Art Exhibition

নস্ট্যালজিয়ার যুগলবন্দি

দুই প্রতিভাবান শিল্পী বিমল কুণ্ডু এবং প্রদীপ মৈত্রর চিত্র প্রদর্শনী সম্প্রতি দেখল শহরবাসী। ‘সাইড বাই সাইড’ শিরোনামের এই প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল ‘মায়া আর্ট স্পেস’-এ। দুই শিল্পীই আশির দশকের নামী আর্ট কলেজে শিক্ষাপ্রাপ্ত।

পিয়ালী গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০২৫ ০৬:০০
Share:

চিত্রকল্প: বিমল কুণ্ডু ও প্রদীপ মৈত্রর যৌথ প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।

দুই প্রতিভাবান শিল্পী বিমল কুণ্ডু এবং প্রদীপ মৈত্রর চিত্র প্রদর্শনী সম্প্রতি দেখল শহরবাসী। ‘সাইড বাই সাইড’ শিরোনামের এই প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল ‘মায়া আর্ট স্পেস’-এ। দুই শিল্পীই আশির দশকের নামী আর্ট কলেজে শিক্ষাপ্রাপ্ত। প্রদর্শনীতে উভয়ের বেসিক সাপোর্ট ‘কাগজ’, মাধ্যম আলাদা। ছিল কালি কলমে বিমল কুণ্ডুর নতুন চিত্রায়ণ। আর প্রদীপ মৈত্রের জলরঙের নিজস্ব টেকনিক।

চিত্রকল্প: বিমল কুণ্ডু ও প্রদীপ মৈত্রর যৌথ প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।

আয়তাকার পরিসরে সব মিলিয়ে ছবির সংখ্যা ৪৭। প্রবেশদ্বারের বাঁ-দিক ঘেঁষে দৃষ্টিগোচরে আসে বিমল কুণ্ডুর কালি-কলমের পরিবেশন। শিল্পীর অনুভূতি এবং প্রেরণার সেতুবন্ধের একমাত্র অবলম্বন এখানে ‘রেখা’। রেখার ভাবপ্রকাশ-ক্ষমতার নিদর্শন আমরা প্রাচীন শিল্পকলা থেকেই পাই। রেখার গুণে ওজন, আয়তন, মৃদু, গভীর টোনের এক-একটি বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠতে পারে। শিল্পীর ড্রয়িংগুলি সেই রকমই রেখার ক্রিয়া বা সঞ্চারপথ। বিমল কুণ্ডুর মূল পরিচয়, তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত ভাস্কর। কিন্তু ড্রয়িংয়ের সঙ্গে তিনি কতটা একাত্ম বা পারদর্শী, সেই নমুনা আমরা খুব একটা পাই না। ‘মায়া আর্ট স্পেস’ আয়োজিত প্রদর্শনী শিল্পীর সেই অজানা দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

চিত্রকল্প: বিমল কুণ্ডু ও প্রদীপ মৈত্রর যৌথ প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।

উত্তর কলকাতার কুমোরটুলিতে বড় হয়ে ওঠা বিমলের। সুহাস রায়ের পরামর্শে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে ভর্তির জন্য মিউজ়িয়াম স্টাডি করতেন। তার আগে কোনও দিন ছবি আঁকেননি বিমল। দীর্ঘ জীবনের গড়াপেটায় বিমল হয়ে উঠলেন ফুলটাইম আর্টিস্ট। কিন্তু কোভিডের দু’বছর তাঁর পেশাজীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। শুরু করেন ড্রয়িং। ‘সোসাইটি অব কনটেম্পোরারি আর্টিস্ট’ গোষ্ঠীর সদস্য হওয়ার সুবাদে জুটে যায় কিছু পড়ে থাকা লালচে কাগজ। এক সময়ে বিদেশ থেকে আনা কাগজের বাণ্ডিল রাখা ছিল সোসাইটির ভবনে। বিকাশ ভট্টাচার্য, গণেশ হালুইয়ের ছাত্র হিসাবে ড্রয়িংয়ের সাথর্ক রূপ ফুটে উঠল এই কাগজে।

ভিন্ন ভিন্ন টোনের কলমে, প্রদর্শিত ২৭টি ছবি সময়ের সাক্ষী হয়ে রইল। মূর্তি নির্মাতার মতোই পাকা হাতের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম স্ট্রোকের প্রকাশ। ড্রয়িং নিয়ে ভুবনেশ্বরে শো করার পরে এই গ্যালারিতে এটি তাঁর দ্বিতীয় ড্রয়িং শো। ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতায় সিম্ফনির মতো ভিতরের বিমূর্ত সত্তা বেরিয়ে আসে এ সব ছবিতে। বিশেষত রূপান্তরের জালে রেখার সঙ্কেত দীর্ঘ হয়। অসাধারণ সব অভিব্যক্তির আত্মপ্রতিকৃতি, পার্শ্বমুখ। কিছু ছবিতে স্কাল্পচারের ভলিউম দেখা যায়। যেমন, ষাঁড়, কাক, পেঁচা, হাতি। রেখার জমাট বুননে মূর্ত-বিমূর্তের পরিপ্রেক্ষিত সুন্দর ধরা পড়ে। ভাল লাগে হাতল-সহ কাপের গঠনে গাছের অংশবিশেষের চেহারা। ব্রাস-প্লেটে এচিং-কৃত কালীর প্রতিবাদী রূপপ্রকাশে মনেই হয় না, এই মাধ্যমে ভাস্কর বিমল কুণ্ডুর সদ্য প্রবেশ!

চিত্রকল্প: বিমল কুণ্ডু ও প্রদীপ মৈত্রর যৌথ প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।

আর এক সমসাময়িক শিল্পী হিসেবে প্রদীপ মৈত্র জলরঙের আধুনিক উপস্থাপকই কেবল নন, একজন নিরন্তর গবেষকও বটে। তাঁর এই গবেষণায় দেখতে পাই, অতীত ও বর্তমানের স্বচ্ছ ছায়া। রং চাপানোর দক্ষতায় গভীর স্তরও টলটল করে। স্মৃতিবিজড়িত আখ্যানে ফুটে ওঠে অমূল্য সম্পদ। বর্তমান হেলাফেলায় যা নিদারুণ ভাবে পর্যবসিত। শিল্পী মৈত্রর চাপা ক্ষোভ ফুঁসে ওঠে কালের পরিচয়ে।

প্রদীপ মৈত্রর বাড়িতে সাহিত্য, রাজনীতির বই পড়ার খুব চল ছিল। সেই তাকভর্তি বই বা লাইব্রেরির টান আজও শিল্পীকে ছুটিয়ে বেড়ায়। জলরঙের বিশুদ্ধ পদ্ধতিতে সেই বিলীয়মান সম্পদ বারে বারে ফিরে আসে।

প্রদর্শনীতে ছিল নির্বাচিত কুড়িটি ছবি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে ছবি করার মধ্যে শিল্পী প্রদীপ মৈত্রর আউটডোর স্টাডি আজও বর্তমান। পুরনো দিনের সংস্কৃতি ছাড়াও, কিছু ছবিতে রবার্ট ব্রাউনিং, ওয়ার্ডসওয়র্থের মর্মবাণী ভেসে আসে। ঘিরে ধরে আলো-আঁধারির চমৎকার স্তরবিন্যাস। ব্রিটিশ ঘরানায় রং-তুলি এগোলেও, অদ্ভুত ভাবে সুরিয়্যালিজ়মের বলয় তৈরি হয়। টার্নার, কনস্টেবলকে মেন্টর মানলেও, বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছেন আমেরিকান শিল্পী অ্যান্ড্রু ওয়েথের দ্বারা।

ছবির গুণগত মানের বিচারে সবই প্রায় সমান। তবুও কিছু বিষয়গত কৌশল পলকহীন দৃষ্টির অনুসারী হয়। যেমন, স্টিল লাইফের কাপড়, কয়লার ইঞ্জিনের ধোঁয়াটে ছবি। স্তূপীকৃত বইয়ের খোলা পাতা। শিক্ষাব্যবস্থার বিলোপ, ভাঙাচোরা (মোনোক্রমিক) বাড়ির চাপা শ্বাস। নিশ্চিহ্ন হতে থাকে সভ্য সমাজ।

আশির দশক থেকে শিল্পচর্চার নেশা এবং তার বার্তা পরিবেশনের দায়িত্বে রয়ে গিয়েছেন এই দুই শিল্পী। লক্ষণীয় ভাবে দু’জনের শিল্পকর্মই যেন স্মৃতিচারণের আকর, পরবর্তী যাপনের আভাস এবং কনসেপচুয়াল আর্টের স্থিতিশীল দৃষ্টান্ত।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন