উড়ছে হৃদয় উদয়পুরে

রূপে সে রাজস্থানের কাশ্মীর। তার ভাণ্ডারে হ্রদ, গোলকধাঁধা প্রাসাদ, সুগন্ধি বাগ। সারা পৃথিবী এখানে আসে স্বপ্নবিয়ে সাজাতে, মধুচন্দ্রিমা কাটাতে আর সিনেমা বানাতেরূপে সে রাজস্থানের কাশ্মীর। তার ভাণ্ডারে হ্রদ, গোলকধাঁধা প্রাসাদ, সুগন্ধি বাগ। সারা পৃথিবী এখানে আসে স্বপ্নবিয়ে সাজাতে, মধুচন্দ্রিমা কাটাতে আর সিনেমা বানাতে

Advertisement

চিরশ্রী মজুমদার

শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০
Share:

সিটি প্যালেস।

অগস্টের শেষাশেষি। পুজোর বাজনা কাছাকাছি এগিয়ে আসছে। তখনই আমার আর্কিটেক্ট স্বামী জানালেন, এক অ্যাসাইনমেন্টে তাঁকে যেতে হবে উদয়পুর। স্থপতি মশাই ঝটিকা সফরে চললেন রাজকাহিনির দেশে। তাঁর ঘোড়ায়, থুড়ি প্লেনে চড়ে বসলাম আমিও।

Advertisement

আমদাবাদ এয়ারপোর্ট থেকে বেরোলেই চওড়া বুকের চার লেনের হাইওয়ে। রাজস্থানের দিকে গাড়ি এগোচ্ছে, সূর্য পশ্চিমে হেলছে, বদলাচ্ছে আশপাশ। রুখা গ্রাম্য ভাব। দিগন্তে আবছা আরাবল্লি।

তারই গায়ে ভেসে উদয়পুর। ভারতের ভেনিস। মুঘল জমানায় পিছোলা হ্রদের ধারে শহর বসান রানা প্রতাপের বাবা মেবার অধিপতি উদয় সিংহ। তার পর রাজার পর রাজা এসে, কত সায়র কাটলেন। শত্রু রুখতে উদয় সিংহ প্রাচীর দিয়ে ঘিরেছিলেন শহর। সেই পাঁচিল থেকে বেরিয়েছে ক’খানা পোল কাম সিংহদরওয়াজা। হাতিপোল দিয়ে ঢুকলাম শহরে।

Advertisement

সকালে হাঁটতে গিয়েই হাঁফিয়ে উঠলাম। কী উঁচুনিচু! সফরসঙ্গী বরের বন্ধু বললেন, ‘‘পাহাড় কেটে তৈরি শহর।’’ বেলা বাড়লেই রোদের ছ্যাঁকা, মিউজিয়ামের রাস্তায় জুতো ফুঁড়েই পায়ের তলাটা যেন পুড়ে গেল। জাদুঘরের আলোছায়া জানালা, তিলক কাটা তালা দেওয়া দরজা দেখতে-দেখতে দরবারঘরে পৌঁছলাম। কিংখাবের আসনে রাজা-রানি, মন্ত্রী-কোটাল, সিপাই-সান্ত্রি। সব পুতুল। একটা ছেলে তাদের সুতো ধরে নাচিয়ে পাপেট শো দেখায়। ছোকরা বেশি দেখাচ্ছিল পিয়ারি পরি-রানির নাচ। হিট গানও বাজাল। ‘মোরনি... বাগা-মা বোলে আধি রাত মা...’

মনসুন প্যালেস

বাইরে বেরিয়ে দেখি দুপুরে আধি রাতই বটে। বৃষ্টি। ঘন কালো মেঘ। স্পিডবোটে চেপে নেমে পড়লাম লেক পিছোলা-র জলে। বোট জলে সাগরের ঢেউ তুলে, পৌঁছে দিল হ্রদের মধ্যিখানে লেক প্যালেসে। মহারানা দ্বিতীয় জগৎ সিংহের এই সামার প্যালেস আজ এক সাততারা। বিশ্বের তাবড় তাবড় মানুষ এখানে আসেন বিয়ে করতে। জেমস বন্ডের বিখ্যাত সিনেমা ‘অক্টোপুসি’-র শ্যুটিং হয় এখানে। আর এই হোটেলে, এই শহরের প্রাসাদে বাগানে বলিউড যে কত বার এসেছে ইয়ত্তা নেই। সুনীল দত্তের গা ছমছমে ‘মেরা সায়া’ থেকে হৃতিক রোশনের ‘ইয়াদেঁ’ হয়ে রণবীর-দীপিকার যৌবন-ঝলমল ‘ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’। আর? রং আর রক্তে চুপচুপে ‘রাম-লীলা’! পিছনে দেখা যায় জগমন্দির প্যালেস। সেখানে বসেছিল রবিনা টন্ডন আর অনিল থাডানির বিয়ের আসর।

জগদীশ মন্দির

হ্রদের পাড়ে শিশোদিয়া বংশের গৌরব সিটি প্যালেস। এলাহি কাণ্ড। বাড়ির ভিতর বাড়ি। তার ভিতর ঘর। তার দরজার পিছনে বেঁটে-সুড়ঙ্গ দিয়ে আর এক মহলে পৌঁছে যাওয়া। দুশমন-ডাকুকে বুদ্ধু বানাতেই এ সব গোলকধাঁধা। আছে বীর প্রতাপের বর্ম-তরোয়াল। তাঁর লোহার যুদ্ধকবচ দৈর্ঘ্যে নিশ্চিত সাত ফুটের উপর। তরোয়ালের ওজন নাকি ২৫ কেজি। ঢাল ৮০ কিলোগ্রাম! আমরা হতবাক।

এমনধারা শক্তির রহস্য ফাঁস হল রাজস্থানি খাবার চাখতে গিয়ে। যোদ্ধাদের প্রিয় ডাল-বাটি-চুরমা। আটার ডেলায় উটের দুধ আর ঘি মেশালে যে উপাদেয় মণ্ড তৈরি হয়, তাই হল বাটি। সঙ্গী পাঁচমেল ডালে ডুবোলে তার যে তুলতুলে সোয়াদ হয়, জিভে তার রেশ থাকতে থাকতেই ঢালো এক চামচ ঝুরঝুরে চুরমা। শেষমেশ বড় গেলাসে ছাঁচ। মনে হবে, এই মেঠো স্বাদ রক্তে মিশলে আকবরের হাতির সঙ্গে টক্কর দেওয়াও বিচিত্র নয়!

বিকেলে জিপ জংলি পাহাড়ি রাস্তায় কসরত করে পৌঁছে দিল একেবারে চূড়ায়। রাজাদের মনসুন প্যালেস। সজ্জনগড় ফোর্ট। ফতেহ সাগর লেকের মাথায় মেঘ দেখতে তাঁরা এখানে আসতেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রাসাদের গল্প শুনছিলাম। ফিরতে গিয়ে অবাক! সামনে দেওয়ালে ঠিক এই ঝুলবারান্দাটাই আঁকা। সেখানে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে ময়ূরনাচ দেখছে। তাকে অনেকখানিই সেই জাদুঘরের পাপেট-রানির মতো দেখতে না?

সহেলিয়োঁ কী বাড়ি

এলাম সহেলিয়োঁ কী বাড়ি। এই ঝরনা-বাগেই নব্বইয়ে আমির-জুহি ফোয়ারার ধারে গেয়েছিলেন, ‘ঘুংঘট কি আড় সে দিলবরকা’! আঠেরো শতকে রানা সংগ্রাম সিংহ রানি আর তাঁর সহচরীদের নিভৃত জলকেলির জন্য বানিয়ে দিয়েছিলেন মর্মরপাথরের এই আজব স্নানঘর। এমন কৌশল, বাইরে থেকে কেউ অন্তঃপুরচারিণীদের না পাবে দেখতে, না পাবে তাঁদের খিলখিল শুনতে। পাথুরে ঘোমটার আড়ালে থাকবে মেবারনন্দিনীদের সৌন্দর্য। যব তক না মিলে নজরোঁ সে নজর!

এ বার চিতোর যাওয়ার পালা। গাড়িতে উঠতেই গান চলল। প্রাসাদ নগরী ছাড়লেও আমার পিছু নিয়ে চলল বৃষ্টির ধারা আর সেই মায়া-সংগীত, লাজ কে মারে, হো গয়ি পানি পানি.... মোরনি... বাগা মা বোলে আধি রাত মা।

আমি তখনই চমকে উঠলাম, যা! উদয়পুরের জাদুঘরে সেই অসূর্যম্পশ্যা নাচনি-পরি পুতুলের মধ্যেই যে রয়ে গেল সে! আমার মনের আত্মা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন