নিজের শোকসভাতে হাজির হবেন প্রয়াত বিভূতিভূষণ

সভার আমন্ত্রণ পত্র দিতে এসে উদ্যোক্তারা তেমনই জানিয়েছিলেন শিবরাম চক্রবর্তীকে। তার পর...সভার আমন্ত্রণ পত্র দিতে এসে উদ্যোক্তারা তেমনই জানিয়েছিলেন শিবরাম চক্রবর্তীকে। তার পর...সেবারও বেজায় টাকার টানটানি। শেষে কাবুলিওলার থেকে ধার করবেন কি না ভাবছেন। খবর পেলেন বিভূতিভূষণ। তখনও দুইজনের মধ্যে তেমন ভাল পরিচয়ও নেই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৬ ০০:০৩
Share:

সেবারও বেজায় টাকার টানটানি। শেষে কাবুলিওলার থেকে ধার করবেন কি না ভাবছেন। খবর পেলেন বিভূতিভূষণ।

Advertisement

তখনও দুইজনের মধ্যে তেমন ভাল পরিচয়ও নেই। তবু বিভূতি নিজেই সেধে বললেন, ‘‘কেন ভাই কাবুলির থেকে ধার করবেন? কত টাকা চাই আপনার?’’

শিবরাম অম্লানবদনে বললেন, ‘‘এই ধরুন টাকা পঞ্চাশেক পেলেই আপাতত চলে যাবে।’’

Advertisement

‘‘এই নিন টাকা, ওসব কাবুলির থেকে নিতে হবে না। ওদের বড্ড চড়া সুদ,’’ বলে বিভূতিভূষণ পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকা বার করে দিয়ে দিলেন।

সলজ্জ শিবরাম বললেন, ‘‘আপনার এই ঋণ আমি জীবনে শুধতে পারব না।’’

যথারীতি শুধতে পারেনওনি। মানে কখনও ইচ্ছে থাকলেও উপায় আর উপায় থাকলেও ইচ্ছে হয়নি আর কি! দু’জনে দেখা হলে বিভূতিভূষণ তার প্রাপ্য টাকার কথা তো কখনই তুলতেন না। শিবরাম যদিও বা কখনও বলতেন, ‘‘দাদা আপনার ওই টাকাটা এখনও বাকি...।’’

বিভূতি বলে দিতেন, ‘‘আরে থাক থাক সেসব কথা। পরে দেবেন।’’

‘‘বেশ তাহলে সুদটাই নিন। বলে টাকার বদলে দু’চার পয়সার তেলে ভাজা কিংবা চিনেবাদাম তুলে দিতেন বিভূতিভূষণের হাতে।’’ বিভূতি তাতেই খুশি।

আসলে টাকা পয়সার ব্যাপারে চিরকালই বিভূতিভূষণ ছিলেন বেজায় উদাসীন। খানিকটা শিবরাম গোছের, আবার খানিকটা একেবারেই অন্য ধারার।

টাকা হাতে পাওয়ার আগ্রহ যথেষ্ট, কিন্তু সে-টাকা একবার হাতে এসে গেলে সেগুলো যে খরচও করতে হয় কিংবা সঠিকভাবে জমানো, তার ব্যাপারে কোনই আগ্রহ ছিল না বিভূতিভূষণের। আর এখানেই শিবরামের সঙ্গে তাঁর চূড়ান্ত অমিল।

আধ্যাত্মিকতা, পরলোকচর্চায় খুবই আগ্রহ ছিল বিভূতিভুষণের। ‘দেবযান’ উপন্যাস নিয়েও তাঁর সঙ্গে অনেক কথা হয়েছিল শিবরামের। পুনর্জন্মে খুব বিশ্বাস করতেন।

শিবরামকে বলেছিলেন, ‘‘তুমি তো আর বিয়েথা করলে না। তোমার ছেলে মেয়ে নেই। আর সেই জন্যই তোমার পূর্বপুরুষরাও পূনর্জন্ম নিতে পারছেন না। আর তাদের পূনর্জন্ম না হলে তোমারও নতুন জন্ম নেওয়ার সুযোগ নেই। সবাই পর পর লাইনে আছেন কিনা। তাই তুমি বে থা না করে নিজে তো বটেই, তোমার আগের সাতপুরুষও বায়ূভূত হয়ে ঘুরবে। আমি বিয়ে করব এবার। ফিরতি বার্থ রিজার্ভেশন করে রাখা চাই বুঝলে ভায়া।’’

‘‘সে কি দাদা আপনি এই বয়েসে বিয়ে!’’

‘‘কেন সামান্য চল্লিশ বছর তো বয়স আমার।’’

শিব্রাম কিন্তু বিলক্ষণ জানতেন তখন বিভূতিভূষণের বয়স চল্লিশের অনেক বেশি।

বিয়ে করলেন বিভূতিভুষণ। তারপর অনেক দিন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ নেই শিবরামের। একবার দুর্গাপুজোর সময় শিবরাম গেলেন বিভূতিভুষণের ঘাটশিলার বাড়ি। পুজোর ছুটি ওখানেই কাটাবেন এমন ইচ্ছে।

গিয়ে দেখেন বেশ স্বাস্থ্যবান একটি বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বিভূতিভুষণ বাগানে ঘুরছেন। শিবরাম বুঝলেন, শিশুটি বিভূতিরই। জিজ্ঞসা করলেন, ‘‘তা আপনার ঘাড়ে কি সেই ফেরবার টিকিট?’’

‘‘একদম ঠিক ধরেছ। ওর নাম দিয়েছি কাজল। ওর মাধ্যমেই তো আবার আমাকে ফিরতে হবে।’’

বিভূতিভুষণের সেই পারলৌকিক বিশ্বাস যে কতটা তীব্র ছিল, বারেবারে টের পেয়েছেন শিবরাম নিজে। মৃত্যুর কিছু দিন আগে এক শ্মশানে নিজের মৃতদেহকে নাকি নিজের চোখে দেখতে পেয়েছিলেন বিভূতিভুষণ। সে-ঘটনাও জানতেন শিবরাম। আর মৃত্যুর পর? সে এক অদ্ভুত ব্যাপার!

একদিন রিপন কলেজের বেশ কিছু ছেলে এসে শিবরামকে জানালেন, ‘‘আমরা এই বছর বিভূতিভূষণের জন্মদিন পালন করব, আপনাকে সভাপতি হতে হবে।’’

‘‘বেশ হব। কিন্তু অতিথি সৎকারের ব্যবস্থা থাকবে তো? মানে একটু ভাল মন্দ।’’

‘‘হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই। স্বয়ং বিভূতিবাবুও আসবেন ওইদিন।’’

‘‘মানে? উনি আবার কী করে আসবেন? উনি তো পরপারে।’’ শিবরাম অবাক!

‘‘আজ্ঞে উনি আমাদের ত্রিকোণ চক্রে মাঝেমাঝেই আসেন। আমরা প্ল্যানচেট করে ডেকে আনি তাঁকে। কথাবার্তাও হয়।’’

‘‘বলো কি! তা জীবিত আর কাকে কাকে ডাকছ ওইদিন?’’

ছেলেরা বলল, ‘‘ভেবেছিলাম অনেককেই ডাকব, কিন্তু শেষ প্ল্যানচেটে বিভূতিবাবুই বললেন যাকেই ডাকো, কেউই আসবেন না।’’

‘‘তার মানে পরলোকে গিয়ে উনি তাঁর লেখকবন্ধুদের ভালমতই চিনেছেন। বেশ বেশ।’’

‘‘সেইজন্যই আমরা আপনার কাছে এলাম। আপনি অন্তত যাবেন আশা করি।’’

‘‘হ্যাঁ যাব বইকী। খাবার দাবারের ব্যবস্থা রাখবে বলছ যখন!’’

কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওইদিন সেখানে গিয়েও যাননি শিবরাম। বাড়ির দরজা পর্যন্ত পৌঁছে ফিরে এসেছিলেন। এই বিষয়ে শিবরামের যুক্তি ছিল, বিভূতিবাবু যখন ভেবেই নিয়েছেন তাঁর জন্মদিনে কোনও বন্ধু আসবেন না, তখন তাঁর সেই বিশ্বাসে আঘাত করা ঠিক নয়। আর দ্বিতীয়ত সেই যে পঞ্চাশ টাকা ধার রয়ে গিয়েছিল সেটা এখন যদি তার অনুগত ভক্তদের মধ্যে বলে ফেলেন, সে ভারী লজ্জার ব্যাপার হবে।

তাই বিদেহী বিভূতিবাবুর সঙ্গে দেখা করার চেয়ে স্বদেহে ফিরে আসাটাই ঢের ভাল বলে মনে করলেন শিবরাম!

শিবরাম চক্রবর্তীর ছবি: বিশ্বরঞ্জন রক্ষিত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন