তুমি তো পাগল আর মান্নাদা একটা বদ্ধ পাগল

শাস্ত্রীয় গানের তালিম নিতে গিয়ে এমনই শুনতে হয়েছিল বনশ্রী সেনগুপ্তকে। কেন তিনি সন্ধ্যা কিংবা আরতি মুখোপাধ্যায়কে নিজের চেয়ে ভাগ্যবতী মনে করেন? গানজীবনে তাঁর পাওয়া-না পাওয়া, সুখ, হতাশার গল্প শুনলেন স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়শাস্ত্রীয় গানের তালিম নিতে গিয়ে এমনই শুনতে হয়েছিল বনশ্রী সেনগুপ্তকে। কেন তিনি সন্ধ্যা কিংবা আরতি মুখোপাধ্যায়কে নিজের চেয়ে ভাগ্যবতী মনে করেন? গানজীবনে তাঁর পাওয়া-না পাওয়া, সুখ, হতাশার গল্প শুনলেন স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০১৪ ০০:০৪
Share:

পত্রিকা: বনশ্রী মানেই বড় গোল টিপ খোঁপায় বেলফুল আর সাদা বা ক্রিম রঙের শাড়ি কেন?
বনশ্রী: গায়িকা বনশ্রীকে আমি এ ভাবেই চিনি। বড় খোঁপা, টিপ, সিঁদুর, আর সাদা বা ক্রিম শাড়ি না পরলে আমার মনে হয় গান ভাল হবে না। হয়তো খুব শখ করে নীল শাড়ি পরলাম তো দেখলাম গানটা যেন কেমন হল! বেগুনি পরলে তো গান খারাপ হবেই। এখন যেমন বেশির ভাগ শিল্পী ঝাঁ চকচকে সাজে মঞ্চ আলো করে বসেন, তাঁদের মতো সাজ আমাদের সময় ছিল না, (মাথা নিচু করে, খানিক ভেবে) আসলে গান তো তখন কানে শোনার, এখনকার মতো চোখে দেখার ছিল না। তবে আমি সাজের জায়গায় একটা ইমেজ ধরে রাখতে চেয়েছিলাম।

পত্রিকা: মিস শেফালির কণ্ঠ মানেই তো তখন বনশ্রী সেনগুপ্ত। বনশ্রী সেনগুপ্তর এই ইমেজটাতেও কি আপনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন?
বনশ্রী: (আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে) একশোবার। শুনুন তবে, হেমন্তদা (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়) বলেছিলেন আমায়, গানের কোনও ছোট, বড় হয় না। মান্না দে তো দারা সিংহ-এর গলায় গান গেয়েছেন, কই তাতে করে তাঁর খ্যাতি কি কিছু কম হয়েছে? আর শিল্পীকে তো ভার্সাটাইল হতেই হবে।

পত্রিকা: মিস শেফালির সঙ্গে যোগাযোগ...
বনশ্রী: অনুষ্ঠানে দেখা হয়। দেখলেই আমায় জড়িয়ে ধরে। কেঁদে ফেলে। খুব অনুভূতিপ্রবণ ও। নিজের সুখদুঃখের কথা শেয়ার করে। আমাদের সময় আর্টিস্ট হিসেবে ওর খুব চাহিদা ছিল। যেমন দেখতে ছিল, তেমনি সিনসিয়ারলি কাজটাও করত। সত্যজিৎ রায় তো ওকে ডেকেছিলেন।

পত্রিকা: আপনার কণ্ঠের মডিউলেশন আর হাস্কি টোনের জন্যই কি সুপ্রিয়া দেবীর লিপে আপনাকে দিয়ে একটি ছবির জন্য ক্যাবারে সং গাওয়ানো হয়েছিল?
বনশ্রী: নচিকেতা ঘোষ সদ্য মুম্বই থেকে ফিরেছেন। ছবির নাম ‘ছিন্নপত্র’। উত্তমকুমারের ডবল রোল। সুপ্রিয়া দেবী সিগারেট খেতে খেতে টায়ারড, হাস্কি টোনে ক্যাবারে গান গাইছেন...এমন দৃশ্য। নচিদা মুম্বই গিয়ে আশাজিকে( ভোঁসলে) দিয়ে রেকর্ড করাতে চাননি। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরামর্শে উনি আমাকে ‘ধূ ধূ এই সাহারা’ গানটি গাইতে বললেন। খুব খেটেছিলাম। সুপ্রিয়া দেবীর অভিনয় দেখতাম। আশাজিকে ভেবেই গানটা গেয়েছিলাম।

পত্রিকা: আপনার প্রথম দিকের গানের মধ্যে ভীষণ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গায়ন রীতি শোনা যেত। আপনি কি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে নকল করতেন?
বনশ্রী: নাহ্! আমি কাউকেই কোনও দিন নকল করিনি। আসলে বিয়ের পরে চুঁচূড়া থেকে যখন কলকাতা আসি আমার নিজের গান বলে তো কিছু ছিল না, আমি সন্ধ্যাদির গান অনুষ্ঠানে গাইতাম। তখন পাড়ার জলসা বা ফাংশনে গাওয়াই ছিল আসল ব্যাপার। একবার বকুলবাগানে গান গাইলাম। শুনে মৃণাল চক্রবর্তী আমায় ডেকে পাঠালেন। বললেন, তুমি তো পুরো সন্ধ্যাদির মতো গাও! চলো সুধীনদার (দাশগুপ্ত) কাছে নিয়ে যাই। সুধীনদাই আমায় বললেন, যত দিন পর্যন্ত তোমার নিজের গান হচ্ছে না তুমি মান্না, হেমন্ত, শ্যামলের গান গাও। বললাম, সে কী সন্ধ্যাদির গান গাইব না? বললেন, একদম না। একেই বলে গুরুর উপদেশ! বুঝেছিলেন সন্ধ্যাদির ওই ছাপটাই থাকবে গায়কিতে। আমি থেমে যাব...

পত্রিকা: আপনি তো শাস্ত্রীয় সঙ্গীতই গাইতেন...
বনশ্রী: হ্যাঁ আমার বাবা শৈলেন রায়ের কাছেই আমার শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিক্ষা। পরে অবশ্য ঊষারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের কাছেও তালিম নিয়েছিলাম। বাবা কোনও দিন চাননি আমি আধুনিক গান গাই। বিয়ের পর আমার স্বামীর (শান্তি সেনগুপ্ত) উৎসাহেই আধুনিক গাইতে শুরু করি।

পত্রিকা: সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় কিছু বলেননি কখনও?
বনশ্রী: হাওড়া সালকিয়া ব্যায়াম সমিতির অনুষ্ঠানে গান গাইতে গিয়েছি। দেখলাম বসার তেমন কোনও জায়গা নেই। সন্ধ্যাদিও মনমতো বসার জায়গা না পেয়ে কোনও এক বাড়ির সিঁড়ির তলায় বসে আছেন। আমি গিয়ে বসেছি মিউজিশিয়ানদের সঙ্গে, ভিড়ের মাঝে সকলে সিগারেট খাচ্ছে, কথা বলছে। সন্ধ্যাদি আমাকে ডাকলেন, বললেন, ওখানে সবার মাঝে বসবে না বনশ্রী, তুমি একজন আর্টিস্ট। ওই সিগারেটের ধোঁয়ায় তো তোমার গলাই খারাপ হয়ে যাবে। খুব খেয়াল রাখতেন আমার। কেবল তো গান গাওয়া নয়, জীবনটাকে সুরের আসনে বসিয়ে রাখার যে সাধনা তার কথা বলেছিলেন আমায়। আবার প্রতিমাদি (বন্দ্যোপাধ্যায়) ছিলেন অন্যরকম। খুব গল্প করতেন। প্রায়ই একটা কথা বলতেন। গানের টাকা সোনা করে রাখো কাজে পরে আসবে।

পত্রিকা: কে আপনাকে ফরেস্ট বিউটি বলতেন?
(চোখ কপালে তুলে হেসে) ওহ! নির্মলাদি (নির্মলা মিশ্র)। এমন কেন বলছ? বললেন, বা রে বনশ্রী মানেই তো বনের শ্রী। ফরেস্ট বিউটি। খুব স্নেহ করতেন। ওঁর সাজ, হাঁটাচলায় এমন একটা ব্যাপার ছিল ভিড়ের মধ্যেও আলাদা করে চেনা যেত ওঁকে। আসলে তখন সকলেই সকলের দিদি, বোন, বন্ধু।

পত্রিকা: তা’হলে বলতে চান আপনাদের সময় কোনও প্রতিযোগিতা বা ঈর্ষা ছিল না?
বনশ্রী: দেখুন ঈর্ষা বা পিছনে কারওর সমালোচনা এ বিষয়টা সত্যিই একেবারেই ছিল না। উল্টে গান গাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আড্ডার একটা ব্যাপার থাকত। আর যার যাকে যা বলার মুখের ওপরেই বলত। হেমন্তদা হয়তো বললেন তোর গানের স্কেলটা একটু নামিয়ে গা। সেটাই শুনতাম। পরিবেশটাই তখন আলাদা ছিল। সাংবাদিকরা আমাদের গান শুনে যা লিখতেন সেটাই মেনে নিতাম আমরা। সাংবাদিকদের প্রতিও আমরা এতটা বিশ্বস্ত ছিলাম।

Advertisement

পত্রিকা: আর এখন?
বনশ্রী: কী আর বলব? পরিবর্তন তো হবেই।

পত্রিকা: পরিবর্তনটা কেমন লাগে?
বনশ্রী: আমি কাউকে অসম্মান করতে চাইনি কখনও।

পত্রিকা: আজকের গান কেমন লাগে তো বলবেন...
বনশ্রী: রূপঙ্কর ভাল কাজ করছে। নচিকেতা, কবীর সুমনের গান লোকে ভীষণ ভাল ভাবে নিয়েছে। লোপার (লোপামুদ্রা মিত্র) গায়কিটাও বোল্ড।



পত্রিকা: আর?
বনশ্রী: দেখুন, এখন প্রচুর গান হচ্ছে। লোকে কোনটা শুনবে? কী করবে? দিগ্ভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। আমাদের সময় দুটো গান রেকর্ড হত। লোকের তিন নম্বর গান শোনার জন্য একটা খিদে থাকত। এই অপেক্ষাটা খুব জরুরি। আর শিল্পীদের পারস্পরিক যোগাযোগ নেই। আজও কোনও অনুষ্ঠানে হৈমন্তী, আমি আর নির্মলাদি থাকলে একসঙ্গে বসার জায়গা না পেলেও একে ওকে ঠেলেঠুলে ঠিক পাশাপাশি বসার জায়গা করে নিই। এখন জানতেই পারি না আমার সঙ্গে আর কোন কোন শিল্পী গাইবেন, সব আলাদা ঘরে একা বসে আছে। একটানা গানও নেই, নাটক হল তার পরে গান....গানকে ঘিরে, গানের মানুষগুলোকে ঘিরে আলো নেই। আলো সব স্টেজে।

পত্রিকা: পুজোর দুটো গানের রেকর্ড দিয়েই বনশ্রী সেনগুপ্তকে সকলে চেনে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে সেই পুজোর গান গাওয়ার অভিজ্ঞতাটা কেমন?
বনশ্রী: (একমুখ হাসি নিয়ে) দেখা হলেই হেমন্তদা প্রথম প্রশ্ন করতেন, কী রে? ক’টা ফাংশন? ওঁর সেদিন হয়ত একটাই অনুষ্ঠান, অত বড় স্টার! কিন্তু আমাকে আগে গেয়ে নিতে বললেন। ওঁর সুরে পুজোর গান গাইব ঠিক হল। তখন ওঁর বাড়িতে গিয়ে গান তুলে আসতে হত। দেখলাম গানের কোনও আলাদা ঘর নেই। খুব সিম্পল। একটা সোফা চেয়ার টেবিল। ‘আর এক নতুন কোনও পৃথিবীর খোঁজে’ ‘রাংতা ঝরে রুপো ঝরে’ এই দুটো গান গাইব। ঘড়ি ধরে পৌঁছলাম এইচ এম ভি-র স্টুডিয়োয়। খুব পাংচুয়াল ছিলেন হেমন্তদা। দেখলাম সব রেডি। একবার গাইলাম, হাত তুলে বললেন ‘টেক’। ভাল মন্দ কিছুই বললেন না, বললেন ‘নেক্সট’। তারপর বেরিয়ে গেলেন স্টুডিয়ো ছেড়ে। আমি তো ছুট লাগালাম। বললাম, কিছু তো বললেন না গান ঠিক ছিল? বললেন, আমার বলার নেই কিছু। তোর নামে তো স্টুডিয়ো বুকড্ আজ, গা যত খুশি। কিন্তু রেকর্ডিস্ট-কে বলে দিয়েছিলেন আর গানটা নেওয়ার দরকার নেই।

পত্রিকা: মান্না দে-র সঙ্গে ডুয়েট গাইতে ভয় করেনি?
বনশ্রী: নাহ্। আসলে যে গানে অভিনয় থাকত সে গানের জন্যই আমার ডাক পড়ত। সুধীনদার কাছে ‘ময়নামতী পথের ধারে’ গানটা তুলে আমি তো রেডি। তপন সিনহার ছবি, ‘হারমোনিয়াম’। মান্নাদা সোজা মুম্বই থেকে স্টুডিয়োতে এসে নিজে স্বরলিপি করলেন। লাইভ হল রেকর্ডিং। গান শেষ হতেই বললেন ‘বেড়ে! বেড়ে হয়েছে’। মান্নাদা খুব মজার মানুষ ছিলেন। আমি পাঁঠার মাংস খেতে খুব ভালবাসতাম। একবার এক নেমন্তন্ন বাড়িতে প্লেট ভর্তি করে পাঁঠার মাংস খাচ্ছি, মান্নাদা সেটা দেখে আমার স্বামীকে বললেন, ‘শুনুন মশাই, এ তো দু’মাসের মাংস একদিনে খাচ্ছে! খবরদার এত মাংস খেতে দেবেন না, গানের বারোটা বাজবে।’

পত্রিকা: অজয় চক্রবর্তী একবার নাকি আপনাকে ‘পাগল’ বলেছিলেন...
বনশ্রী: শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চার জন্য মান্নাদা অজয়ের কাছে আমায় পাঠিয়েছিলেন। অজয় শুনে বলেছিল, তুমি তো পাগল আর মান্নাদা একটা বদ্ধ পাগল। বাবার থেকে লুকিয়ে হাফ প্যান্ট পরে যাঁর ‘হীরা ফেলে কাঁচ’ শুনতাম তাঁকে আমি কী গান শেখাব?

পত্রিকা: আচ্ছা, আপশোস হয় না? মনে হয় না বনশ্রী সেনগুপ্ত ‘হীরা ফেলে কাঁচ’-এ আটকে গেলেন? নতুন গান করতে ইচ্ছে হয় না?
বনশ্রী: নাহ্, তেমন সুর আর পাব না, জানি আমি। আর স্টেজে নতুন গান গাইতে চাইলেও লোকে ওই গানই তো শুনতে চায়। তবে সুচিত্রা সেনের লিপে আমার গান নেই। এটা আমার একটা দুঃখের জায়গা। সন্ধ্যাদি আর আরতিদিরা (মুখোপাধ্যায়) এক্ষেত্রে সত্যি লাকি। নায়িকার লিপে সত্যি তেমন ক্যাচি গান কিন্তু আমি পাইনি... (জানালার বাইরে দেখতে দেখতে) আসলে শিল্পী তো! মন ভরে না কিছুতেই...

পত্রিকা: মনখারাপ হয়? কিছু মিস করেন?
বনশ্রী: (মাথা নিচু...মনে হল কিছু আড়াল করতে চাইছেন...) ভেবেছিলাম বলব না আপনাকে, আসলে ওঁর কথা বলতে চাই না...হঠাৎ করে চলে গেল....যাওয়ার কথাই নয়....ভুল চিকিৎসায়....আমার স্বামী। ও না থাকলে হয়তো অজ পাড়াগাঁয়ের মেয়ে হয়ে পড়ে থাকতাম। আমার গানের যা কিছু ওঁর জন্যই...টেবিলের তলা থেকে ছবি বার করলেন...দেখতে চাই না। আমি...দেখতে চাই না আর.....কেবল গান করতে যাওয়ার আগে দেখে নিই একবার...

Advertisement

বাইরের আকাশভাঙা অঝোর শ্রাবণ তাঁর মুখ ভরিয়ে দিয়েছে ততক্ষণে..আর সেই চোখের জলে ভেসে যাওয়া দিনের ছায়ামুখ নিয়ে সন্ধে নামল বাদলা আকাশে...

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement