(বাঁদিকে) নরেন্দ্র মোদী এবং প্রিয়ঙ্কা বঢরা গান্ধী (ডানদিকে)। ছবি: পিটিআই।
বন্দে মাতরমের সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে সংসদে আলোচনায় দিনভর চলল রাজনৈতিক চাপানউতোর। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অভিযোগ করলেন, জওহরলাল নেহরু মুসলিম লিগের চাপে বন্দে মাতরমের একটি পংক্তি ছাঁটাই করেছিলেন এবং কংগ্রেসের অধিবেশনে তা না-গাওয়ার সুপারিশ করেছিলেন। জবাবে কংগ্রেস সাংসদ প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরা বললেন, ‘‘নরেন্দ্র মোদী যতদিন প্রধানমন্ত্রী রয়েছেন ততদিনই নেহরুকে ব্রিটিশ সরকার জেলবন্দি করে রেখেছিলেন। শুধু প্রিয়ঙ্কা নন, কংগ্রেসের গৌরব গগৈ, সমাজবাদী পার্টির প্রধান তথা উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবও কড়া ভাষায় আক্রমণ করেন প্রধানমন্ত্রীকে।
প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি সোমবার ‘বন্দে মাতরম বিতর্কে’ প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ ভারতের নির্বাচন প্রক্রিয়ার পবিত্রতা রক্ষায় জোর দিয়ে এনেছেন ভোটার তালিকায় এসআইআর-এর প্রসঙ্গ। সোমবার লোকসভায় তিনি বলেন, “একটা সুস্থ গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল নির্বাচন প্রক্রিয়ার পবিত্রতা। কিন্তু ক্রমাগত অভিবাসন, দ্রুত নগরায়ণের মতো কারণগুলি ভোটার তালিকায় ত্রুটি তৈরি করে, যা প্রশ্ন তুলে দেয় নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে। এই কারণেই এসআইআর-এর মতো প্রক্রিয়াগুলি প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে।” এর পরেই বিরোধীদের উদ্দেশ করে তাঁর কটাক্ষ, “কিছু দলের নেতারা যখন নির্বাচনে পরাজিত হন বা আসন্ন পরাজয় টের পান, তখন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলিকেই প্রশ্ন করেন।” রাজনাথের দাবি, বন্দে মাতরম-এর ‘রূপকগুলি’ প্রায়ই ভুল ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়, কখনও অনিচ্ছাকৃত ভাবে এবং কখনও ইচ্ছাকৃত ভাবে। তাঁর অভিযোগ, স্বাধীন ভারতে জাতীয় সঙ্গীত এবং জাতীয় গান— দু’টিকেই সমান মর্যাদা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বন্দে মাতরম্-কে কোণঠাসা করা হয়েছে বলে মত প্রতিরক্ষামন্ত্রীর।
মোদীর বক্তৃতায় বাংলা এবং ভ্রান্তিবিলাস
সোমবার সংসদে মোদীর বক্তৃতায় বড় অংশ জুড়ে ছিল বাংলা। বন্দে মাতরমের গুরুত্ব এবং প্রভাবের কথা বলতে গিয়ে ইতিহাস স্মরণ করালেন তিনি। আর তা করাতে গিয়েই একাধিক বার হোঁচট খেতে হল প্রধানমন্ত্রীকে। কখনও বন্দে মাতরমের স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে ‘বঙ্কিমদা’ বলে সম্বোধন করলেন তিনি। কখনও স্বাধীনতা সংগ্রামী পুলিনবিহারী দাসকে ভুলক্রমে ‘পুলিনবিকাশ দাস’ বললেন প্রধানমন্ত্রী। কখনও আবার তাঁর ভ্রান্তিবিলাসে যুক্ত হল ‘মাস্টার সূর্য সেন’।
প্রায় এক ঘণ্টার বক্তৃতায় একাধিক বার বঙ্কিমচন্দ্রকে ‘বঙ্কিমদা’ বলে সম্বোধন করছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর বক্তৃতার বয়স যখন ২৩ মিনিট, তখন বিরোধী আসন থেকে বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ জানান দমদমের তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়। ‘বঙ্কিমদা’ সম্বোধনে আপত্তি জানিয়ে তিনি বলেন, অন্তত ‘বাবু’ বলুন। বক্তৃতা থামিয়ে প্রধানমন্ত্রী সৌগতকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “আচ্ছা, বাবু বলছি।” বক্তৃতার ৩০ মিনিটে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালি তরুণদের আত্মবলিদানের ইতিহাস স্মরণ করাচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সেই সূত্রেই পুলিনবিহারী দাসের কথা উল্লেখ করেন তিনি। তবে মোদীর মুখে পুলিনবিহারী নয়, শোনা যায় ‘পুলিনবিকাশ’-এর কথা। এ খানেই শেষ নয়, তার পরেই চট্টগ্রামের সূর্য সেনের বীরত্বের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে তাঁকে মাস্টারদা-র পরিবর্তে ‘মাস্টার’ বলে সম্বোধন করেন মোদী।
প্রধানমন্ত্রী সোমবার তাঁর বক্তৃতায় বার বার স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার অবদানের কথা উল্লেখ করেছেন। বন্দে মাতরম নিয়ে নিজের অভিমতের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “বাংলার গলি থেকে বেরোনো এই আওয়াজ গোটা দেশের আওয়াজ হয়ে উঠেছিল।” এই প্রসঙ্গে বঙ্গভঙ্গের প্রসঙ্গও উত্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, “ব্রিটিশরা বুঝে গিয়েছিল, ভারতকে টুকরো না-করলে শাসন করা মুশকিল। ওরা ওদের বিভেদ ও শাসননীতির প্রয়োগ ঘটিয়েছিল বাংলায়, বঙ্গভঙ্গ করে। কারণ ব্রিটিশরা জানত বাংলার বৌদ্ধিক শক্তি দেশকে দিশা, প্রেরণা আর শক্তি জোগাচ্ছে।” বঙ্গভঙ্গ করে ব্রিটিশ শক্তি ভারত ভাগের বীজ পুঁতেছিল বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
মোদীর বক্তৃতায় উঠে আসে ক্ষুদিরাম বসু, রামপ্রসাদ বিসমিল, মদনলাল ধিংড়ার প্রসঙ্গ। বন্দে মাতরমের মাহাত্ম্যের কথা তুলে ধরতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও উদ্ধৃত করেন তিনি। বলেন, “গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, “একই সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন, এক কার্যে সঁপিয়াছি সহস্র জীবন— বন্দে মাতরম।” প্রধানমন্ত্রী আরও একটি বাংলা পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করেন। বন্দে মাতরম কী ভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার তরুণদের উদ্দীপিত করেছিল সে কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তরুণ প্রজন্ম মৃত্যুকে ভয় না পেয়ে বন্দে মাতরম স্লোগান তুলত। বলত, “যায় যাবে জীবন চলে, জগৎমাঝে তোমার কাজে বন্দে মাতরম বলে।” ফাঁসির আগে বন্ধুকে লেখা চিঠিতেও সূর্য সেন বন্দে মাতরম মন্ত্র উল্লেখ করেছিলেন বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। সেই সঙ্গে তাঁর অভিযোগ, মুসলিম লিগের চাপে নেহরু জাতীয় গান হিসেবে ‘বন্দে মাতরম’-এর যে সংস্করণ গ্রহণ করেছিলেন, তা থেকে এর গুরুত্বপূর্ণ লাইনগুলি বাদ দেওয়া হয়েছিল। বক্তৃতায় মোদী একে ‘তোষণের রাজনীতি’ বলে কটাক্ষ করেছেন। ইন্দিরা গান্ধীর নাম না করে মোদী সোমবার বলেন, ‘‘বন্দে মাতরমের যখন শতবর্ষ সে সময় দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল।
বিরোধীদের জবাবে পশ্চিমবঙ্গে ভোট
পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখেই প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় বাংলার প্রসঙ্গ তুলে ধরছেন বলে সোমবার লোকসভায় অভিযোগ করেন ওয়েনাড়ের কংগ্রেস সাংসদ প্রিয়ঙ্কার। তিনি বলেন, “আমরা কেন বন্দে মাতরম নিয়ে বিতর্ক করছি? কারণ শীঘ্রই বাংলার নির্বাচন আসছে। সরকার চায়, আমরা যেন অতীত নিয়েই মগ্ন থাকি, কারণ তারা বর্তমান ও ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে চায় না।” নেহরুকে মোদীর নিশানা প্রসঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশাপাশি উন্নয়নকেও হাতিয়ার করেন প্রিয়ঙ্কা। বলেন, ‘‘উনি (নেহরু) ইসরো তৈরি না করলে মঙ্গলযান হত না। উনি এমস তৈরি না করলে সরকার কী ভাবে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করত? উনি ডিআরডিও তৈরি না করলে, আপনি তেজস পেতেন না। উনি আইআইটি নির্মাণ না করলে, তথ্য প্রযুক্তিতে আমরা পিছিয়েই থাকতাম।’’
জাতীয় গান বন্দে মাতরম্ নিয়ে প্রশ্ন তোলা সংবিধানের উপরে হামলা বলে দাবি করেন প্রিয়ঙ্কা। সংবিধানে বন্দে মাতরম্ বিতর্কে তাঁর বক্তব্য, ‘‘জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে প্রশ্ন তোলা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অপমান করা।’’ মোদীকে নিশানা করে তাঁর মন্তব্য, ‘‘প্রধানমন্ত্রী ১২ বছর ধরে পদে রয়েছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় জওহরলাল নেহরু প্রায় অতগুলি বছরই জেলে থেকেছেন।’’ নেহরুর বিরুদ্ধে যত অভিযোগ রয়েছে, মোদীকে তার তালিকা তৈরি করার ‘পরামর্শ’ দিয়েছেন প্রিয়াঙ্কা। তিনি বলেন, ‘‘সংখ্যাটা ৯৯৯ বা ৯৯৯৯, যা-ই হোক না কেন, তালিকা তৈরি করুন। তার আমরা সময়সূচি স্থির করে সংসদে বিতর্কে অংশ নেব। ঠিক যেমন ভাবে আজ বন্দে মাতরম নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আপনার যত ইচ্ছে, আলোচনা করুন। তর্ক করুন। কিন্তু চিরদিনের জন্য এই তর্ক শেষ করুন। গোটা দেশ নেহরুজি, ইন্দিরাজি, রাজীবজিকে নিয়ে আপনাদের অভিযোগ শুনবে। তার পর বেকারত্ব আর জিনিসপত্রের দামবৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা হবে।”
কংগ্রেস সাংসদ গৌরব এবং এসপির অখিলেশও সোমবার স্বাধীনতা সংগ্রামে সঙ্ঘ পরিবারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের অভিযোগ, স্বাধীনতা সংগ্রামে যাঁদের কোনও অবদান নেতা, তাঁরাই এখনও জাতীয়তাবাদ নিয়ে গলা উঁচিয়ে তর্ক করেন। গৌরব বলেন, ‘‘ইতিহাস সাক্ষী, ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় আরএসএসের প্রধান তাতে অংশ না নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।’’ এর পরেই তাঁর মন্তব্য, ‘‘আমি কারও নাম করতে চাই না, তবে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন যে নেতা আজকের বিজেপির পথপ্রদর্শক তিনিও ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন।’’ এ ক্ষেত্রে নাম না করে তিনি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে নিশানা করেছেন বলেই অনেকে মনে করছেন।