কৃশানুকে বাদ দিয়েছিলাম বলে আমাকে পেটানোর প্ল্যান করেছিল ক্লাবকর্তারা

মহাকাব্যিক পঁচিশ বছর! কখনও লাল-হলুদ, কখনও সবুজ-মেরুন। কখনও নীল জার্সির ভারত। পুরনো সেই সাম্রাজ্য বিস্তার আর তার ভাঙাগড়ার রুদ্ধশ্বাস কাহিনি নিয়ে দীর্ঘ এত বছর বাদে অকপট স্বয়ং প্রদীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ একাদশ কিস্তি। আশি-নব্বই দশকে ক্লাব কোচিং-এ তাঁর ব্যর্থতার খতিয়ান নিয়ে এই প্রথম মুখ খুললেনমহাকাব্যিক পঁচিশ বছর! কখনও লাল-হলুদ, কখনও সবুজ-মেরুন। কখনও নীল জার্সির ভারত। পুরনো সেই সাম্রাজ্য বিস্তার আর তার ভাঙাগড়ার রুদ্ধশ্বাস কাহিনি নিয়ে দীর্ঘ এত বছর বাদে অকপট স্বয়ং প্রদীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ একাদশ কিস্তি। আশি-নব্বই দশকে ক্লাব কোচিং-এ তাঁর ব্যর্থতার খতিয়ান নিয়ে এই প্রথম মুখ খুললেন

Advertisement

অনুলিখন: সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share:

নব্বই দশকের শুরুতে মোহবাগান ক্লাবের অনুশীলনে

আমি খুব একটা স্ট্যাটিসটিক্স মনে রাখি না। নইলে সত্তরের দশকে প্রথমে ইস্টবেঙ্গল, পরে মোহনবাগান— দু’ক্লাবেই টানা চার বছর করে কোচ ছিলাম। ওই সময় মরসুমে কখনও পাঁচটা টুর্নামেন্ট খেলে চারটে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। কখনও ছ’টার মধ্যে পাঁচটা ট্রফি জিতেছি। হিসেব রাখলে যে কত ট্রফি হয়, কে জানে!

Advertisement

কিন্তু যখন এখান-সেখান থেকে শুনি, আশি আর নব্বইয়ের দশকে ক্লাব কোচিংয়ে আমার সাফল্য নেই, এক-এক সময় ভাবি স্ট্যাটিসটিক্সগুলো মনে রাখলেই ঠিক করতাম। একেবারে হাতে-কলমে জবাব দিতে পারতাম।

নিজের পঁচিশ বছরের কোচিং কেরিয়ার নিয়ে ধারাবাহিক লিখতে বসে আশি-নব্বইয়ের কোচিং প্রসঙ্গে ঢুকে তাই এই বুড়ো বয়সেও স্ট্যাটিসটিক্স ঘাঁটতে বাধ্য হচ্ছি।

Advertisement

যা দেখছি, ওই সময়ে বড় ক্লাবে টানা কোচিং না করালেও নয়-নয় করে বেশ কয়েক বার ইস্ট-মোহন দু’দলেরই দায়িত্ব নিয়েছি। ইস্টবেঙ্গলে সম্ভবত ছ’বার আর মোহনবাগানে বারদুয়েক। ইস্টবেঙ্গলকে তার ভেতরে যদি ডজনখানেক ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন করে থাকি, তা হলে মোহনবাগানে আমার দ্বিতীয় ইনিংসে দু’বছরে পাঁচটা ট্রফি জিতেছি।

খুব খারাপ স্ট্যাটিসটিক্স কি!

আমি তো বরং বলব, সত্তরের দশকের মতো দুর্দান্ত না হোক, আশি-নব্বইয়ের দশকেও দু’টো বড় ক্লাবে আমার কোচিং সাফল্যের পার্সেন্টেজ ভালই। গড়ে প্রতি সিজনে অন্তত দু’টো ট্রফি জিতেছি।

তবে যদি তুলনাটা বৃহত্তর ক্যানভাসে ফেলে করা হয়, তা হলে আমিও বলব কোচ পিকে বলতে ভারতীয় ক্লাব ফুটবলে যেটা বোঝায়, আশি-নব্বইয়ের দশকে সে রকমটা সত্যিই বোঝাতে পারিনি।

সত্তরের দশকের সেই একচ্ছত্র আধিপত্য পরের দশ-পনেরো বছর ছিল না আমার টিমের।

আবার এটাও খুব স্বাভাবিক— একই স্কুলে অনেক বছর ধরে পড়িয়ে চলা কোনও টিচার কি তাঁর সব ‘ব্যাচ’-এ একই স্ট্যান্ডার্ডের ছাত্রদের পান? প্রতি বছরই ফাইনাল পরীক্ষায় একই রেজাল্ট করতে পারে কি তাঁর ক্লাসরুম?

এর কারণ একটা ছেড়ে একশোটা।

আমার অসংখ্য ছাত্র যে যা-ই মনে করুক, দুঃখ পাক, অভিমান করুক, তবু পরিষ্কার বলছি— সত্তরের দশকের ক্লাসের ফুটবলার আশি-নব্বইয়ের দশকে, বিশেষ করে নব্বইয়ের দশকে দু-একটার বেশি পাইনি।

পাওয়া সম্ভব ছিল না।

পরিবেশ, পরিস্থিতি, মানসিকতা, পরিকাঠামো— সমস্ত কিছু ওই দশ-পনেরো বছরের মধ্যে আমূল পাল্টে গিয়েছিল।

বিরাশির দিল্লি এশিয়াডের কিছু সময় পর বড় ক্লাবের দায়িত্বে ফিরে অবাক চোখে আবিষ্কার করলাম, ময়দানের চরিত্রেও অনেক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। এমনকী ভোকাল টনিকের ভাষা, বিষয় পর্যন্ত পাল্টে ফেলার দরকার পড়ছে আমার।

তখন ইস্টবেঙ্গলে কৃশানু, বিকাশ, মনোরঞ্জন, কার্তিক শেঠরা প্র্যাকটিসে এসে অত সকালেও গভীর ইন্টারেস্ট নিয়ে ড্রেসিংরুমে আলোচনায় বসে পড়ত— আজ কোন কোম্পানির শেয়ারের দর বাড়তে পারে, কার শেয়ার কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। তা হলে আজ শেয়ার কিনলে সেই রকম ভাবে ভেবেচিন্তে কিনতে হবে।

অথবা, ইন্দিরা বিকাশপত্র কিনলে ভবিষ্যতে বেশি লাভ, না ব্যাঙ্কে ফিক্সড্ ডিপোজিটে লাভ বেশি?

আবার কয়েকজন ফুটবলার একটু দূরে আর একটা ছোট জটলা করে আলোচনায় ব্যস্ত যে, কাল বাড়ি গিয়ে সদ্য রিলিজ করা অমুক হিন্দি সিনেমার ভিডিয়ো ক্যাসেটটা দেখলাম। অতটা ভাল লাগেনি। আজ মাঠ থেকে ফেরার পথে তমুক সিনেমার ভিডিয়োটা নিয়ে বাড়ি ঢুকব। তার পর চুটিয়ে এনজয়!

আমিও ওই প্রজন্মের প্লেয়ারদের এই সব অ্যাটিটিউট খুঁটিয়ে লক্ষ করে সেই মতো আমার ভোকাল টনিকের স্ক্রিপ্ট মনে মনে বানাতাম।

তরুণ দে-র সঙ্গে যদি সেই সময়ের বাজারের সবচেয়ে হিট গানের ক্যাসেটের গল্প করতাম, তো কৃশানু দে-র সঙ্গে শেয়ার বাজারের ওঠা-পড়া নিয়ে আড্ডা জুড়তাম।

কার্তিক শেঠের সঙ্গে আবার হয়তো আমার গল্পের বিষয় থাকত ওই সময়কার বাজার চলতি কোনও হিট সিনেমা।

দেখতাম, গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের গায়ে-গায়ে ফুটবলারদের সঙ্গে এ ধরনের সব জাগতিক লাভ-লোকসান, ভাল লাগা-মন্দ লাগার গল্পটল্প জুড়লে মাঠে বেশ কাজ দিচ্ছে।

বন্ধুবর মণিশঙ্করদা’র (প্রসিদ্ধ সাহিত্যিক শঙ্কর) লেখা সেই বিখ্যাত লাইন মনে পড়ছে— আধুনিক সভ্যতা বাড়িয়ে দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ!

আসলে আবেগ না থাকলে পারফর্মিং আর্ট হয় না। ফুটবলও পারফমির্ং আর্ট। অপেশাদার পরিকাঠামোর হাজারো অসুবিধের মধ্যেও একটা মস্ত বড় সুবিধে— প্লেয়ারদের বাড়তি আবেগ।

বেশির ভাগ ছেলে গরিব বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের। দু’-পাঁচ হাজারের বেশি পেমেন্ট নেই। ফলে আরও সচ্ছল হয়ে ওঠার তীব্র বাসনা নিয়ে মাঠে পারলে নিজের প্রাণ দিতেও প্রস্তুত। কোচ যা করতে বলবে, একবারও পাল্টা প্রশ্ন না করে ঠিক সেটাই করবে।

তিয়াত্তরে সুভাষ ভৌমিককে মোহনবাগান শুধু তাড়িয়েই ক্ষান্ত হয়নি, ওদের সমর্থকদের পাশাপাশি জনাকয়েক কর্তা অবধি মন্তব্য করেছিল, “সুভাষের নামে শনিপুজো দে রে। ব্যাটাচ্ছেলে যাতে আমাদের ক্লাব থেকে বিদায় নেয়!”

অথচ সুভাষের মধ্যে বরাবর একটা ব্যাপার দেখে এসেছি। ও যা-ই করবে, সব সময় সেটার সেরাটা ছোঁয়ার একটা তীব্র জেদ ওর ভেতর কাজ করে।

ওই সময় ইস্টবেঙ্গলে সুভাষের খাওয়া-দাওয়ার দিকেও আমি আলাদা ভাবে নজর রাখতাম। একটা সময় দেখলাম, সারা দিনে ওর যত ক্যালরি সুষম খাদ্য দরকার সেটা ওর শরীর নিয়মিত পাচ্ছে না।

আমার দুই মেয়েই তখন স্কুলে পড়ে। তাদের টিফিন হিসেবে ডিম-কলা, মাখন-পাউরুটি আমার স্ত্রী আরতি দু’টো আলাদা টিফিন-বক্স করে দু’জনের ব্যাগে রোজ ভরে দেয়। সব মায়েরাই যা করে থাকে আর কী!

ইস্টবেঙ্গলে আসা বিদেশি ফুটবলার জুলিয়েন ক্যামিনোর সঙ্গে আলোচনায় পিকে। দূরে অন্যদের মাঝে কৃশানু দে

এক দিন আমি সটান আরতিকে বললাম, “আমার একটা কথা রাখবে? কথাটা হয়তো তোমার পছন্দ হবে না। তবু বলছি। পলা-পিক্সির জন্য একটা টিফিন বক্সের খাবার অর্ধেক-অর্ধেক করে ওদের দু’টো টিফিন বক্সে ভরে দিয়ে অন্য বক্স-টার যে খাবারটা বাঁচবে সেটা আমায় দেবে রোজ? তা হলে আমি সুভাষকে বিকেলে আলাদা ভাবে যে প্র্যাকটিস করাই, সেই সময় ওকে খাওয়াব। ওর আরও খাওয়া দরকার। নইলে এত ওয়ার্কলোড নিতে পারবে না। শরীর ভেঙে পড়বে। আবার এত পরিশ্রম ওকে না করালে ওর থেকে যে খেলাটা আমি পেতে চাইছি, সেটা পাওয়া সম্ভব নয়।”

আরতি একমনে সব শুনে একটু হেসে রাজি হয়ে গেল।

আর এক জন গৌতম সরকার। কল্পনাতীত গরিব ছিল ওদের পরিবার।

জীবনে প্রথম বড় ক্লাবের জার্সি গায়ে দিয়েই গৌতম প্রতিটা ম্যাচ ধারাবাহিক দুর্দান্ত খেলায় এক দিন ঠাট্টা করে ওর কাছে খেতে চেয়েছিলাম। ও-ও সঙ্গে সঙ্গে রাজি।

যে দিন ওদের বাড়িতে গেলাম, সব দেখে কেমন যেন একটা খটকা লাগল! গৌতমকে এড়িয়ে অন্যদের কাছে বুদ্ধি করে ঘুরিয়েফিরিয়ে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম, আমাকে খাওয়ার নেমন্তন্ন করলেও গৌতম পাড়ায় অন্য বাড়িতে গিয়ে পড়শিদের অনুরোধ-উপরোধ করে আমার জন্য মাছটাছ রান্নার বন্দোবস্ত করেছে। যেহেতু একটু ভাল কোনও রান্না করার মতো আর্থিক সামর্থ্য সেই সময় ওর ছিল না।

কিছুক্ষণ বাদে খেতে বসেছি, পাতের সামনে অত বাটি সাজানো দেখে আমি খানিকটা ইচ্ছে করেই সে দিন গৌতমকে বলেছিলাম, “বাবা, তুই কি ভাবিস, আমি জানি না, কী কষ্ট করে এই খাবারের ব্যবস্থা তোর কোচের জন্য করেছিস? চল্, আজকের দিনটার কথা আমরা গুরু-শিষ্য দু’জনই আজীবন মনে রেখে দিই। আর এটাই তোকে মাঠে সর্বদা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াক যে, এমন ফুটবলটা এর পর খেলব যে, সেই খেলার জোরে প্রচুর রোজগারের টাকায় প্রদীপদাকে এক দিন ফাইভ-স্টার হোটেলে নেমন্তন্ন করে ডিনার খাওয়াব।”

আজও স্পষ্ট মনে আছে, কথাটা আমি ভাত হাতে বলছি আর গৌতমের সঙ্গে সঙ্গে নিজেও কাঁদছি! ওর বাড়ির সবাইও কাঁদছে।

এ রকম বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠার মতো কাহিনি কিন্তু আমার আশি-নব্বইয়ের দশকে কোচিংয়ের সময় কোনও ফুটবলারকে নিয়ে নেই।

তত দিনে প্লেয়ারদের পেমেন্ট হাজার থেকে লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছে। তাতে আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই।

কিন্তু সুধীর-হাবিব-সুব্রতরা যে টাকায় যে ফুটবলটা দিনের পর দিন খেলেছে, যে ধারাবাহিকতা দেখিয়েছে, সেই একই কথা কি বিকাশ পাঁজি, বাবু মানি, সুদীপ চট্টোপাধ্যায়দের সম্পর্কে বলতে পারব আমি?

না, বলতে পারছি না।কিন্তু বিদেশে দেখুন। রিয়াল মাদ্রিদের সেই স্বর্ণযুগে পুসকাস, দি স্তেফানো যে টাকায় খেলেছেন, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো এখন তার চেয়ে লক্ষ গুণ বেশি পেমেন্টে খেলছে। কিন্তু পারফরম্যান্স গ্রাফটা রিয়ালের দুই প্রজন্মেরই এক— সুপার্ব স্ট্যান্ডার্ড। ইস্ট-মোহনে যার অভাব।

ভাইচুং ভুটিয়া—অত পেশাদার মানসিকতার ছেলে! কৃশানু দে—অত প্রতিভাবান ফুটবলার! দু’জনের সঙ্গেই আমার কেমিস্ট্রি নাকি ওই সময় ভাল ছিল না বলে এখনও মাঝেমধ্যে মিডিয়ার জল্পনা চলে।

আজ খোলাখুলি স্বীকার করছি— জল্পনাটা আংশিক সত্যি। যে-হেতু ব্যাপারটা ওদের দিক থেকেই ছিল। আমার দিক থেকে নয়।

দু’জনই একটা জায়গায় একই রকমের ছিল। আরে, প্রদীপদা প্র্যাকটিসে যা বলছে, শুনছি। যা করতে বলছে, করছি। সব ঠিক আছে। কিন্তু মাঠে নেমে আমরা নিজেরা যেটা সবচেয়ে ভাল বুঝব, সেটাই করব। তা সেটা কোচের কথা, কোচের শেখানোর সঙ্গে মিলুক বা না মিলুক।

অথচ, আশি-নব্বইয়ের দশকে আমার কোচিংয়ে যে দু’টো চিরস্মরণীয় ম্যাচ, সেই দু’টোরই নায়ক ভাইচুং আর কৃশানু-ই।

সাতানব্বইয়ে অমল দত্তের মোহনবাগানের ডায়মন্ড সিস্টেমের দর্পচূর্ণ করেছিল আমার ইস্টবেঙ্গল, ৪-১ জিতে। ভাইচুং একাই তিন গোল করেছিল। আর মারদেকায় কৃশানু হ্যাটট্রিক করেছিল তাইল্যান্ড ম্যাচে। আন্তর্জাতিক ম্যাচে ভারতীয় ফুটবলারের বিরল হ্যাটট্রিক! কিন্তু সে সব ওই এক-আধটা ম্যাচে। প্রদীপের শিখা দপ করে জ্বলে ওঠার মতোই।

তাঁর সঙ্গে যে ভাল রসায়ন ছিল না ভাইচুংয়ের, এ কথা প্রায়ই বলতেন অনেকে

গৌতম, শ্যাম থাপাদের মতো ধারাবাহিকতা দেখাতে পারেনি আশি-নব্বইয়ের দশকের ময়দানের সুপারস্টাররা।ইস্টবেঙ্গলে এক বার কৃশানুকে মহমেডান ম্যাচে বাদ দিয়েছিলাম। হাফটাইমে চিমার গোলে মহমেডান এগিয়ে। পল্টুরা (দাস) ততক্ষণে আমাকে ম্যাচের পর পেটানোর প্ল্যান কষে ফেলেছে।

আশি-নব্বইয়ের দশকে আবার এই একটা ট্রেন্ড হাজির হয়েছিল। কোচ দলেরই ভালর জন্য কোনও বিশেষ স্ট্র্যাটেজিতে মাঠে টিম নামালেও সেখানে যদি কোনও কর্তার নিজের পছন্দের প্লেয়ারের জায়গা না হয়, অমনি ঘোঁট পাকানো শুরু হয়ে যাবে কোচের বিরুদ্ধে।

তাতে দলের ভাল-মন্দ যা-ই ঘটুক না কেন, সেই কর্তার কিস্যু আসে-যায় না!

সেই ম্যাচে আমার অঙ্ক ছিল, মহমেডান কৃশানুর পা টার্গেট করতে পারে। সে ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচটায় গোড়ার দিকেই হয়তো চোট পেয়ে কৃশানু বসে যেতে পারে। অথবা, গোটাকয়েক কড়া ট্যাকলের সামনে পড়ে ও কুঁকড়ে যেতে পারে।

যে প্রবণতাটা সুরজিতের মতো কৃশানুর খেলাতেও একটুআধটু ছিল।

তার বদলে আমি যদি কৃশানুকে সেকেন্ড হাফে নামাই, যখন উল্টো দিকে চিমা-মইদুলরা খানিকটা ক্লান্ত থাকবে, সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ‘ফ্রেশ লেগ্স’ কৃশানু আরও বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে।

আর ঠিক সেটাই হয়েছিল। হাফটাইমের পর কৃশানুর প্রথম তিনটে মুভ থেকেই দু’গোল পেলাম। ইস্টবেঙ্গল শেষমেশ বোধহয় ৩-১ জিতেছিল। কিন্তু তার পরেও বহু দিন আমাকে শুনতে হয়েছে, কৃশানু নাকি ওই ম্যাচে শুরুতে নামতে না পারায় আমার ওপর খেপা।

কেননা আমি টিমের সেরা ফরোয়ার্ডকে প্রথম দলে রাখিনি! অথচ এই ক’দিন আগেই আইএসএলে কেরলের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচেও কলকাতার আটলেটিকোর স্প্যানিশ কোচ হাবাস ওর দলের মার্কি ফুটবলার গার্সিয়াকে শুরুতে বেঞ্চে বসিয়ে রেখেছিল।

পরে জুতসই টাইমে গার্সিয়াকে নামিয়ে ওর পাস থেকেই গোল তুলে নেয়। বেচারা হাবাসের কপাল খারাপ। সে দিন রেফারি কলকাতার একটা সিওর গোল (যেটা আবার গার্সিয়াই করেছিল!) বাতিল করায় শেষমেশ ম্যাচটা হেরে যায়। কিন্তু তার জন্য আটলেটিকো কোচের স্ট্র্যাটেজির আমি কোনও ভুল দেখছি না।

আশি-নব্বইয়ের দশকেও অবশ্য বেশ কয়েক জন ফুটবলার পেয়েছিলাম, যারা আমার কথা বেদবাক্যের মতো মেনে মাঠে নিজেদের একশো দশ ভাগ দিয়েছে। নাম করেই বলছি— কৃষ্ণেন্দু রায়, অলোক মুখোপাধ্যায় (বাঘের মতো হালুম করে লাফিয়ে অপোনেন্টকে ট্যাকল করত বলে আমি আদর করে নাম দিয়েছিলাম ‘হালুম মামা’), বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য, অতনু ভট্টাচার্য, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য... এ রকম কয়েক জন।

আবার টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমি-র প্রথম দিককার প্রোডাক্ট গৌতম ঘোষের মতো গুটিকয়েক ফুটবলারের মানসিকতা ছিল— আমি যে বিশাল পেমেন্ট পাচ্ছি, সেটা আমার প্রাপ্য।

প্রদীপদার কথা শুনে জান দিতে যাব কেন? ‘জান’-ই চলে গেলে পরের মরসুমে কী হবে!

আর একটা জিনিসের ভীষণ পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল ক্লাব ফুটবলে আমার প্রথম আর দ্বিতীয় ইনিংসের মাঝের কয়েক বছরে! সেটা হল একটা দলে অনেক সুপারস্টার থাকলেও তাদের মধ্যে টিমের স্বার্থে প্রেম-ভালবাসা।

অন্তত দলের ভালর কথা ভেবে নিজস্ব তারকাসুলভ ইগো-কে দূরে সরিয়ে রেখে একে অপরের দিকে সাহায্যের, বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা সত্তরের দশকে আমার টিমের তারকা ফুটবলারদের মধ্যে যতটা তীব্র ছিল, তার অর্ধেকও আশি-নব্বইয়ের দশকের ময়দানের সুপারস্টারদের ভেতর পাইনি।

বেশির ভাগই আত্মকেন্দ্রিক। প্র্যাকটিসে বা ম্যাচে যেখানেই বলুন, নিজের কাজটা যথাযথ করে দিচ্ছে, সেখানে কোনও খামতি নেই, কিন্তু সে দিনটা যদি তারই কোনও টিমমেটের খারাপ যায়, তা হলেও তার সাহায্যে সেভাবে এগিয়ে আসার তেমন ইচ্ছে প্রকাশ ঘটত না। তাতে সার্বিক টিমগেমের যে ক্ষতি, সে সব চুলোয় যাক!

যে ‘ফেলো-ফিলিংস’টা হাবিব-সুধীরদের মধ্যে প্রচণ্ড রকম ছিল।

আর একটা ব্যাপারের অভাব আশি-নব্বইয়ের দশকে ক্লাব কোচিংয়ে টের পেয়েছি— সত্যিকারের এক জন টিম লিডারের অভাব।

সত্তরের দশকে ইস্ট-মোহন, যখন যে ক্লাবে কোচিং করিয়েছি, হাবিব ছিল আমার টিমের অলিখিত ক্যাপ্টেন। নেতা। কত যে চাপের ম্যাচে মাঠে বাকি দশ জনকে চিৎকার করে, বকে-ঝকে চাঙ্গা করে তুলেছে, নিজে দুর্ধর্ষ খেলে সামনে দাঁড়িয়ে টিমমেটদের উদ্বুদ্ধ করেছে, তার ইয়ত্তা নেই।

তেমন সত্যিকারের টিম লিডার আশি-নব্বইয়ের দশকে এক জনকেও পাইনি। মনোরঞ্জন, সুদীপ, শিশির ঘোষদের ভেতর খানিকটা ‘লিডিং-পাওয়ার’ দেখতে পেলেও সেটা হাবিবের তিরিশ ভাগও নয়।

আশি-নব্বইয়ের দশকে বিদেশি প্লেয়ার দলে পেলেও পাশাপাশি আবার কলকাতার ছেলের সংখ্যা কমে আসতে থাকছিল। ফলে ইস্ট-মোহনের সেই ট্র্যাডিশনাল আবেগটা সত্তরের দশকের মতো দলের ভেতর তৈরি হয়নি।

চিমাকে তো দু’টো বড় ক্লাবেই আমার কোচিংয়ে পেয়েছি। ওমোলোকে আবার আলাদা করে মনে রেখেছি। কারণ, আমার ক্লাব কোচিং কেরিয়ারের শেষ মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ আমার দল জিতেছিল ওমোলোর গোলেই।

মোহনবাগানের ২-১ জয়ে উইনিং গোলটা ছিল ওমোলোর। গোলটা করার কিছুক্ষণ আগেই ওকে আমি ডিফেন্স থেকে সেন্টার ফরোয়ার্ড করে দিয়েছিলাম। দারুণ কাজ দিয়েছিল গেমপ্ল্যানটা।

নব্বইয়ে সুব্রত ভট্টাচার্যের ময়দানে শেষ বছরেও আমি মোহনবাগান কোচ। সে বার সুব্রতকে অনেক ম্যাচে শেষ আধ ঘণ্টা স্টপার থেকে অ্যাটাকিং লাইনে তুলে এনে গোটা লিগে এগারোটা গোল করিয়েছিলাম ওকে দিয়ে। যার একটা অন্য ব্যাখ্যাও হয়তো করা যায়। আশি-নব্বইয়ের দশকের ফুটবলারদের ক্লাস কতটা কম ছিল বলে, সত্তরের দশক কাঁপানো এক জন স্টপার কেরিয়ারের শেষ বছরে ফরোয়ার্ড খেলে লিগে এগারোটা গোল করতে পারে! (চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন