যিনি আড়ালে থাকেন

তারই হাতে জীবনের চাবিকাঠি। লিখছেন পিয়ালী দাস‘সংসারে মানুষ চায় এক, হয় আর, চিরকাল এমনি দেখে আসছি ডাক্তারবাবু। পুতুল বই তো নই আমরা, একজন আড়ালে বসে খেলাচ্ছেন।’ স্মরণীয় উক্তি মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের, ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসে। এক অদৃশ্য সুতোর তারেই হয়তো বাঁধা মানুষের জীবন। এই সত্যই মিলে মিশে যায় উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রের জীবন-যাপনে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:০৩
Share:

‘সংসারে মানুষ চায় এক, হয় আর, চিরকাল এমনি দেখে আসছি ডাক্তারবাবু। পুতুল বই তো নই আমরা, একজন আড়ালে বসে খেলাচ্ছেন।’ স্মরণীয় উক্তি মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের, ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসে। এক অদৃশ্য সুতোর তারেই হয়তো বাঁধা মানুষের জীবন। এই সত্যই মিলে মিশে যায় উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রের জীবন-যাপনে। সমাজ বদলায়, পুরনো মূল্যবোধেরও বদল ঘটে কিন্তু নারী-পুরুষের সম্পর্কের মূল সুর কিংবা টানাপড়েনের বদল ঘটে না।

Advertisement

চেতনার প্রযোজনায় এবং অরুণ মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় সম্প্রতি মঞ্চস্থ হল নাটকটি। এর সার্থক মঞ্চায়নে ফুটে উঠল জীবনের টানাপড়েনের খন্ডচিত্র, জটিল মনস্তত্ত্বও। মন বুঝতে না পারার বেদনা, অন্ধবিশ্বাসে ভর করে মিথ্যেকে সত্যে রূপান্তরিত করতে চাওয়ার বৃথা চেষ্টা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের পুতুলের মতো দেখা, ব্যবহার করা কিংবা তাদের চাওয়া-পাওয়া, ইচ্ছে-অনিচ্ছের যথার্থ মূল্য না দেওয়া – এই রূঢ় বাস্তব ধরা পরে নাটকের প্রতিটি দৃশ্যে।

শশী চেয়েছিল জীবনটাকে বড় কাম্য, উপভোগ্য করে তুলতে, পারেনি। ডাক্তারি, বিষয় আশয়ের দায়িত্ব কর্তব্য সামলাতে, যুক্তি দ্বারা জীবনকে চালনা করতে গিয়ে, চাপা পড়ে যায় মনের চাহিদাগুলো। পরিবর্তে শশীর বন্ধু কুমুদ জীবনটাকে চুটিয়ে উপভোগ করতে পারে বোহেমিয়ান ভাবে, যাত্রাদলের অভিনেতা হয়ে।

Advertisement

জীবনটাকে ঠিকমতো উপভোগ করতে না পারা একাকী শশীর অসহায়তা সুন্দরভাবে প্রকাশ পায় বিপ্লব বন্দোপাধ্যায়ের বাকরুদ্ধ অভিনয়ে।

কুসুম ভালবেসেছিল শশীকে। নানা ছলে তার কাছে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু নির্বোধ শশী সময়মতো তা বুঝে উঠতে পারেনি। সহজ সরল গ্রাম্য অভিমানী কুসুমের চরিত্রে মনীষা আদক-এর অভিনয় মন ছুঁয়ে যায়। শশীর সান্নিধ্য পাওয়ার দৃশ্যে কুসুমের ছটফটানি, ব্যাকুলতা আহত করে দর্শক মনকেও। এর সঙ্গে মিলে যায় জীবনের টুকরো চাওয়া-পাওয়া, অপূর্ণতাগুলো।

কুসুম-মতি, এই ননদ বৌদির সম্পর্কের মিষ্টি রসায়নের দৃশ্য রচিত হয়। কুমুদ-মতির প্রেম এবং সুখী দাম্পত্যের মঞ্চায়ন বাড়তি পাওনা। ছটফটে, কল্পনাপ্রবণ মতির চরিত্রে তূর্ণা অনবদ্য। খামখেয়ালি, বোহেমিয়ান কুমুদের চরিত্রে অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় অসাধারণ।

বিন্দুর বিয়ে হয়েছিল বয়স্ক নন্দলালের সঙ্গে। কিন্তু কখনওই স্ত্রীর মর্যাদা মেলেনি। অন্যত্র থাকতে হয়েছিল রক্ষিতার মতো। না চাওয়া জীবনের আবর্তে ঘুরপাক খাওয়া ভাগ্যহীন বিন্দু চরিত্রে সঙ্গীতা পালের অভিনয় অনেক দিন মনে থাকবে। আমি কি এই জীবন চেয়েছিলাম বলে তীব্র চিৎকার ও কান্নায় ভেঙে পড়ার দৃশ্য, দর্শক হৃদয়কে বিদীর্ণ করে।

সূর্যবিজ্ঞানের গুণে অগাধ বিশ্বাসী কুসংস্কারাচ্ছন্ন যাদবপণ্ডিতের চরিত্রের অরুণ মুখোপাধ্যায়ের সাবলীল অভিনয়ে চমকে যেতে হয়। পাগলদিদি (কাবেরী বসু), সেনদিদি’র (এনাক্ষী সেন) অভিনয়ও উল্লেখের দাবি রাখে।

এ নাটকের প্রতিটি চরিত্রই—কী গোপাল-প্রদীপ চক্রবর্তী, যামিনী কবিরাজ-সমীর চট্টোপাধ্যায়, পরাণ-দীপঙ্কর হালদার বা অনন্ত-কল্যাণ চক্রবর্তী সহ সকলেই নিজ বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল।

নেপথ্যে ছিলেন—ভাষ্যপাঠ-সুব্রত নাথ মুখোপাধ্যায়, সংগীত-মুরারি রায়চৌধুরী, আলো-দীপক মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন