কমলালেবু নলেন গুড় ও জাতীয় নাট্যমেলা

শীতশুরুতে এ বারেও তিনের আগমন। নান্দীকার-এর ৩১তম নাট্যমেলার গ্রিনরুম ঘুরে দেখলেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়’৮৪ সালে নাট্যোৎসব শুরু হওয়ার পর থেকে শম্ভু মিত্র যত বার এসেছেন, বসতেন বাঁধা আসনে। এ ২৬। থিয়েটার ভাল লাগলে তিনি নিমগ্ন ছাত্র। অন্যথা হলে, গ্রিনরুমের দরজা ধরে চলে যেতেন বাইরে। মণিপুরের বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব রতন থিয়ামের নাটক। অভিনয় করতে করতেই স্টেজ থেকে এক অভিনেত্রী পড়ে গেলেন। দু’-তিন সেকেন্ড হার্টবিট বন্ধ। তার পরেই দাঁড়িয়ে উঠে টানা অভিনয় করে গেলেন। সে বার একটি মিউজিকাল ড্রামা দিয়ে শেষ হবে উৎসব। তারপরই প্রতি বারের মতো নান্দীকার-এর পক্ষ থেকে ধন্যবাদসূচক বক্তৃতা। আগেভাগেই নাটকের সময়সীমা জেনে রাখা হয়েছে। দু’ঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট। সেই মতো প্ল্যান-প্রোগ্রামও তৈরি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share:

‘ঈর্ষা’

’৮৪ সালে নাট্যোৎসব শুরু হওয়ার পর থেকে শম্ভু মিত্র যত বার এসেছেন, বসতেন বাঁধা আসনে। এ ২৬। থিয়েটার ভাল লাগলে তিনি নিমগ্ন ছাত্র। অন্যথা হলে, গ্রিনরুমের দরজা ধরে চলে যেতেন বাইরে।

Advertisement

মণিপুরের বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব রতন থিয়ামের নাটক। অভিনয় করতে করতেই স্টেজ থেকে এক অভিনেত্রী পড়ে গেলেন। দু’-তিন সেকেন্ড হার্টবিট বন্ধ। তার পরেই দাঁড়িয়ে উঠে টানা অভিনয় করে গেলেন।

সে বার একটি মিউজিকাল ড্রামা দিয়ে শেষ হবে উৎসব। তারপরই প্রতি বারের মতো নান্দীকার-এর পক্ষ থেকে ধন্যবাদসূচক বক্তৃতা। আগেভাগেই নাটকের সময়সীমা জেনে রাখা হয়েছে। দু’ঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট। সেই মতো প্ল্যান-প্রোগ্রামও তৈরি।

Advertisement

এ দিকে ঘড়িতে তিন ঘণ্টা কী সাড়ে তিন ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। নাটক আর শেষ হয় না। বহুক্ষণ বাদে যখন যবনিকা নামল, উদ্যোক্তারা হাঁফ ছাড়লেন। কিন্তু ততক্ষণে দর্শক-আসন প্রায় খালি। এত দীর্ঘ সময় নেওয়ার কারণ জানতে চাওয়াতে পরিচালক বললেন, “আসলে খুব তারিফ পাচ্ছিলাম তো, তাই এক-একটা গান দু-তিন বার করে গেয়েছি।” তিনি তখনও বুঝতে পারেননি, শেষ দৃশ্য দেখার জন্য আর বিশেষ কেউ অবশিষ্ট ছিলেন না!

৪৭/১ শ্যামবাজার স্ট্রিট। নান্দীকার-এর ঘরে বসে পুরনো দিনের ‘জাতীয় নাট্যমেলা’র খণ্ডচিত্র গাঁথছিলেন দলের কর্ণধার রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত।

প্রতি দৃশ্যে পালা করে উঠে আসছিল গিরীশ কারনাড, বি ভি করন্থ থেকে সেলিম আলদিন, তীজন বাঈ, কুলভূষণ খারবান্দাদের নাম। যাঁরা কোনও না কোনও সময়ে অংশ নিয়েছেন মেলায়।

রুদ্রবাবু বলছিলেন আরেক বিখ্যাত নাট্যরসিক ডা. শ্রীরাম লাগুর গল্প। “ডা. লাগু অসম্ভব আগ্রহী ছিলেন আমাদের নাট্যমেলা নিয়ে। একবার ট্রেনের কোনও টিকিট না পেয়ে, জানেন কী করলেন উনি? দলবল নিয়ে ঠাসাঠাসি ভিড়ে স্লিপার ক্লাসেই চলে এলেন কলকাতা।”

উৎসাহ দর্শককুলেও কি কম ছিল! নাট্যামোদীদের মনে আছে, প্রথম বার টিকিটের লাইন পড়েছিল দু’রাত আগে। বছর কয়েক ধরে তাতে যেন ভাটার টান। স্বীকারোক্তি স্বয়ং রুদ্রপ্রসাদেরও।

তবে কি ধরে নেওয়া যায়, ‘আমার যে দিন ভেসে গেছে...!’ রুদ্রপ্রসাদ বললেন, “আসলে এন্টারটেনমেন্ট ম্যাপটাই তো বদলে গেছে। উৎসবও তো কম হচ্ছে না। আশির মাঝামাঝি একটাই ফেস্টিভ্যাল ছিল। সঙ্গীত নাটক একাডেমির। তাও নিয়মিত নয়। সে দিক থেকে এ ধরনের উৎসবের হোতা বলতে গেলে নান্দীকার-ই। ”

হতে পারে বাঙালি-ঐতিহ্যের খেরোর খাতায় ঢুকে পড়েছে ‘জাতীয় নাট্যমেলা’। আর সেটাই তার ইউএসপি। হাজারটা থিম-পুজোর ভিড়ে বাগবাজার কি একডালিয়া যেমন হারিয়ে যাওয়ার নয়, অনেকটা তেমনই, এই ‘জাতীয় নাট্যমেলা’।

কোনও একজন হাবিব তনবির কী আল মামুন নেই। ‘চরণদাসচোর’ কী ‘কীত্তনখোলা’, ‘পাণ্ডবানী’-র মতো নাটক নেই। কিন্তু তার পরেও তালিকায় যা থাকে, তাতেও প্রায় প্রতি বছরই কিছু না কিছু লুকনো বারুদ মিলেই যায়। যা কি না, বছর পনেরো-ষোলোর সচিন তেন্ডুলকরের প্রথম বার আবদুল কাদিরকে তুলোধোনা করার দৃশ্যের চেয়ে কম ‘ধুঁয়াধার’ নয়!

এ ভাবেই তো কলকাতা এক দিন আবিষ্কার করেছে কলাক্ষেত্র-র অভিনেত্রী সাবিত্রী হেইসনামকে।

প্রথম বার দুপুর সাড়ে তিনটেয় শো। দর্শক মেরেকেটে তিরিশ জন। তাঁদেরই সাক্ষী রেখে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী নাটক ‘দ্রৌপদী’-র শেষ দৃশ্যে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে প্রৌঢ়া সাবিত্রী শিউরে দিয়েছিলেন নাট্যামোদীদের। এর পরের কয়েক বছর? ‘দ্রৌপদী’ দেখতে আসন না পেয়ে মাটিতেই বসতে চেয়েছেন কেউ কেউ।

এ ভাবেই তো এলিয়েদুলিয়ে দেখতে গিয়ে দর্শক টান টান হয়ে গিলেছেন কখনও বাহারুল ইসলামের ‘দ্য নেশন’, কখনও ওয়ামন কেন্দ্রের ‘জুলবা’ বা ‘জানেমন’।

কে বলতে পারে, এ বারেও তেমন বিস্ফোরক নেই?

বাংলা, হিন্দি, নেপালি, অসমিয়া, মণিপুরী, ওড়িয়া মিলিয়ে সাকুল্যে ১৮টি নাটক। আর তার সংক্ষিপ্তসার-এ চোখ বুলিয়ে অদ্ভুত একটা শ্রেণিবিন্যাস চোখে পড়ল।

তার প্রথমটি যদি হয় প্রেমের নাটক, দুই তিন চার পাঁচ নম্বর নাটকের বিষয় হচ্ছে বিশ্বায়ন তথা উন্নয়ন, যুদ্ধ আর ক্ষমতার লড়াই, লোককলা, শিশুমন।

প্রথম বার নেপালি নাটক আসছে এ শহরে। এনএসডি-সিকিমের ‘হামি নাই আফাই আফ’। বিধবা রমণী রেবতী ও সাধু গিরিবাবার প্রেম কাহিনি। এ নাটক দিয়েই উৎসবের শুরু। এর পরে প্রেম পর্যায়ে আরও যা পড়ছে তা হল, বাংলাদেশের ‘ঈর্ষা’, অসমের ‘জয়মতী’ আর ‘ফাইভ্ টনস্ অব লাভ’।

‘ঈর্ষা’ অবশ্য শুধুই প্রেম নয়, তার সঙ্গে যৌনসম্পর্ক নিয়েও টানাপড়েনের উপাখ্যান। ‘জয়মতী’ আবার ১৭শ শতকে এক ঐতিহাসিক নারীচরিত্রের কাহিনি। যে কি না প্রাণ দেয় শুধু তাঁর স্বামীকে বাঁচাতে নয়, দেশকে বাঁচাতেও। বাহারুল ইসলামের নির্দেশনায় ‘ফাইভ টনস্...’ মূলত আন্তন চেখভের কাহিনি। ত্রিকোণ প্রেমের গল্প।

বিশ্বায়ন বা উন্নয়ন নিয়ে তিনটি নাটক। তার একটি ‘ধূঁয়া’। ওড়িশার সুবোধ পট্টনায়কের।

সুবোধ কলকাতার নাট্যমহলে একটি জনপ্রিয় নাম। ভুবনেশ্বর থেকে ৩৫ কিমি দূরে ৬ একর জমির ওপর তৈরি তাঁর থিয়েটার ভিলেজ যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা বলেন, সে নাকি মন্দিরপ্রাঙ্গণ বিশেষ! সাইকেলে করে গ্রামে গ্রামে ছোট নাটক বয়ে নিয়ে যান সুবোধরা। শোনা যায়, কট্টর সবুজায়ন-পন্থী সুবোধ থিয়েটারের চর্চার সময় তাঁর দলে মদ খাওয়া দূরে থাক, চা-কফি পর্যন্ত নিষিদ্ধ করেছেন। ‘ধূঁয়া’য় তাঁর ফোকাস, শিল্পায়নের ফলে আক্রান্ত মানবজীবন।

একই বিষয়ে পরের নাটক ‘বাক্কাই’। নির্দেশক রতন থিয়ামের পুত্র থয়াই থিয়াম। ক্ষমতাধর দেশের থাবায় কী ভাবে নিঃস্ব হয় অনুন্নত জাতি, এ নাটকের বিষয় তাই।

এর পর ‘জাহাজি’। বিহারের হিন্দি নাটক। যে নাটকে প্রশ্ন ওঠে, উন্নয়নের অন্যতম চিহ্ন, যেমন বাঁধ, কারখানা, অভয়ারণ্য সত্যিই কি সাধারণ মানুষের উন্নত জীবনের স্বার্থে? নাকি এ শুধুই সুবিধাভোগী ওপরতলার বাসিন্দাদের ভোগের ডালি আরও পূর্ণ করতে?

ক্ষমতার লড়াই-এর নাটকগুলির পর্বে আছে কলকাতার ‘আরশি অ্যান্ড নোবেল অ্যাসোশিয়েটস্’-এর ‘ট্রয়’, এনএসডি দিল্লির হিন্দি নাটক ‘গজব তেরি কাহানি’ আর অসমের বাদুংদুপ্পা দলের ‘রিদম্ অব দ্য ভ্যালি’।

অবন্তী চক্রবর্তীর নির্দেশনায় ‘ট্রয়’ এর মধ্যেই কলকাতায় সাড়া ফেলা ‘স্টারস্টাডেড’ বাংলা নাটকের একটি।

‘গজব্...’ গ্রিক ড্রামাটিস্ট অ্যারিস্টোফ্যানিসের ‘লিয়েস্ত্রাতা’ অবলম্বনে তৈরি। যেখানে যুদ্ধ থামাতে সৈনিকের স্ত্রীরা প্রতিবাদী হয়ে স্বামীদের সঙ্গে সঙ্গমে যেতেও অস্বীকার করেন।

অসমের বাদুংদুপ্পা দলটি রাভা উপজাতিকে নিয়ে কাজ করা একটি নাট্যদল। তাঁদের নাটকের বিষয়ে উঠে আসবে উগ্রপন্থী দল ও রাষ্ট্রের বৈরিতার মাঝে পড়া সাধারণ মানুষের কাহিনি।

শিশুমন নিয়ে দুটি নাটকের একটি ‘কানু’। নান্দীকার-এর নিজস্ব প্রযোজনা। পরিচালনায় স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। একটি ভিয়েতনামী গল্প থেকে নেওয়া কাহিনি। দারিদ্র ও যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাওয়া কোনও এক ছেলের গল্প।

শিশুমন নিয়ে দ্বিতীয় নাটকটি জম্মুর রঙ্গলোক থিয়েটারের হিন্দি নাটক ‘মা মুঝে টেগর বানা দে’। অসম্ভব রবীন্দ্রভক্ত ও কবিতা লিখতে চাওয়া একটি ছেলে ‘রবিঠাকুর’ হতে চায়। তারপর...? পরিচালক লাকি গুপ্তা। কাশ্মীরের ‘উগ্রবাদী’ অধ্যুষিত এলাকায় পঞ্চাশটিরও বেশি নাটক করা লাকি এ বার প্রথম এলেন কলকাতায়।

লোকনাটক দুটি। পার্থপ্রতিম দেবের পরিচালনায় ‘নান্দীকার’-এর ‘নাচনী’। দ্বিতীয়টি ত্রিপুরারি শর্মার পরিচালনায় হিন্দি নাটক ‘রূপ অরূপ’। প্রথমটির বিষয় এত দিনে বহুল প্রচারিত। নাচনী সম্প্রদায়কে নিয়ে কাহিনি।

দ্বিতীয় নাটকের শুরু হচ্ছে গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে দাঁড়িয়ে। যখন থিয়েটারে নারী চরিত্রে অভিনয় করতেন পুরুষরা। তারপর ক্রমে কাহিনি গড়ায় যখন একটি বিশেষ সম্প্রদায় থেকে মেয়েরা আসতে শুরু করেন থিয়েটারে।

এই পাঁচ শ্রেণির বাইরে থাকছে নান্দীকার-এরই সাম্প্রতিকতম প্রযোজনা ‘বিপন্নতা’। পরিচালনায় সোহিনী সেনগুপ্ত। তার সঙ্গে শিশুদের নিয়ে তিনটি থিয়েটার।

এ বারের নাট্যমেলায় সম্মানিত হচ্ছেন চিত্রপরিচালক ও শিল্পী গৌতম হালদার। থাকবে সদ্যপ্রয়াত নাট্য ব্যক্তিত্ব খালেদ চৌধুরীকে নিয়ে প্রদর্শনী।

সব মিলিয়ে নলেন গুড়, খেজুরের রস আর কমলালেবুর পিছু পিছু প্রতিবারের মতো এ বারও শীতের কলকাতায় এসে পড়ল একত্রিশতম ‘জাতীয় নাট্যমেলা’। চলবে ডিসেম্বরের ১৬ থেকে ২৫। একাডেমিতে।

বিস্ফোরণ না ঘটুক, এক ফালি শীতের রোদও তো প্রাণ জুড়োয়। এ পোড়া সময়ে তাই বা কম কী’সে! অপেক্ষায় নাট্যামোদীরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement