খুব সুন্দর সময় শৈশবকাল!
কথাটা যেন শুধু একটা ‘ধারণা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান সামাজিক পরিকাঠামোয় ওই খুদে বয়সটা যে সমস্যা-জর্জরিত। খুন, আত্মহত্যা, প্রবঞ্চনা... হানা দিচ্ছে শিশু মনেও। কিন্তু তা বলে হাল ছেড়ে দিলে তো চলবে না। আপনার সন্তান এ দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক। সে যাতে বিপথে না যায়, তাকে নৈতিক শিক্ষা দেওয়া এবং শক্ত মাটিতে দাঁড় করানোর দায় কিন্তু আপনার। তার জন্য প্রয়োজন সবেধন নীলমণির সঙ্গে আপনার সুদৃঢ় বন্ধন। আত্মিক যোগাযোগ।
বাবা-মায়ের সঙ্গে তার আত্মজের মনের যোগাযোগের বেশ কয়েকটি ধাপ আছে। সন্তানের পূর্ণাঙ্গ মানসিক বিকাশের জন্য বাড়িতে ডিসিপ্লিন জরুরি, তার উপর বিশ্বাস রাখতে হয়। কখনও তাকে অনেকটা ছেড়ে দিতে হয়। সায়কায়াট্রিস্ট ডা. জয় রঞ্জন রামের মতে, বাচ্চাদের যে চেঞ্জিং ডেভলপমেন্টাল নিড রয়েছে, সেটা বাবা-মাকে অনুধাবন করতে হবে। আপনার পাঁচ বছরের ছোট্ট মিঠি কিংবা জিকোর সঙ্গে আপনি যেভাবে আচরণ করেন, সেটাই কিন্তু অজান্তে আপনাকে বলে দিচ্ছে, বড় হয়ে সে অন্যদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করবে। সম্পর্ক সম্বন্ধেও তাদের ধারণা তৈরি হয় এভাবেই। সন্তান লালন এবং পালন এই পুরো প্রক্রিয়াটি করতে হয় রীতিমত বুদ্ধি দিয়ে।
পেরেন্টিংয়ের অনেক ধরন আছে। এক-একজন এক-একভাবে সন্তানকে বড় করে তুলতে চান। এর মধ্যে যে ধারা সবচেয়ে বেশি সাফল্য পেয়েছে, সেটি অথরিটেটিভ পেরেন্টিং বা পজিটিভ পেরেন্টিং।
সন্তান যখন খুব ছোট, তখনই তাকে আপনাদের পরিবারের সাধারণ নিয়মনীতিগুলো বুঝিয়ে দিন। তাকে বলুন, বাড়িতে এই নিয়মগুলো আমরা মেনে চলি, তোমাকেও মানতে হবে। কখনও বলবেন না: এটা করবে না, ওটা করবে না। কেন ও এই নিয়ম মেনে চলবে, তা ওর কাছে ব্যাখ্যা করুন। সেটাও আলোচনার মধ্য দিয়ে। অথরিটেটিভ পেরেন্টিং শুরু করুন বাচ্চার ২ থেকে ৭ বছরের মধ্যে।
বাড়িতেও পজিটিভ পরিবেশ রাখাটা ভীষণ জরুরি। সব কিছুতে ওকে বাধা দেবেন না। পারস্পরিক সম্পর্ক (সেটা যার সঙ্গেই হোক) যত তিক্ত হোক, বাচ্চার সামনে সেটা যত কম প্রকাশ পায়, তত ভাল। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে একাত্মতা সন্তানের মানসিক গঠন দৃঢ় করবে। সন্তান ভুল করলে, প্রত্যেকে আলাদা করে না বকে, ওকে একসঙ্গে ওর ভুলটা বোঝান। এ ক্ষেত্রে বাচ্চাটি ইমোশনাল শেল্টার না পেয়ে বাধ্য হবে ভুল থেকে সরে আসতে।
ফোনের প্রতি বাচ্চাদের অদম্য আকর্ষণ রয়েছে। তাই গোড়া থেকে তাদের বোঝানো উচিত, অন্যান্য গ্যাজেটের মতো ফোনও খুব গুরুত্বপূর্ণ। টিভি বা ফ্রিজ নিয়ে যেমন সে খেলে না, তেমনই ফোনটাও খেলার বস্তু নয়। মা-বাবাই কিন্তু খেলার সামগ্রী হিসেবে ফোন হাতে তুলে দিচ্ছেন। পেরেন্টিংয়ে এই জায়গাগুলোয় ফাঁক থেকে যাচ্ছে, যা থেকে সরে আসা খুব দরকার। বাচ্চা যাতে খেলাধুলো করে, সে ব্যাপারেও কিন্তু মা কিংবা বাবাকেই উদ্যোগ নিতে হবে।
ওয়র্কিং পেরেন্টরা সন্তানকে কীভাবে সময় দেবেন, বর্তমান সময়ে এটা বড় প্রশ্ন। বিশেষ করে আইটি বা মিডিয়ায় যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা সন্তানকে খুব কম সময়ই দিতে পারেন। প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে অফিস থেকে ফিরে রাত ন’টায় বাচ্চাকে পড়াতে বসাচ্ছেন। যখন বাচ্চাটির পড়ার মুড নেই, সেটা তার ঘুমের সময়। তখন বাবা-মায়েরও মনে হচ্ছে, পড়াশোনাটা আজকাল খুব চাপের, যেটা আদৌ নয়। পেরেন্টিং কনসালটেন্ট পায়েল ঘোষের মত, ‘‘এ রকম ক্ষেত্রে বাচ্চাকে পড়ানোর জন্য বাড়িতে অন্য কেউ না থাকলে টিউটর রাখুন। সন্ধেবেলা তাকে পড়তে বসতে হবে, এই অভ্যেসটা ছোট থেকে না হলে সেটা কিন্তু বাচ্চাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনকে বিপর্যস্ত করবে।’’ সন্তানের সঙ্গে সব সময় ফোনে যোগাযোগ রাখুন। দেরি হলে তাকে চকোলেট বক্স গিফ্ট নয়, বলুন, আজ বাড়ি ফিরে তোমাকে একটা গল্প বলব বা তোমার সঙ্গে একটা খেলা খেলব। ফোনে ওকে বলুন, আপনি জ্যামে আটকে আছেন, এবার গাড়ি চলতে শুরু করল... মা এবং বাবাকে কতটা দৌড়ঝাঁপ করে বাড়ি ফিরতে হয়, সেটা তা হলে ওই ছোট্ট বিচ্ছুটিও কিছুটা বুঝবে।
সন্তানের মধ্যে ইমোশনাল ব্যালান্স ঠিক রাখাটা খুব দরকার। ছোট থেকে ও যেন আপনাদের ইতিবাচক মনোভাবের পরিচয় পায়। খারাপ নম্বর পেয়েছে বলে, বাচ্চাকে প্রচণ্ড বকুনি দিলে ও কিন্তু এর পর থেকে সেটা লুকোতে শুরু করে দেবে। তাই যতই খারাপ লাগুক, খুব শান্তভাবে মা বা বাবাকে পরিস্থিতি হ্যান্ডল করতে হবে। খারাপ নম্বর শুনলেই প্রচণ্ড রাগ হয়। তার পরই প্রশ্ন, বন্ধুরা কত পেল। সেটা না করে, আপনাদের দায়িত্ব হল, খারাপ নম্বরটা কেন হল সেটা জানা। তার পর পজিটিভ বুস্টআপ করে ভাল নম্বরের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তুলনা বা প্রতিযোগিতা খুবই হেলদি, কিন্তু সেই মাত্রাজ্ঞানটা আমাদের অনেক সময় থাকে না, তাই সেটা অতিরিক্ত হয়ে যায়। প্রত্যেক বাচ্চার কিছু স্ট্রং এবং কিছু দুর্বল দিক আছে। সব সময় চেষ্টা করুন, ও যাতে সেই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারে, তার জন্য ওর স্ট্রং পয়েন্টে ফোকাস করুন। এটা না হলে বাচ্চার সেলফ কনফিডেন্স নড়বড়ে হয়ে যাবে। ছোটখাটো ঘরোয়া কাজগুলো ওকে করতে দিন, তা হলে ওর আত্মবিশ্বাস বাড়বে এবং পড়াশোনায়ও এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। আপনার সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যই প্রয়োজন ওর সামনে অন্যকে অভিনন্দন জানানো। যখনই আপনার ছেলে বা মেয়ে প্রতিযোগিতায় হেরে গেল, সঙ্গে-সঙ্গে নিয়ে চলে এলেন, অন্যকে কনগ্র্যাচুলেট না করেই। করবেন না। সম্পর্কের খোলামেলা দিকটা ওর মধ্যে সঞ্চারিত করুন।
এর সঙ্গে এটাও মনে রাখা প্রয়োজন, পেরেন্টিং মানে শুধু ডিসিপ্লিন শেখানো নয়। গল্প করা, দুষ্টুমি করা, শাসন, আদর... সব মিলিয়ে বাচ্চাকে বড় করে তোলা। যতটা স্বচ্ছভাবে এবং সততার সঙ্গে আপনি আপনার ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে পারবেন, সন্তানের জন্য ততই ভাল। হয়তো আপনি রেগে গিয়ে কখনও খুব খারাপ আচরণ করে ফেলেছেন। তা হলে সেটা স্বীকার করার মতো স্পেস যেন আপনাদের সম্পর্কে থাকে। মা-বাবা যদি সন্তানের প্রতি খুব কঠোর হন, তা হলে তার আচরণও তেমন হবে। যদি আপনি তার সব আবদার মেনে নেন, তা হলে সেও বুঝবে, কাউকে তুষ্ট রাখার উপায় হল, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা। এটাও অবশ্যই আপনাদের মাথায় রেখে চলা উচিত।
সন্তানকে বড় করার ক্ষেত্রে অনেকেই প্রাধান্য দেন তার সঙ্গে বাবা-মায়ের বন্ধুর মতো আচরণকে। তবে ডা. জয় রঞ্জন রাম মনে করেন, ‘‘সন্তানের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশবেন, আমি এর সঙ্গে সহমত নই। বন্ধু বন্ধুই এবং বাবা-মা, বাবা-মা’ই। তাঁরা কখনওই বন্ধুর জায়গাটা নিতে চেষ্টা করবেন না। বন্ধুর মতো করে মেশার মধ্য দিয়ে অনেকেই বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, বাচ্চার মনের পরিকাঠামোটা বুঝে, তার সঙ্গে মেশার চেষ্টা করি। আমার মতে, বাবা-মা যদি এটা ধারণা করেন, তাঁরা বাচ্চার বন্ধু হবেন, তা হলে সেটা ভুল। বাবা-মােয়র অনেক কিছু শেখানোর রয়েছে। সন্তানের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করতে পারেন, কিন্তু বন্ধু হতে পারেন না। বন্ধুর মতো মিশতে গিয়ে বাবা-মা অনেক সময়ই ডিসিপ্লিন, ফার্মনেস, অথরিটি এই ব্যাপারগুলো মাথায় রাখেন না। আলটিমেটলি বাচ্চাদের একটা বাউন্ডারি দরকার। এমন কিছু জিনিস আছে, যেগুলো করার অনুমতি পেরেন্টরা কখনওই দেবেন না, কিন্তু বন্ধুরা সেটা কখনওই বারণ করবে না।’’
পরিশেষে বলব, একটি শিশুকে কখনওই তার বয়সের হিসেবে নয়, একজন ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করুন। তাকে কোনও ব্যাপারে ভুল বোঝাবেন না। উচ্চারণে ভুল থাকলে, তা উপভোগ করাও ঠিক নয়। যখনই আপনি তাকে একজন ইনডিভিজুয়াল হিসেবে মানবেন, সেও কিন্তু খুব ছোট থেকেই আত্মবিশ্বাসী হবে এবং পরবর্তী সময় নিজের সুদৃঢ় ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলতে পারবে।
তথ্য সহায়তা: সায়কায়াট্রিস্ট ডা. জয় রঞ্জন রাম ও পেরেন্টিং কনসালটেন্ট পায়েল ঘোষ
মডেল: তিয়াসা পাল, আরশি দে, মেকআপ: রূপাঞ্জনা ভট্টাচার্য, ছবি: নীলোৎপল দাস