ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
পত্রিকা: শেষমেশ ২০১৪-য় এসে আপনার কি সেনসেক্স বাড়ল?
গৌতম: হা হা হা... চারটে নাটক একসঙ্গে... তাই বলছেন? তা’ও আবার সব ক’টা বড় মাপের। ক্যালিগুলা, মেফিস্টো, আলতাফ গোমস্, ওথেলো... সত্যিই একসঙ্গে এতগুলো নাটক কোনও দিন করিনি। সেদিক থেকে দেখলে...
পত্রিকা: মাসকয়েক আগে আপনার প্রাক্তন স্ত্রী সোহিনী সেনগুপ্তকে আপনার নাটক দেখতে দেখা গেল। আপনি কোনও দিন ওঁর থিয়েটার...
গৌতম: (অনেকটা সময় নিয়ে) প্লিজ এই প্রসঙ্গটা থাক না! (বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে) না, আমার যাওয়া হয়নি।
পত্রিকা: ২০১১-র একটি সাক্ষাৎকারে সোহিনী কিন্তু বলেছিলেন, দরকারে আপনার সঙ্গে থিয়েটার করতে ওঁর আপত্তি নেই। আপনার?
গৌতম: অনেক অভিনয় তো একসঙ্গে করেছি। আর এখনও অবধি ব্যাপারটা আমার মাথাতেও আসেনি। আর আমার মনে হয়, অন্য কেউ একসঙ্গে আমাদের ডাকবেও না।
পত্রিকা: থিয়েটারের জন্য এতটা নিবেদিতপ্রাণ, অথচ এই সহজ প্রশ্নটা এড়িয়ে যাচ্ছেন?
গৌতম: (দু’পাশে মাথা নাড়তে নাড়তে) আমি যা বলার বলে তো দিলাম।
পত্রিকা: কী আর বললেন! থিয়েটারের মানুষ অনেকের চোখে যথেষ্ট প্রগতিশীল। অথচ আপনি তো দেখছি ব্যক্তি-সম্পর্কের উর্ধ্বে উঠতে পারলেন না...
গৌতম: (এবারে উত্তেজিত হয়ে) কে ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন বলবেন? প্লিজ, এ নিয়ে আর প্রশ্ন নয়।
পত্রিকা: তবে এমন জুটিকে একসঙ্গে না দেখাটা যেমন দর্শককে আহত করে, তেমন ক্ষতি করে থিয়েটারেরও। বাদ দিন। পরের প্রশ্নে যাই। দেবশঙ্কর হালদার আর আপনি একসঙ্গে দৌড় শুরু করেছিলেন, ‘নান্দীকার’-এ। এখন কি মনে হয়, উনি আপনার চেয়ে অনেকটা এগিয়ে গেছেন?
গৌতম: আমি চাই দেবশঙ্কর আরও এগিয়ে যাক। আর বিশ্বাস করুন, ওই এক-দুই নম্বরের খেলায় আমি নেই। শম্ভু মিত্র বড়, না উৎপল দত্ত কিংবা লরেন্স অলিভিয়া না ডাস্টিন হফম্যান, এই প্রশ্নগুলো আমার কাছে অবান্তর লাগে।
পত্রিকা: কিন্তু কোনও দিন কি মনে হয় না, দেবশঙ্কর এই মুহূর্তে কম করে কুড়ি-বাইশটা নাটকে আছেন, চাইলে তিনি সংখ্যাটা আরও বাড়াতে পারেন, এত অফার পান, সময়ের জন্য করে উঠতে পারেন না। ওঁকে নিয়ে ফেস্টিভ্যাল হয়...
গৌতম: জীবনকে আমি ওভাবে দেখি না। আমার কষ্টটা অন্য জায়গায়। এই সময়টায় কি সত্যিই বড় থিয়েটার হচ্ছে, সত্যিই কি সমাজের ভাল কিছু প্রবণতা থিয়েটার উস্কে দিতে পারে? দেবশঙ্কর তো খেটে নাটকটা শিখেছে। ওকে নিয়ে ফেস্টিভ্যাল হলে তো থিয়েটারেরই মঙ্গল। তবে কেউ যদি বলে তার সব নাটকই মহান, তা হলে বলব, হায় রে আমার পোড়া কপাল।
পত্রিকা: আপনার থিয়েটারের বন্ধুদের কয়েক জন এখন সাংসদ, বিধায়ক বা নিদেন পক্ষে সরকারি নানা কমিটিতে আছেন। আপনার তেমন কোনও অফার...
গৌতম: আসেনি। আমার ধারণা আসবেও না। তবে যদি থিয়েটারের কোনও ক্ষতি না হয়, এমন অফার এলে নিশ্চয়ই রাজি হব। জানি, ও সব করলে হয়তো ভাল জীবন পাওয়া যায়, তা বলে মন্ত্রী-টন্ত্রি হতে পারব না। আমার গুরু লালন কিংবা কবীর, ভাবুন তো ওঁদের যদি মন্ত্রী করা হত, কী হত? খোদ অমিতাভ বচ্চনকে দেখুন না, এবিসিএল নিয়ে কী নাজেহালটাই না হলেন!
পত্রিকা: হঠাৎ ক্যারাটে শিখতে গিয়েছিলেন কেন?
গৌতম: (হেসে) সে অনেক আগে। ছোটবেলায়। অনেকটাই ওটা ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’ বা ‘থার্টি সিক্স চেম্বার অব শাওলিন’-এর প্রভাব। আর বাকিটা আর্টিস্টিক। ওটা তো আসলে এক ধরনের নাচ। বডিলাইনস্ নিয়ে কাজ। চিরকালই যে ব্যাপারটা আমায় টানে। যে কারণে আমি গোবিন্দন কুট্টি-থাঙ্কমণি কুট্টির ‘কলামণ্ডলম’-এ কথাকলি শিখেছি, ‘পদাতিক’-এও নাচের জন্য ঢুকেছিলাম। ক্রিয়েটিভ ডান্স শিখেছি। মাইম শিখেছি। যে জন্য মিউজিকাল ড্রামায় এতটা ইন্টারেস্ট পাই।
পত্রিকা: আড়াই বছর কাজ করে যখন রেলের অ্যাসিস্টেন্ট অ্যাকাউন্টেন্টের চাকরি ছেড়ে দিলেন, ভয় করেনি?
গৌতম: আমার চেয়েও বেশি ভয় পেয়েছিলেন আমার পরিবারের লোকজন। কিন্তু আমার কেমন দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। চারপাশে ডাঁই করা ফাইল। বড় বড় আলমারি। দশটায় ঢুকতাম, দুটোর মধ্যে আমায় দেওয়া সব কাজ সেরে সোজা ‘নান্দীকার’। অন্যরা ওভারটাইম করে কী সব অনারেরিয়াম পাবে-টাবে বলে কাজই শুরু করত বিকেলের পর। শুধুমাত্র স্যালারি পাওয়ার দিনটাই যা একটু ভাল লাগত। একটা বাইক কিনেছিলাম।
পত্রিকা: অনেকেই বলেন আপনার গোল্ডেন সময়টা হল, ১৯৮৫ থেকে ২০০৮। যখন আপনি নান্দীকার-এ।
গৌতম: এখনও তো তাই। বরং এখন বলা যেতে পারে ডায়মন্ড পিরিয়ড। নান্দীকার-এ থাকার সময় দেবশঙ্কর অনেক বাইরের কাজ করেছে। আমাদের বড়রা রেডিয়ো, টিভি-তে কাজ করেছেন। আমি দিনের মধ্যে বারো ঘণ্টা থিয়েটারে দিয়েছি। সারাদিন ট্রেনিং করাচ্ছি, নয় করছি। অন্যদের সঙ্গে কাজ করা দূরে থাক, অন্য নাটক দেখতেও সময় পেতাম না। প্রচুর টিভি সিরিয়ালের অফার ছেড়েছি। ভাবতাম থিয়েটারের ক্ষতি হবে যে! ‘হ্যামলেট’ করতে চেয়েছিলাম, বিখ্যাত একটা আমেরিকান মিউজিক্যাল ‘ওয়েস্ট সাইড স্টোরি’ নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’ চেয়েছিলাম নান্দীকার-এই হোক, পারিনি করতে। ‘বিসর্জন’ আমার অনেক বছরের ইচ্ছে। হয়নি। আজ যদি আমি বলতাম ‘ক্যালিগুলা’ করব, পারতাম না করতে।
পত্রিকা: আবার অনেক কিছু পেরেওছেন। তিনটে একক করেছেন, ঢুকেই ‘ফুটবল’-এ হরি হয়েছেন। বরং শুনেছি, এক সময় দেবশঙ্কর হালদার টানা একটা বছর আলোর কাজ করে গেছেন। অভিনয় করার সুযোগ পাননি। তা’ও বলবেন, আনুকূল্য পাননি?
গৌতম: সেটা তো আমার অপরাধ নয়।
পত্রিকা: সে অন্য কথা। কিন্তু আনুকূল্য তো পেয়েইছেন...
গৌতম: তা হলে একটু প্রথম থেকে বলি। ‘ফুটবল’। হরির পার্ট প্রথমে আমার ছিল না। ক্রাউডে থাকতাম। হরি করতেন একজন সিনিয়র। এক-দু’দিন উনি যখন আসেননি, আমি তখন প্রক্সি দিয়েছি। এর মধ্যেই নান্দীকার-এরই কয়েকজন বন্ধু মিলে একজনের বাড়িতে সকাল থেকে দুপুর, হরির পার্ট নিজেরা প্র্যাকটিস করতাম। প্রক্সি দেওয়ার সময় সিনিয়ররা বুঝেছিলেন, আমায় কিছু বলার দরকার নেই, ওটা আমি আমার মতো তৈরি করে নিয়েছি। তারপর ওঁরাই ঠিক করেন, ওটা আমায় দিয়ে করাবেন। হরি তখনও কিন্তু প্রধান চরিত্র নয়, প্রধান চরিত্র ছিল কালীদা। আমি করার পর ওটা প্রধান হয়ে গেল। অহঙ্কার করে বলছি না, কিন্তু এটাই ঘটনা। এর পর ‘এক থেকে বারো’। আমার নিদের্শনা। সবচেয়ে ছোট চরিত্রটা বেছেছিলাম নিজের জন্য। এক দক্ষিণ ভারতীয় মানুষের। যে জন্য দু’জন তামিলভাষীর কাছে গিয়ে দেখা করে, উচ্চারণটা কেমন হবে জেনে বাংলায় লিখে অভিনয় করলাম। এটা প্রমাণ করতে যে কারও সুযোগ দেওয়ার দয়ায় আমি বাঁচতে চাই না। তারপর ‘চোখ গেল’, ‘বাপ্পাদিত্য’ কোথাও তো অভিনয়ই করিনি। অথচ অভিনয় করেই আমি সবচেয়ে তৃপ্তি পাই। এরপর কোথায় বলুন আমি প্রধান চরিত্রে? ‘শঙ্খপুরের সুকন্যা’? না। ‘শেষ সাক্ষাৎকার’? না। ফেরিওয়ালার মৃত্যু? ‘গোত্রহীন’? না।
পত্রিকা: ‘নগরকীর্তন’? সেখানে তো আপনিই প্রধান চরিত্রে সুযোগ পেয়েছিলেন।
গৌতম: কে বলল? আমি তো বলব, আমার জন্য অনেকে একসঙ্গে বড় কাজ করার সুযোগটা পেয়েছিলেন। অনেকগুলো বড় চরিত্র ছিল। নাটকটা লিখেছিল কৌশিক রায়চৌধুরী। প্রত্যেকটা সিন কী ভাবে হবে, সেটা রাতের পর রাত জেগে, ইমপ্রোভাইস করতাম দুজনে মিলে। অনেক দিন ধরে নাটকটা তৈরি করেছিলাম। এগুলো যাঁরা সে সময় যুক্ত ছিলেন, তাঁরা জানেন। ‘আনুকূল্য’র কথা তুললেন তো, তাই বলছি। কাউকে আঘাত বা অসম্মান করতে নয় কিন্তু। থিয়েটারের জন্য আমি যা করেছি আনন্দের সঙ্গেই করেছি। তখনও। এখনও।
পত্রিকা: কিন্তু তিনটে একক করার তো সুযোগ পেয়েছিলেন। এবং সেটা ‘নান্দীকার’-এর কারণেই। ‘মেঘনাদ বধ’, ‘বড়দা’ আর ‘মরমিয়া মন’।
গৌতম: তবে শুনুন, ‘মেঘনাদ’ যে করব, কোনও দিন ভাবিনি। ওটা ক্লাসে পাঠ করাতাম, উচ্চারণ কী ভাবে স্পষ্ট করা যায়, সেই ভাবনা থেকে। দু’মাস শুধু ক্লাস হয়েছিল। তারপর এডিট-টেডিট করে দেখলাম, বেশ লাগছে তো। আমি চেয়েছিলাম, ওটা সবাইকে নিয়ে করতে। ছাত্ররা বলল, ওটা তুমি একা করো। তখন দলের সিনিয়রা দেখলেন। শঙ্খ ঘোষ এলেন। সিনিয়র গৌতম হালদার দেখলেন। সবাই যখন বলতে লাগলেন, নাটকটা আমার করা উচিত, তখন ওটা হল। আর ‘বড়দা’ বলছেন? সে তো আমি একাই তৈরি করেছিলাম। ৩১ ডিসেম্বর রাতে রবীন্দ্র সদনে যে অনুষ্ঠান হত ‘নাট্যস্বপ্নকল্প’ নামে, তার জন্য। মাত্র পাঁচ দিনে তৈরি করেছিলাম। ওটা আমারই প্রযোজনা। নান্দীকার-এর নয় তো! আসলে বিভাসদা (চক্রবর্তী) তখন ওই অনুষ্ঠানটার অন্যতম উদ্যোক্তা। উনি বলেছিলেন, “গৌতম, এমন একটা নাটক করো, যেটা কোনও বাঙালি লেখকের গল্প নয়।” তখন আমি প্রেমচন্দের ওই গল্পটা বেছে নিই। ‘বড়দা’ ‘নান্দীকার’-এর ব্যানারে পরে হয়, সেটা ‘নান্দীকার’ চেয়েছিল বলে। আমি তো কাউকে ধরেবেঁধে কিছু করতে বলিনি।
পত্রিকা: আর ‘মরমিয়া মন’?
গৌতম: হঠাৎ হাতে পেয়েছিলাম দস্তয়েভস্কির নভলেট ‘দ্য জেন্টল স্পিরিট’। তার থেকেই ‘মরমিয়া মন’। এক রাতে পড়ে ফেলেছিলাম। তারপর মনে হল, ওটা না করে আমি থাকতে পারব না। এতটাই ছটফটানি ছিল ভেতরে ভেতরে...
পত্রিকা: সেই করার সুযোগটা তো ‘নান্দীকার’ আপনাকেই দিল। অন্য কাউকে নয়। এমনকী দেবশঙ্কর হালদারকেও না। এই ছটফটানি তো অন্যদের মধ্যেও থাকাটা অস্বাভাবিক নয়, তাই না?
গৌতম: এটকু বলতে পারি, ‘মরমিয়া মন’ করার পর আমি ঠিক করেছিলাম আর একক করব না। তাই ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ করেছিলাম। শেষমেশ যেখানে প্রায় সত্তর-আশি জন একসঙ্গে অভিনয় করত। আর একটা কথা বলি।
পত্রিকা: কী?
গৌতম: কাউকে সুযোগ দিয়ে, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পাইয়ে দিয়ে বড় থিয়েটার হয় না। তা হলে অনেক বড় দল এত দিনে অনেক বড় কিছু করে ফেলত। ভাল থিয়েটার করতে গেলে স্কিলের পাশাপাশি যেটা দরকার, তা হল স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষা। আমার মনে হয়, ওই তিনটে একক নাটক করতে পেরেছিলাম বলে, বাংলা থিয়েটারেরই লাভ হয়েছে। সম্মান-বৃদ্ধি হয়েছে। তাতে আমি কতটা কী ব্যক্তিগত পেলাম, না-পেলাম, কিচ্ছু এসে যায় না।
পত্রিকা: অনেকেই বলছেন, থিয়েটারে সুদিন এসেছে। আপনি কী বলেন?
গৌতম: দেখুন, শম্ভু মিত্র-অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়-উৎপল দত্ত চলে যাওয়ার পর থিয়েটারে একটা মন্দা দশা এসেছিল। সেই অবস্থা কাটিয়ে উঠে এখন বেশ কিছু ভাল কাজ হচ্ছে। হাউসফুল হচ্ছে। কিন্তু থিয়েটারে সুদিন শুধু হাউসফুল দিয়ে বোঝা যায় না। একটা নাটক কত দিন চলল, কী ভাবে চলল, সেটা থেকে বোঝা যায়। তবে এটাও সত্যি, সুমন, ব্রাত্য, কৌশিক বা দেবেশের কিছু থিয়েটার কিন্তু সত্যি টিকে যাওয়ার মতো। মেফিস্টো, রুদ্ধসঙ্গীত, অনাম্নী অঙ্গনা, উইঙ্কল টুইঙ্কল টিকে যাওয়ার।
পত্রিকা: নান্দীকার-এর ‘নাচনী’?
গৌতম: দেখিনি।
পত্রিকা: আচ্ছা, দেখতেও কি ইচ্ছে করে না? হাজার বাদ-বিবাদ থাকুক, লোকে তো দেশের বাড়ি একবার হলেও যায়...
গৌতম: আর আমি যদি উদ্বাস্তু হই! জন্মসূত্রে আমি তো তাই। আজীবন তেমনই থাকব। আমার শেকড় হয়তো’বা বাংলাদেশে। যেখান থেকে আমার বাবা তাড়া খেয়ে চলে এসেছে। আমি দেখেছি বাস্তু থেকে উৎখাত হলে কী হয়। একটা সময় আমার বাড়িতে ২৪টা রেশন কার্ড থাকত। বাবার একার রোজগার। আড়াইশো টাকা। তাতে অত জনের পেট চলত। আমি জানি আজও বাংলাদেশের কথা বললে বাবার ভেতরটা কতটা হাহাকার করে ওঠে, আবার ওখানকার কিছু অন্যায়ের কথা বললে কেমন ঘৃণা পাকিয়ে ওঠে। আমি জানি বারবার আমার ঘর ভাঙবে। তাই আমার গিয়ে দেখার কিছু নেই। কোনও দরকারও নেই। মনের চোখ দিয়ে আমি দেখতে পাই।
পত্রিকা: আপনাকে নিয়ে কিন্তু বড় অভিযোগ, আপনার অভিনয় ম্যানারিজমে ভরা।
গৌতম: পৃথিবীর কোন অভিনেতার ম্যানারিজম্ নেই বলুন তো? শম্ভু মিত্র-উৎপল দত্ত-অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়...! এ সব কথা যাঁরা বলেন, তাঁরা হয় নির্বোধ, না হয় পাগল। শচীন দেবের গান শুনুন, কী জয় গোস্বামীর কবিতা পড়ুন ... প্রত্যেকের একটা সিগনেচার, একটা স্টাইলাইজেশন থাকে, যেখানে...
পত্রিকা: এ সব কথা বলতে গিয়ে ভোপালের এক নাট্যকর্মীর কাছে একটা সেমিনারে নাকি তাড়া খেয়েছিলেন?
গৌতম: মানে? কে বলল!
পত্রিকা: নামটা বলব না। কিন্তু এটুকু বলি, তিনি বাংলা চলচ্চিত্র ও মঞ্চের এক জন প্রবীণ অভিনেতা।
গৌতম: সম্পূর্ণ বাজে কথা। এ রকম আমার নামে অনেক কিছু রটানো হয়।
পত্রিকা: অনেকে বলেন, স্টাইলাইজেশন নিয়ে আপনি বাড়াবাড়ি করেন হাততালি পাওয়ার জন্য। এটাও কি রটানো বলবেন?
গৌতম: বিশ্বাস করুন, ক্ল্যাপ-ট্র্যাপে আমি নেই। বরং মানুষ যখন নিস্তব্ধ হয়ে শোনে, একটা থম মারা পরিবেশ তৈরি হয়, তখন আমি ওদের পাল্সটা বোঝার চেষ্টা করি। ‘মেঘনাদ’ করতে গিয়ে এটা আমি প্রথম খেয়াল করেছিলাম। এক একটা সর্গ শেষ হচ্ছে, তখন লোকে হাততালি দিচ্ছে, মাঝখানে কিন্তু স্তব্ধতা। আর স্পিচ প্যাটার্ন নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। ধরুন, রাত্তিরে কেউ ঘুমের ঘোরে জড়ানো গলায় কথা বলছে, আমার মাথায় তখন মালকোষের সুর ভেসে বেড়ায়। যেটা আমি ‘ফেরিওয়ালার মৃত্যু’-তে ব্যবহার করেছি। আবার ধু ধু করা মরুভূমির আমেজ আনতে আমি ‘চোখ গেল’ নাটকে ‘মিঁয়া কি টোড়ি’-র আশ্রয় নিয়েছি, সুরটা কথায় আরোপ করেছি... গানে নয়, খেয়াল করবেন, কথায়...এটা আমার একটা সিগনেচার বলতে পারেন।
পত্রিকা: আপনার এই ‘অনুপম খের’ মার্কা চুলহীন মাথাটাও কি একটা সিগনেচার?
গৌতম: হা হা হা হা... না, না। ওটা ঈশ্বরের ওপর অভিমান করে বলতে পারেন, যতটুকু বেঁচে ছিল, চেঁচে ফেলেছি।
পত্রিকা: শুনেছি, স্টেজে নাকি আপনি ভয়ঙ্কর রকম আনপ্রেডিকটেবল... কখন কী করবেন বোঝা যায় না। সত্যি?
গৌতম: দেখুন, আমি থিয়েটার করতে গিয়ে একটা জিনিস খুব সচেতন ভাবেই করি, সেটা হল ‘এলিমেন্ট অব সারপ্রাইজ’। অভিনয়ে যার যত আশ্চর্যের উপাদান থাকবে, সে তত জ্যান্ত হয়ে উঠবে। এটা আমার বিশ্বাস। ফলে একদিন মঞ্চে যেটা করি, পরের দিন ঠিক সেটাই করব, তা নাও হতে পারে। আর প্রতি মুহূর্তে আমি নিজেকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করি... বা বিপদটা এসেও যায়...
পত্রিকা: সেটা আবার কী?
গৌতম: ‘মরমিয়া মন’ করছি। অভিনয় করতে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার গোঁফটা খুলে যাচ্ছে, হাত দিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা করলাম। হল না। এ দিকে স্টেজ ছেড়ে বেরোনর উপায়ই নেই। শেষে উইং-এর একেবারে কাছে গিয়ে উল্টো মুখে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম, ফিসফিসিয়ে মেকআপম্যানকে ডাকলাম, ও ঠিক করে দিল। ‘মরমিয়া’-তেই একবার এক পাটি জুতোর সোল খুলে গেল। ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ করতে গিয়ে একবার পুরো আছড়ে পড়েছিলাম স্টেজের ওপর। আরও মারাত্মক যেটা মনে পড়ছে, সেটা হল পার্টই ভুলে গিয়েছিলাম। দর্শকের কাছে ক্ষমা চেয়ে গ্রিন রুমে গিয়ে পার্ট দেখে পনেরো-কুড়ি সেকেন্ডের মধ্যে ফিরে এসেছিলাম। প্রত্যেকবারই দেখেছি, দর্শক কিন্তু নাটক শেষে এ নিয়ে কিছুই বলেননি। আসলে কী বলুন তো, যদি মিথ্যাচার না করেন, চালাকি না করেন, দর্শক আপনাকে ক্ষমা করবেই। আর উল্টো পথে হাঁটতে গেলেই, ছুড়ে ফেলে দেবে।
পত্রিকা: ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ যেমন ফেরালেন মঞ্চে। আর কোনও পুরনো নাটককে ফেরানোর প্ল্যান আছে?
গৌতম: অবশ্যই। ‘মরমিয়া মন’, ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ ফেরাবই।
পত্রিকা: শেষ প্রশ্ন, আপনার স্বপ্নের প্রজেক্ট কোনটা, এখনও যা করে উঠতে পারেননি, অথচ করতে চান!
গৌতম: স্বপ্ন দেখার কি আর শেষ আছে! ওটা শেষ হয়ে গেলে তো মরেই যাব। এই মুহূর্তে দুটো নতুন নাটকের চিন্তা মাথায় আছে। বলতে পারেন ও দুটোই আমার ড্রিম-প্রজেক্ট। একটায় তিনটে চরিত্র, তিন জনই পাগল। বারবার তাঁরা পাগলাগারদ থেকে পালায়। আবার ধরাও পড়ে। তিনজনই স্বপ্ন দেখে, অন্য গ্রহে পাড়ি দেওয়ার। নাটকটার ওপরের স্তরে কমিক, ভেতরে পুরো বিষাদের চোরা স্রোত। ঘোরতর রাজনৈতিক। দ্বিতীয় যে ড্রিম প্রজেক্ট, সেটা হল ময়মনসিংহ গীতিকা। মুখিয়ে আছি, কবে নামাতে পারব। নামাবই। হয়তো এ বছরেই।