পশ্চিম এশিয়ার রাজনীতিতে বড় বদল। যাবতীয় শত্রুতা ভুলে ধীরে ধীরে এককাট্টা হচ্ছে আরব দুনিয়া। ‘ঐতিহাসিক’ রেলচুক্তির মাধ্যমে এ বার তার ভিত গড়া শুরু করল সৌদি আরব এবং কাতার। পরিকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পকে সামনে রেখে দুই উপসাগরীয় রাষ্ট্র যে ভাবে কাছাকাছি এসেছে, তাতে ভুরু কুঁচকেছেন দুনিয়ার তাবড় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা। সম্ভাব্য ইহুদি আক্রমণের ভয়েই কি এই ‘বন্ধুত্ব’? না কি নেপথ্যে রয়েছে আরও বড় কোনও ছক? উঠছে প্রশ্ন।
চলতি বছরের ৮ ডিসেম্বর আরবের গণমাধ্যমে প্রকাশিত সরকারি বিবৃতি অনুযায়ী, ‘উচ্চগতির বৈদ্যুতিন যাত্রিবাহী’ ট্রেনে দুই রাজধানীকে জুড়ে ফেলতে চুক্তি করেছে সৌদি ও কাতার। প্রস্তাবিত প্রকল্পে রিয়াধ থেকে দোহার হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত পাতা হবে ৭৮৫ কিলোমিটার লম্বা রেললাইন। শুধু তা-ই নয়, এর মাধ্যমে দেশের একজোড়া শহরকেও যুক্ত করার স্বপ্ন দেখছেন সৌদি যুবরাজ তথা প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ বিন-সলমন। সেগুলি হল, আল-হোফুক এবং দাম্মাম।
দ্য ইউরেশিয়ান টাইমস জানিয়েছে, প্রস্তাবিত রেললাইন দিয়ে ঘণ্টায় ৩০০ কিলোমিটার (১৮৬ মাইল) বেগে ট্রেন ছোটাতে চান সৌদির যুবরাজ। সে ক্ষেত্রে জাপানি বুলেট ট্রেনের স্বাদ পাবে পশ্চিম এশিয়ার দুই আরব মুলুক। এই প্রকল্পের কাজ শেষ হলে মাত্র দু’ঘণ্টায় রিয়াধ-দোহায় যাতায়াত করতে পারবেন সেখানকার বাসিন্দারা। বর্তমানে বিমানে ওই দুই রাজধানী শহরে যাতায়াত করতে সময় লাগে প্রায় ৯০ মিনিট। তবে সময় সামান্য বাড়লেও খরচ কমতে চলেছে বলে জানা গিয়েছে।
সম্প্রতি কাতার-সৌদি সমন্বয় কাউন্সিলের বৈঠকের আয়োজন করে রিয়াধ। সেখানে মহম্মদ বিন-সলমনের পাশাপাশি হাজির ছিলেন কাতারের আমির তামিম বিন হামাদ আল-থামি। প্রস্তাবিত রিয়াধ-দোহা রেল প্রকল্পে সবুজ সঙ্কেত দেন তাঁরা। পরে এই ইস্যুতে দেওয়া যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, আগামী ছ’বছরের মধ্যে শেষ হবে রেললাইন পাতার কাজ। বাৎসরিক এক কোটি যাত্রী পরিষেবার লক্ষ্য নিয়ে দুই রাজধানীর মধ্যে উচ্চ গতির বৈদ্যুতিন ট্রেন চালু করতে চাইছেন তাঁরা।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, প্রস্তাবিত রেল প্রকল্পটি পশ্চিম এশিয়ার ওই দুই দেশে ৩০ হাজারের বেশি কর্মসংস্থান তৈরি করবে। এর জন্য ৩,০৬৪ কোটি ডলার বরাদ্দ করতে চলেছে রিয়াধ এবং দোহা। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, মাত্র চার বছর আগেও সৌদি ও কাতারের মধ্যে সম্পর্ক ছিল আদায় কাঁচকলায়। কিন্তু সে সব ভুলে দুই উপসাগরীয় প্রতিবেশীর কাছাকাছি আসার নেপথ্যে অবশ্য একাধিক কারণ রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হল প্যান ইসলামীয় মতবাদ এবং ইজ়রায়েলি ‘আগ্রাসন’।
২০১৭ সালে আরব দুনিয়ার চারটি দেশের সঙ্গে যাবতীয় কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে রিয়াধ। ফলে সৌদির সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, বাহরাইন, মিশর এবং কাতারের যোগাযোগটাও বন্ধ হয়ে যায়। ওই সময় আকাশ, স্থল এবং সমুদ্রবন্দর ব্যবহারে দোহার উপর নিষেধাজ্ঞা চাপায় সলমন সরকার। জ্বালানি সমৃদ্ধ আরব দেশটির রফতানি বাণিজ্যের উপর এর সরাসরি প্রভাব পড়েছিল। খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করতে লম্বা রাস্তার বিমান এবং সামুদ্রিক রাস্তা নিতে হয় কাতারকে।
সৌদির কড়া পদক্ষেপে দোহার রফতানি বাণিজ্যের খরচ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল। ফলে সমস্যা মিটিয়ে নিতে দ্রুত রিয়াধের সঙ্গে যোগাযোগ করে কাতার প্রশাসন। প্রতিবেশীকে বাগে পেয়ে ১৩ দফা দাবি পূরণের শর্ত দেন আরব যুবরাজ সলমন। বিশ্লেষকদের কথায়, যা ছিল প্রকৃতপক্ষে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের শামিল। স্বাভাবিক ভাবেই দোহা সেটা মেনে নেয়নি। ফলে সংশ্লিষ্ট নিষেধাজ্ঞাকে কেন্দ্র করে দু’তরফে চড়তে থাকে পারদ।
১৩ দফা শর্তের মধ্যে প্রথমেই ছিল কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল-জ়াজিরার কথা, যাকে সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ করার দাবি তোলে সৌদি প্রশাসন। পাশাপাশি, দোহাকে ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ নামের কট্টরপন্থী সুন্নি ইসলামী সংগঠনের সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করতে বলে রিয়াধ। সলমন সরকারের অভিযোগ, পশ্চিম এশিয়ার একাধিক দেশে ‘আরব বসন্ত’-এর নামে উগ্রপন্থী আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ ভাবে সমর্থন করছে তারা। পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদকেও মদত দিচ্ছে ওই সংগঠন।
১৯২৮ সালে মিশরে জন্ম হওয়া ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’কে নিয়ে পশ্চিম এশিয়ায় কম জটিলতা তৈরি হয়নি। বর্তমানে বেশ কিছু আরব এবং মুসলিম দেশে নিষিদ্ধ এই সংগঠন। সৌদির অভিযোগ, এ-হেন ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’কে লাগাতার আর্থিক সহায়তা জুগিয়ে যাচ্ছে কাতার। আর তাদের মতাদর্শ প্রচারের জন্য আল-জ়াজিরা গণমাধ্যমটিকে যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহার করছে দোহা। ফলে রিয়াধের সঙ্গে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ আরব দেশগুলির সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। আন্তর্জাতিক আঙিনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের ভাবমূর্তিও।
এ ছাড়া ২০১৭ সালে কাতারের বিরুদ্ধে পর্দার আড়ালে থেকে সিরিয়ার উগ্রপন্থী ইসলামীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠী আল-নুসরা ফ্রন্টকে সমর্থন এবং আর্থিক সাহায্য দেওয়ার মতো বিস্ফোরক অভিযোগ তোলে সৌদি সরকার। পাশাপাশি, রিয়াধের কট্টর ‘দুশমন’ শিয়া ধর্মাবলম্বী ইরানের সঙ্গে দোহার দহমর-মহরমকেও যথেষ্ট সন্দেহের চোখে দেখতেন যুবরাজ সলমন। আর তাই কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে প্রতিবেশীর উপর চাপ তৈরির চেষ্টা করেন তিনি। এতে কিছুটা সাফল্যও পায় ওই আরব মুলুক।
সৌদির চাপে ২০২০ সালের মধ্যে ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থগিত করে কাতার। পাশাপাশি আল-নুসরা ফ্রন্টকে আর্থিক সাহায্য দেওয়া বন্ধ করে দোহা। ফলে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে রিয়াধের মরু শহর আল-উলায় শীর্ষ সম্মেলনের মাধ্যমে সলমন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ককেও আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয় তারা। যদিও আল-জ়াজিরার উপর কাতারকে কোনও ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। দ্বিতীয়ত, এই সময়সীমার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ঘনিষ্ঠ ‘মিত্র’ হয়ে ওঠে দোহা।
সৌদি-কাতার কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হলেও একে অপরের প্রতি যে অটুট বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল, এমনটা নয়। কিন্তু এ বছরের সেপ্টেম্বরে দোহায় প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের গুপ্তঘাঁটিতে ইজ়রায়েলি বিমান হানার পর সম্পূর্ণ বদলে যায় পরিস্থিতি। ইহুদি বিমানবাহিনীর আক্রমণে প্রাণ হারান কমপক্ষে ছ’জন। কাতারকে বাদ দিয়ে ওই সময় একসঙ্গে আরও পাঁচটি দেশে ‘এয়ারস্ট্রাইক’ করে তেল আভিভ। সেই তালিকায় ছিল প্যালেস্টাইনের গাজ়া, লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন এবং উত্তর আফ্রিকার তিউনিশিয়ার নাম।
সৌদির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে টানাপড়েন চলাকালীন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করে কাতার। বর্তমানে পারস্য উপসাগরের কোলের দেশটির ‘আল-উদেইদ’ বিমানঘাঁটিতে রয়েছে পশ্চিম এশিয়ার বৃহত্তম মার্কিন সামরিক ছাউনি। তা সত্ত্বেও দোহায় ইহুদি বিমান হামলার পর স্বাভাবিক ভাবেই ওঠে একটি প্রশ্ন। আর সেটি হল, ইজ়রায়েলকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারিয়েছে আমেরিকা? না কি তেল আভিভের ‘এয়ারস্ট্রাইক’-এর নেপথ্যে প্রচ্ছন্ন মদত ছিল ওয়াশিংটনের? যদিও এই ইস্যুতে পরে বিবৃতি দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের যুক্তি ছিল, হামলার বিষয়টি জানার সঙ্গে সঙ্গেই তা দোহাকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু, নানা কারণে সেটা ঠেকানো সম্ভব হয়নি। ট্রাম্পের ওই বিবৃতিতে চিঁড়ে সে ভাবে ভেজেনি। তড়িঘড়ি রুশ সফর করেন কাতারের বিদেশমন্ত্রী। আরব দেশগুলির মধ্যে তত ক্ষণে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। প্রয়োজনে যে কোনও রাষ্ট্রে ঢুকে হামলা চালাবে ইজ়রায়েল। এ ব্যাপারে স্বার্থ বিঘ্নিত না হওয়ায় ইহুদিদের বারণ করা তো দূরে থাক, উল্টে আড়ালে থেকে তাদের প্রচ্ছন্ন মদত দেবে আমেরিকা।
গত সেপ্টেম্বরে দোহায় বিমানহানার ঘটনাকে ইজ়রায়েলি ‘আগ্রাসন’ আখ্যা দিয়ে তার কড়া নিন্দা করে সৌদি আরব। ওই সময় থেকেই রিয়াধের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে থাকে কাতার। বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করার মধ্যে দিয়ে ইসলামীয় দুনিয়ার ‘বেতাজ বাদশা’ হয়ে ওঠার স্বপ্নও রয়েছে যুবরাজ সলমনের। এত দিন সেখানে অন্যতম বড় বাধার নাম ছিল তেহরান। গত জুনে ১২ দিনের ইরান-ইজ়রায়েল ‘যুদ্ধে’ সেই সমস্যাও কেটে গিয়েছে বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞমহল।
জুনের লড়াইয়ে ইরানের একাধিক পরমাণুকেন্দ্রে ‘এয়ারস্ট্রাইক’ করে ইহুদি বিমানবাহিনী। সংঘাতের শেষ লগ্নে সেখানে ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমা ফেলে মার্কিন বায়ুসেনা। পাশাপাশি, বেছে বেছে তেহরানের আণবিক বিজ্ঞানী এবং শিয়া ফৌজের শীর্ষ কমান্ডারদের নিকেশ করে ইজ়রায়েলি গুপ্তচরবাহিনী মোসাদ। ফলে আপাতত সাবেক পারস্য দেশটি পরমাণু হাতিয়ার তৈরি করতে পারবে বলে মনে করছে না কেউই, যা ইসলামীয় দুনিয়ায় প্রভাব বৃদ্ধিতে যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছে বলা যেতে পারে।
ইরানের শক্তি হ্রাস হতে না হতেই পাকিস্তানের সঙ্গে ‘কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি’ সেরে ফেলে সৌদি আরব। সংশ্লিষ্ট সমঝোতায় বলা হয়েছে, এই দুইয়ের মধ্যে কোনও একটি দেশ তৃতীয় কোনও শক্তি দ্বারা আক্রান্ত বা আগ্রাসনের শিকার হলে, তাকে উভয় দেশের উপর আঘাত বা যুদ্ধ হিসাবে বিবেচনা করা হবে।
ইসলামাবাদের পর কাতারের সঙ্গে রেলপথ বিস্তারের চুক্তিকে তাই যুবরাজ সলমনের ‘মাস্টারস্ট্রোক’ হিসাবেই দেখছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশ। তবে এর উল্টো মতও রয়েছে। আগামী দিনে ‘ভারত মধ্য-প্রাচ্য ইউরোপ আর্থিক বারান্দা’ বা আইম্যাক (ইন্ডিয়া মিডল ইস্ট ইউরোপ ইকোনমিক করিডর) পরিকল্পনা করেছে জি-২০ সংগঠন। সৌদি আরবের উপর দিয়ে ইজ়রায়েল হয়ে সেই রাস্তা পৌঁছোবে ইটালিতে। ফলে দোহার সঙ্গে পরিকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের রাজনৈতিক মানে খোঁজা অর্থহীন, বলছেন বিশ্লেষকেরা।