি বিদ্যুৎ যেন চকিতে চমকে দিচ্ছে চিত্ররহস্যের চিরন্তন সত্যকে। সমগ্র ছবির মধ্যে সামান্য মাত্র রঙের উচ্চারণ জানিয়ে দিচ্ছে ছবির কিছু কিছু সাংকেতিক আবহ, যা একই সঙ্গে তার নির্দিষ্ট যাত্রাপথের শেষ দিকনির্দেশ। এত স্পষ্ট ও সার্থক তাঁর নিজস্ব শিল্পলিপি যে, পড়ে নিতে অসুবিধে হয় না কোথাও। আটপৌরে জীবনের ঘর-গেরস্থালি, সার্কাস, প্রিয় ঘোড়া, জোকার— কী না ছিল ছবিতে!

কুচি কুচি মেঘের মতো রেখার অতি সরল অথচ রোমাঞ্চকর এক রহস্যের ছায়াতপ যেন তৈরি করছে জমাট মেঘ ও শক্তিশালী পুরুষের ছন্দোবদ্ধ দেহ। মনে পড়ে যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মেঘ ভেসে যাওয়ার উজ্জ্বল পঙ্‌ক্তিকে এ ভাবেই ফিরিয়ে এনেছে নিখিলের বহু ছন্দোবদ্ধ রেখার রোমাঞ্চ! আবার যেন কোনও মাস্‌লম্যানের মতোই সব কিছু ভেঙে, ছিঁড়ে ভেসে যাওয়া মেঘের মাঝেও সে জড়িয়ে গিয়েছে অন্য এক গদ্যের মতো! রেখা ও রঙের অল্প টানটোনে মন্দির, সিঁড়ি, মানুষ, জনস্রোত, ঝড়, হু হু বাতাসের নিরবচ্ছিন্ন শব্দ...

ইউরোপের মাতিস, দুফি, পিকাসো এবং অন্যরা অবচেতনে নিঃসন্দেহে ছিলেন। না হলে শুধু মোটা জলরঙে কেন অমন অয়েল পেন্টিংয়ের স্টাইল! সম্পূর্ণ নিজস্ব—কিন্তু নেশাচ্ছন্ন হয়ে যেন ঢুকে পড়া এক উঁচু-নিচু বুনোটের পটে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন