শনিবারের নিবন্ধ ২...

একা এবং কয়েকজন

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন যেন বাড়ির দাদা। বিমল মিত্র কি অপছন্দ করতেন তারাশঙ্করকে? পুরনো আড্ডার বারো ঘর, তেরো উঠোনের মৌতাতে সমরেশ মজুমদার।নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন যেন বাড়ির দাদা। বিমল মিত্র কি অপছন্দ করতেন তারাশঙ্করকে? পুরনো আড্ডার বারো ঘর, তেরো উঠোনের মৌতাতে সমরেশ মজুমদার।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৪ ১৫:৩৭
Share:

মধ্যমণি রমাপদ চৌধুরী (বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয়)।

বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়ছি তখন তিন জন মাস্টারমশাই আমাদের চোখে প্রায় নায়ক ছিলেন। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রমথনাথ বিশী এবং শংকরীপ্রসাদ বসু। শঙ্করীবাবু পড়াতেন বৈষ্ণব পদাবলী, আবার আনন্দবাজারে একের পর এক ক্রিকেট নিয়ে লিখে যাচ্ছিলেন। আমাদের সঙ্গে একটু দূরত্ব রাখতেন। প্রমথনাথ ছিলেন আপাত গম্ভীর, কিন্তু ক্লাসে পড়ানোর সময় সেই ছদ্মবেশ সরে যেত। নারায়ণবাবু ছিলেন আমাদের কাছের মানুষ, নিজেকে ওঁর ভাই ভাবতে ভাল লাগত।

Advertisement

এক বিকেলে কফিহাউসে একটা বিষয়ে তর্ক হচ্ছিল বন্ধুদের সঙ্গে। কেউ একমত হচ্ছিলাম না। শেষে শংকর বলল, ‘চল, নারায়ণবাবুর কাছে যাই, উনি যা বলবেন তা মেনে নেব।’ তখন বিকেল। ক্লাস ছুটি হয়ে গেছে অনেক ক্ষণ, নারায়ণবাবুকে পেতে হলে বৈঠকখানা রোডে যেতে হবে। শংকর বলল, ‘কলেজ স্ট্রিটের একটি প্রকাশনীতে বিকেলবেলায় সাহিত্যিকরা আড্ডা মারতে আসেন। সেখানে নিশ্চয়ই নারায়ণবাবুকে পাওয়া যাবে।’ খবরটা জানা ছিল না। তাই জানতে চাইলাম, ‘তুই জানিস কারা কারা আড্ডায় আসেন?’ শংকর নামগুলো বলেছিল, ‘সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, তারাশংকর, বিমল মিত্র, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রমথনাথ বিশী, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, গজেন্দ্রকুমার মিত্র ইত্যাদি ইত্যাদি।’

আমাদের চোখ কপালে উঠল। ওঁরা সবাই একসঙ্গে হন? অতএব চলে গেলাম। সরু প্যাসেজের শেষে একটি ঘর থেকে ওঁদের গলা ভেসে আসছিল। আমরা তখন কুড়ি বা একুশ। আমাদের দেখে ওঁরা যদি রেগে যান। প্যাসেজে দাঁড়িয়ে সাহস খুঁজছিলাম। সামনে দিয়ে মুড়ি তেলেভাজা নিয়ে একজন কর্মচারী ঘরের ভেতরে চলে গেল। হঠাৎ একটি গলা কানে এল, ‘জাপানের গেইশারা খুব যত্ন করে।’ সঙ্গে সঙ্গে প্রমথনাথ বিশীর গলা শুনতে পেলাম, ‘তা হলে একবার জাপানে যেতে হবে।’অন্য একটি কণ্ঠ শুনলাম, ‘না হে প্রমথ, এভরি ফোর্থ গেইশার অসুখ আছে। প্রমথনাথ বললেন, ‘ঠিক আছে আমি থার্ডের পর ফিফ্থকে মিট করব।’ সঙ্গে সঙ্গে তুমুল হাসির আওয়াজ ভেসে এল ঘর থেকে। আমরা তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। বড়দের এই আড্ডায় আমরা যে অবাঞ্ছিত তা বুঝতে দেরি হয়নি। পরে জেনেছি গেইশাদের প্রশংসা করেছিলেন শ্রদ্ধেয় ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। আর সতর্ক করেছিলেন সাংবাদিক ভূপেন রায় মশাই।

Advertisement

হ্যাঁ, সাহিত্যিকরা তখন গল্প করতে একত্রিত হতেন। কফিহাউসে আসতেন তরুণ এবং যুবক লেখকরা। আমরা তখন সাহিত্যের হাওয়া গায়ে লাগাবার চেষ্টা করছি। একটু আধটু লেখা ছাপা হচ্ছে। কিন্তু কফি হাউসের দোতলার একটা কোনা আমাদের দখলে।

শংকর দে আমাদের সহপাঠী, কবিতা লিখত, দুপুর থেকে জায়গা দখল করে বসে থাকত। মাঝেমাঝেই বলত, ‘আজ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতাটা লিখে ফেললাম।’ আসলে আমরা তখন যাই লিখি, ভাবতাম দারুণ লিখেছি।

সামনে হলঘরের মাঝখানে লিটল ম্যাগের ছেলেমেয়েদের টেবিল। কাগজ ঘিরে তাদের কত স্বপ্ন। আর এক কোণে হাংরি জেনারেশনের দল খুব গম্ভীর মুখে বসে। সাহিত্য নিয়ে তারা যা ভাবত তাই বলত।

আমাদের ডান দিকের কোণে নির্মাল্য আচার্যর টেবিলে সিরিয়াস লেখকদের জমায়েত। মাঝেমাঝে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আসতেন, যিনি ‘এক্ষণ’-এর সম্পাদকও ছিলেন। নির্মাল্যদা তো ওই টেবিলটাকেই তাঁর সম্পাদকীয় দফতর বানিয়ে ফেলেছিলেন। দুপুর থেকে ওই টেবিলে বসে লেখা সম্পাদনা করতেন, প্রুফ দেখতেন, বিকেল হলে সহযোগীরা এলে সামনের সংখ্যা নিয়ে আলোচনা করতেন।

‘দেশিকোত্তম’ পাওয়ার পর সাগরময় ঘোষকে ঘিরে ‘বুধসন্ধ্যা’

একদিন শংকর দে অভিনব খবর দিল। অনেকগুলো ছোট ছোট বালিশ নিয়ে বিছানায় না শুলে নাকি ভাল কবিতা লেখা যায় না। শুরু হয়ে গেল তর্ক। বালিশের সঙ্গে কবিতার কী সম্পর্ক? শংকর মনে করিয়ে দিয়েছিল বালিশটাকে খুব ছোট হতে হবে। শক্তি চট্টোপাধ্যায় নাকি ওই রকম বালিশ নিয়ে রাতে ঘুমান। এটা সে জানতে পেরেছে। সন্ধের মুখে সুনীলদা, শক্তিদা, সন্দীপনদারা এলেন। তাঁদের চেয়ার টেবিলের অভাব হত না। আমাদের একজন গিয়ে শক্তিদাকে জিজ্ঞাসা করেছিল। সুনীলদা হো হো করে হেসে বললেন, ‘তাহলে তো পেটে বাংলা না পড়লে অথবা খালাসিটোলায় না গেলে কবি হওয়া যাবে না!’ জানি না, এর পরেও শংকর ছোট বালিশ বানিয়েছিল কিনা।

• কয়েকটা গল্প দেশে ছাপা হওয়ার পর এক বিকেলে আনন্দবাজার থেকে বেরনোর সময় দেখলাম কয়েক জন তরুণ ও মধ্যবয়সি লেখককে নিয়ে বিমল কর বের হচ্ছেন। এর আগে ওঁদের আনন্দবাজার থেকে হেঁটে কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের মধ্যে বসন্ত কেবিনে গিয়ে গল্প করতে দেখেছি। বয়স বাড়ার পরে বিমলদা অতটা না উঠে কাছেই কার্জন পার্কে আড্ডা মারেন। আমি ওঁদের সঙ্গ নিতেই আড়চোখে দেখে বিমলদা শিশির লাহিড়িকে চাপা গলায় বললেন, ‘ওকে কাটা।’

শিশির লাহিড়ি তখন গল্প লেখক হিসেবে বেশ পরিচিত নাম। বিমল করের বন্ধু। পিছিয়ে এসে আমার পাশে হাঁটতে হাঁটতে শিশিরদা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার কোনও বান্ধবী নেই?’

‘কেন?’

‘তুমি তো যুবক। এখন এই শেষ বিকেলে তার সঙ্গে তো সময় কাটানো উচিত।’

‘কেউ নেই। তাছাড়া আপনাদের সঙ্গে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে।’

শিশিরদা পা চালিয়ে বিমলদার কাছে গিয়ে বললেন, ‘না রে কাটানো যাবে না। চায়ের পেটি মাথায় করে বাংলা সাহিত্যে ঢুকেছে। বিক্রি না করে ছাড়বে না।’

আমি আড্ডার একজন হয়ে গেলাম। প্রথমে কে সি দাশের চায়ের দোকানে বসে চা খাওয়া হত। বেশির ভাগ দিন বিমলদাই দাম দিতেন। আসতেন বরেন গঙ্গোপাধ্যায়, সুধাংশু ঘোষ, সত্যেন্দ্র আচার্য, প্রলয় সেন, অভ্র রায়, সুব্রত সেনগুপ্ত, রমানাথ রায়, শেখর বসু, কণা বসু মিশ্ররা। ওখান থেকে বেরিয়ে কার্জন পার্কে ঘাসের উপর বসা হত। কে কেমন লিখছে, কোন বিদেশি বই পড়ে দারুণ লেগেছে থেকে পেছনে লাগাও বাদ যেত না।

বিমলদা এক মাঝারি মানের লেখকের উপর খেপে গেলেন একদিন। ঘটনাটি আগেও একটি লেখায় উল্লেখ করেছি। তবু যাঁদের নজর পড়েনি তাঁদের জন্য না বললেই নয়।

লেখক গল্প জমা দিয়েছিলেন। তাতে নায়ক তার কাকিমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেছেন সেই গল্পে। গল্পটি ফেরত দিয়েছিলেন বিমলদা, ‘এ রকম গল্প কুরুচিকর।’

পরের দিন সেই লেখক আবার গল্প জমা দিলেন। নাম ধাম সব এক ছিল শুধু কাকিমার বদলে বৌদি করে এনেছেন। তাঁর যুক্তি রবীন্দ্রনাথ তো ‘নষ্টনীড়’ লিখেছিলেন। সেই সময় শারীরিক সম্পর্ক হলেও তো হতে পারত। বিমলদা খুব রেগে গিয়ে বলেছিলেন, ‘একে আমি কী বোঝাবো? আগে নষ্টনীড়ের মতো গল্প লিখতে শেখো। তারপর... দূর কী বলব।’ সেই লেখক মাথা নিচু করে আমার পাশে বসেছিলেন। পরে হতাশ গলায় তিনি বলেছিলেন, ‘বিপদে পড়ে গেলাম ভাই।’

‘কী রকম?’ জিজ্ঞাসা করেছিলাম।

‘আরে ভাই, যখনই নতুন গল্প লিখে বাড়ি থেকে নিয়ে বের হই তখন আমার স্ত্রী একটা খাতায় নোট রাখে। গল্পের নাম, কোন কাগজ ইত্যাদি। ছাপা হলে লেখেন কবে ছাপা হল। তারপর টাকা এলে সেটাও পাশে এন্ট্রি করে। স্ত্রী এই গল্পও এন্ট্রি করে রেখেছিল। ছাপা না হলে টাকা যাবে না। তখন কী জবাব দেব!’

শোনার পর মনে হয়েছিল, ভদ্রলোক এত কাল দেশ-আনন্দবাজারে লিখে যেটুকু পরিচিতি পেয়েছেন সেটা না পেলেই ভাল হত।

কার্জন পার্কের আড্ডায় আসা কোনও নবীন লেখক দেশ-আনন্দবাজারের পুজো সংখ্যায় প্রথম উপন্যাস লেখার আমন্ত্রণ পেয়ে বেশ সলজ্জ ভঙ্গিতে বিমলদাকে জানাতেন। অনেক আগেই তথ্য জানা থাকা সত্ত্বেও বিমলদা বলতেন, ‘বাঃ, লিখে ফ্যালো।’

‘কিন্তু কী নিয়ে লিখব ভেবে পাচ্ছি না।’ নবীন লেখক বলেছিলেন।

শিশির লাহিড়ি বললেন, ‘তাহলে লিখো না। কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দাও লিখতে পারবে না।’

ঘাবড়ে গেলেন নবীন লেখক, ‘সেকি?’

‘দ্যাখো ভাই, গর্ভধারণ না করে কোনও মেয়ে সন্তানের জন্ম দিয়ে মা হয়েছেন? আর পেটে সন্তান এলে সে আপনি বড় হবে, পূর্ণতা পেতে পৃথিবীতে আসতে চাইবে। ন্যাকামি! কী লিখব ভেবে পাচ্ছি না।’ শিশিরদা বিরক্ত।

আড্ডার তরুণদের নিয়ে বিমলদা একটা বই লিখেছিলেন। বড় সুন্দর বিশ্লেষণ। পরের দিকে একটি লিটল ম্যাগাজিন। যা অন্যদের থেকে আলাদা করার চেষ্টা করেছিলেন।

শীর্ষেন্দুদা মাঝে মাঝে আড্ডায় আসতেন। আসতেন ওঁর গুরুভাই দরবারীর সম্পাদক কল্যাণ চক্রবর্তী। স্বীকার করছি জীবনের প্রথম দিকে ওই একবারই নিয়মিত সাহিত্যিকদের আড্ডায় গিয়েছি, উপকৃত হয়েছি এবং সেই শেষ। বিমলদার অবসর নেওয়ার পর আড্ডা উঠে গিয়েছিল।

বিমল মিত্র

দেশপ্রিয় পার্কের গায়ে রাসবিহারী-ল্যান্সডাউনের মোড়ে একটা চিলতে রেস্টুরেন্ট, যার নাম সুতৃপ্তি, এখনও রয়েছে। এই সুতৃপ্তি-তে রবিবারের সকালে একটা চমৎকার আড্ডায় জমায়েত হতেন দক্ষিণ কলকাতায় থাকা লেখকরা। শংকর চট্টোপাধ্যায়, বরেন গঙ্গোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্র আচার্য, প্রলয় সেনরা সেখানে চায়ের কাপে তুফান তুলতেন। একদিন গিয়েছিলাম। কেউ কিছু লিখতে পারছে না, অমুক মাল লিখছে, ওর হাত থেকে কলম কেড়ে নেওয়া উচিত, এ রকম টগবগে কথাগুলো প্রমাণ করে ওঁরা যুবক ছিলেন।

নাটককে সাহিত্যের একটা শাখা বলা হয়, যদিও তার পাঠক খুব কম। কিন্তু নাটকের নাট্যকার পরিচালকদের আড্ডা বসত শ্যামবাজারের মোড়ে পবিত্র পাঞ্জাবি রেস্টুরেন্টে। সে সময় আনন্দবাজারের নাটক যাত্রার পাতা দেখতেন একসময়ের খুব সাড়াজাগানো গল্পকার প্রবোধবন্ধু অধিকারী। উত্তরবাংলার মানুষ বলে আমাদের সুসম্পর্ক ছিল। রাত ন’টায় প্রবোধদার সঙ্গে ওখানে গিয়েছি। আশেপাশের রিহার্সাল রুম থেকে রিহার্সাল সেরে গ্রুপ থিয়েটারের পরিচালকরা আড্ডায় আসতেন। নাটক নিয়ে আলোচনা হত। বিভাস চক্রবর্তী, অশোক মুখোপাধ্যায়দের সঙ্গে ওখানেই পরিচিত হই। বার দুয়েক যাওয়ার স্মৃতি আজ স্পষ্ট নয়। তবে শেষ বাস ধরে বাড়ি ফেরার উত্তেজনায় সবাই আক্রান্ত হতেন, মনে আছে।

এর পরে আড্ডা হয়েছে আরও তরুণদের মধ্যে। রাধানাথ মণ্ডলদের গল্পচক্রের আড্ডার কথা শুনেছি, যাওয়া হয়নি। তত দিনে আমার কিছু উপন্যাস বেরিয়ে গিয়েছিল শুনে, নতুন লেখক না হওয়ার কারণে ওরা ডাকত না। ক্রমশ সিনিয়র লেখকরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন। এই সময় সুনীলদা ‘বুধসন্ধ্যা’ করলেন।

বুধসন্ধ্যা-কে লেখকদের আড্ডা বলা যায় না। যদিও সমরেশ বসু, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, দিব্যেন্দু পালিতের সঙ্গে সাগরময় ঘোষ বুধসন্ধ্যা-য় সক্রিয় সদস্য হিসেবে সুনীলদার সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। কিন্তু এঁদের বাৎসরিক অনুষ্ঠান ছিল নাটক করা। সুনীলদার লেখা। মাঝেমধ্যে গল্প পড়া। তবু সাহিত্যের আড্ডা বলা ঠিক হবে না।

• আড্ডায় একত্রিত না হই, আমাদের মধ্যে ঈর্ষা বা অভিমানের রেষারেষি বোধ হয় দেখা যায় না। প্রফুল্লদা বা অতীনদার সঙ্গে এক বছর পরে দেখা হলেও আমরা এমন ভাবে কথা বলি যে মনে হবে, গতকালও বলেছি। শীর্ষেন্দুদাই একমাত্র মানুষ যিনি আমাকে ডাকনামে ডাকেন। দশ মাস বাদে হঠাৎ ফোন করেন, শুরু করেন ডাকনাম উচ্চারণ করে।

কিন্তু আমাদের আগে, শীর্ষেন্দুদা, সুনীলদাদেরও আগে যাঁরা বিখ্যাত লেখক ছিলেন, তাঁদের সম্পর্ক কেমন ছিল? একটা ঘটনা বলি।

গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনের একটি সাহিত্য সভায় শ্রদ্ধেয় বিমল মিত্রের পাশে বসে আছি। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি আপনার লেখা পড়েছি, আপনি আমার লেখা কি পড়েছেন?’

‘প্রথম কথা আপনি আমাকে তুই বলুন। আর আপনার লেখা পড়েনি, এমন শিক্ষিত বাঙালি আছেন বলে আমার মনে হয় না।’ সবিনয়ে বললাম।

‘হুঁ, তারাশঙ্করের লেখা পড়েছেন?’

‘অবশ্যই।’

‘কাকে আপনার বড় লেখক বলে মনে হয়?’

আমি ফাঁপরে পড়লাম। বুঝতে পারছিলাম সত্যি কথা বললে উনি খুব দুঃখ পাবেন। কিন্তু এ রকম প্রশ্ন সুনীলদা-শীর্ষেন্দুদা কখনও করতেন না।

উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলেন বৃদ্ধ বিমল মিত্র। বললেন, ‘শুনুন। এক শনিবারে কলেজ স্ট্রিটের এক প্রকাশকের কাছে গিয়েছি। বেলা সাড়ে বারোটায় কাজ শেষ হলে ট্যাক্সি ধরে চেতলার বাড়িতে ফিরব, তো প্রকাশক আমায় বললেন, তিনিই তাঁর গাড়িতে আমায় পৌঁছে দেবেন। শুধু যাওয়ার আগে পাঁচ মিনিটের জন্য পাকপাড়ায় যাবেন। রাজি হলাম। যাচ্ছি, হঠাৎ দেখি টালা পার্কে গাড়ি ঢুকছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কার কাছে যাচ্ছেন?’

সে বলল, ‘দাদা, আজ তারাশঙ্করের জন্মদিন। একটু মিষ্টি দিয়ে প্রণাম করে আসি।’

আমি নামলাম না। দেখতে পেলাম ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে। গেট হয়েছে। দেখে পিত্তি জ্বলে গেল! এই বয়েসে বাড়ি সাজিয়ে জন্মদিন করছে? তা প্রকাশকের মুখে খবর পেয়ে তিনি খালি গায়ে ধুতি পরে ছুটে এসে বারংবার নামতে বললেন।

আমি বললাম, ‘না, সময় নেই। বাড়ি গিয়ে লিখতে হবে।’ তা হঠাৎ কী বলল জানো? বলল, ‘আপনি তো চলে যাওয়া দিন নিয়ে লেখেন। বেশি ভাবতে হয় না। আজকের মানুষ নিয়ে লিখলে ভাবতে হত।’

খুব অপমানিত বোধ করলাম। ঠিক করলাম উচিত জবাব দেব। বাড়িতে ফিরেই লিখতে বসলাম। সমকালীন মানুষের জীবন নিয়ে, কড়ি দিয়ে কিনলাম। পড়েছেন?’

মজা লাগছিল। বার্ধক্য মানুষের দ্বিতীয় শৈশব। খুব সত্যি কথাটা।

এখন আমরা, লেখকরা সবাই একা। আমরা আর কয়েকজনে নেই।

আড্ডা-টাড্ডা

নবনীতা দেব সেন

চোদ্দো বছর ধরে শুধু মেয়েদের নিয়ে ‘সই’-এর আড্ডা চালাচ্ছি। হই হই করেই চলছে। মাসে এক বার। গল্প, খাওয়া, জন্মদিন পালন, বই মেলা সবই করি। প্রায় ২৫ জন মিলে। অনেকেই আসেন। সবাই লেখিকা...! এবার তো সই-এর জন্মদিন উপলক্ষে দু’জনকে পুরস্কারও দেওয়া হল।

রামকুমার মুখোপাধ্যায়

’৭০-এর দশকের শেষাশেষি ‘পরিচয়’-এর আড্ডায় যেতাম। হ্যারিসন রোডে। গ্রেস সিনেমার দোতলায়। ’৮০ দশকের মাঝামাঝি একটি পাক্ষিক পত্রিকার অফিসে আড্ডা বসত আমাদের। ধর্মতলার মোড়ে। কটেজ ইন্ডাস্ট্রি-র উপরে। এখন সেভাবে এ ধরনের আড্ডা দেওয়া হয় না। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে ঘন ঘন যাতায়াতের ফলে ওখানে বহু জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বহু রাত অবধি আড্ডা দিয়েছি। আমার ‘কথার কথা’ উপন্যাস তার ভিত্তিতেই লেখা। অসম, মণিপুর, ত্রিপুরার এই সব রাত আমার আড্ডার পূর্ব অভিজ্ঞতাকে ম্লান করে দিয়েছে। বংচের, ককবরক, চাকমাদের মেজাজ, ঢং, রং, স্বাদ এতটাই আলাদা জীবনের অনেক কিছুই যেন এলোমেলো হয়ে যায়।

বাণী বসু

নিয়মিত আড্ডায় যাওয়া আমার কোনও কালেই হয়নি। আসলে বহু দিন থেকেই আমার পারিবারিক দায়টা এত বেশি, সময়ও হয় না। তবে দু-একবার আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছি। মনে আছে, শিবপুরের একটা ক্লাব একবার বটানিক্যাল গার্ডেনসের ভেতরে আড্ডা বসালো। গঙ্গার ধারে। আমার কিন্তু বেশ লেগেছিল।

শ্রীজাত

প্রতি রোববার সকালে সুনীল দা’র (গঙ্গোপাধ্যায়) বাড়ির আড্ডাটা এখন খুব মিস্ করি। সাড়ে ১১টা/পৌনে ১২টা থেকে বসতাম। গত ১০/১২ বছর ওটা কেমন জীবনের নিয়ম হয়ে গিয়েছিল। প্রতিবারই ঠিক হত ২টোয় শেষ হবে। অবধারিত ভাবে গড়াত ৩টে/সাড়ে ৩টে।স্বাতীদি থাকলে একটু রাশ থাকত। তখন উনি লাঞ্চও অফার করতেন মাঝে মধ্যে। স্বাতীদি না থাকলে পোয়াবারো! লেবু, লঙ্কা, ভদ্কা সহযোগে সুনীলদার বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার গল্প চলতেই থাকত। আমাদের কাছে যা ছিল জানলা খুলে যাওয়ার মতো। তর্কও অবশ্য কম করিনি। এখন আড্ডা হয় প্রায়ই শ্রীকান্তদার (আচার্য) সঙ্গে। গানের। আমাদের গান নয়। মেহদি হাসানের গজল থেকে হিন্দি ফিল্মি গান। কিছুক্ষণ হয়তো আলি আকবর চালিয়ে রাখা হল। অনেক সময় জয় (সরকার) এসে জয়েন করে। ইন্দ্রদীপ (দাশগুপ্ত), সৃজিতের (মুখোপাধ্যায়) সঙ্গে অন্য একটা আড্ডা আমার হয়। সেটা ইন্দ্রদীপের লেক গার্ডেন্সের বাড়িতেই হোক, কিংবা লং ড্রাইভে যেতে যেতে। সৃজিত মাঝে মাঝে একটা খাওয়াদাওয়া করার ‘হুপ’ তোলে। তখন সদলবল বেরিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা চলে। কোনও কোনও দিন ভোর গড়িয়ে যায় প্রায়। টোনিদার (অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরী) আনোয়ার শাহ্ রোডের বাড়িও আমার আড্ডার একটা ভাল ঠেক। বিশেষ করে শান্তনু (মৈত্র) যখন কলকাতায় আসে। এই আড্ডাটার কোনও সময়-টময় নেই। যখন তখন। যতক্ষণ খুশি। এগুলোই আমায় বাঁচিয়ে রাখে।

গোল টেবিল

• নাটোরের মহারাজা জগদানন্দ রায়ের একটি আড্ডা ছিল অতি বিখ্যাত। সেখানে নিয়মিত আসতেন লেখক প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় আর ইতিহাসবিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনিতে গম্ভীর প্রকৃতির রাখালদাস কতটা সরস ছিলেন এই আড্ডায় তাঁকে না দেখলে বোঝা মুশিকল ছিল। প্রভাতকুমার ছিলেন স্বল্পভাষী। কিন্তু আড্ডায় তাঁরও আড় ভাঙতে সময় লাগত না

• উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে কলেজ স্কোয়্যারের কাছাকাছি দু’চারটে নতুন বইয়ের দোকান হয়। যারা সেসময় ইউরোপ-আমেরিকা থেকে সদ্য প্রকাশিত বইগুলো আনতেন। যার জন্য দোকানগুলো কলেজ-ইউনিভার্সিটির পড়ুয়া বা সাহিত্যিকদের একটা ‘ঠেক’ হয়ে ওঠে। এই দোকানগুলির একটি ‘বুক কোম্পানি’। সেখানে নিয়মিত যেতেন সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী, ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

• বাংলা সাহিত্যের বহু স্বনামধন্য লেখক বেরিয়ে এসেছেন ‘কল্লোল’-এর আড্ডা থেকে। এ আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। ‘শনিবারের চিঠি’র আড্ডাও বেশ বিখ্যাত ছিল। যার মধ্যমণি ছিলেন সজনীকান্ত। এই দুই দলকে জোড়াসাঁকোয় ডেকে একবার রবীন্দ্রনাথ ‘সামিট’-এর ব্যবস্থা করেন

কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস

• কলেজ স্ট্রিটের এক প্রকাশনার বইয়ের দোকানের আড্ডাটিও বেশ নামকরা। যাঁর কেন্দ্র ছিলেন মালিক সুধীরচন্দ্র সরকার। সুধীরচন্দ্রের অন্য একটি আড্ডায় আসতেন ‘প্রবাসী’র সম্পাদক কেদার চট্টোপাধ্যায়, বিখ্যাত চিত্র পরিচালক নীতিন বসুর দাদা হিতেন বসু

• কলকাতায় ‘ইন্ডিয়ান’ কফিহাউসের আড্ডায় ছিল রীতিমতো চাঁদের হাট। যেখানে যেতেন সত্যজিৎ রায়, কমলকুমার মজুমদার, হরিসাধন দাশগুপ্ত, কুমারপ্রসাদ, চিদানন্দ দাশগুপ্ত সমেত অনেকে

• ভবানীপুরে ‘স্যাঙ্গুভ্যালি’ রেস্তোরাঁর আড্ডাও ছিল বেশ জমজমাট। এখানেও যেতেন কমলকুমার

• নামকরা ছিল ‘পরিচয়’ পত্রিকার আড্ডাও। যেখানে এক কালে যেতেন কবি-সাহিত্যিকদের অনেকে বিষ্ণু দে, সুধীন দত্ত, গোপাল হালদার, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

• মির্জাপুর স্ট্রিটের একটা মেসে আড্ডায় যেতেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, বরেণ গঙ্গোপাধ্যায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়। শোনা যায়, সমরেশ বসুর গল্প ‘আদাব’ কিংবা ‘জোয়ার ভাঁটা’র সূত্র ছিল বৌবাজারের কোনও এক মেসের আড্ডা

• ৬ নম্বর বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটে নাট্যাচার্য শিশিরকুমারের আড্ডারও বেশ সুখ্যাতি ছিল। এখানে আসতেন কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র, তাঁর বাজেশিবপুরের বাড়ি থেকে। এই সময়ই তিনি তাঁর উপন্যাস ‘দেনাপাওনা’-কে নাট্যরূপ দেন ‘ষোড়শী’ নামে। শিশিরকুমারের কাছে শরৎচন্দ্র যখন নাটকটি নিয়ে আলোচনা করতেন তখন সেখানে উপস্থিত থাকতেন শিশিরকুমারের এক বন্ধু সুধাংশুমোহন মুখোপাধ্যায়। তিনি নাকি বারবার সেই আলোচনায় ঢুকে পড়তেন। তাতে প্রথম দিকে বিরক্ত হতেন শরৎচন্দ্র। দু’চার কথা শুনিয়েও দেন। কিন্তু পরে শরৎচন্দ্রর সঙ্গে তাঁর এতই বনিবনা হয়ে যায় যে ‘ষোড়শী’ তাঁকেই উৎসর্গ করেন তিনি

• সাহিত্যিক সাগরময় ঘোষের আড্ডায় আসতেন বিমল মিত্র (থাকতেন কেওড়াতলার কাঠপুল পেরিয়ে চেতলা), রমাপদ চৌধুরী (তখন থাকতেন ট্রাম ডিপোর উলটো দিকে অমৃত ব্যানার্জি রোডে), হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় (থাকতেন টালিগঞ্জের চারু অ্যাভিনিউ), বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় বা ‘বিশুদা’ (বাড়ি ছিল সদানন্দ রোডে)। ‘বিশুদা’ ছিলেন একমাত্র ব্যাঙ্কের কেরানি। বাকিরা সাহিত্যিক। এখানে বিভূতিভূষণ-তারাশঙ্কর সাহিত্যের বিতর্ক প্রসঙ্গে কালিদাস রায় মন্তব্য করেন, “শোনো বিভূতিভূষণ দেবী সরস্বতীকে তারাশঙ্কর গা-ভরা সোনার গয়না দিয়ে যতই সাজাক, তুমি দেবীর নাকের যে নাকছাবিটা বসিয়েছ, তা দেবীর সারা অঙ্গের গয়নার জৌলুসকে ছাপিয়ে চিরকাল উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।” গল্পটি এই আড্ডায় উঠে এসেছিল বিমল মিত্রর ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ উপন্যাসটি প্রেমেন্দ্র মিত্র ‘এডিট’ করে বই করা উচিত ছিল, মন্তব্য করার পরে

সূত্র: কলকাতার আড্ডা, সমরেন্দ্র দাস সম্পাদিত (গাঙচিল)।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন