কথা ও সুর— রবীন্দ্রসঙ্গীত অনুশীলন/ অনুসন্ধান’ এই সংস্থার উদ্যোগে রবীন্দ্র সঙ্গীতাচার্য শৈলজারঞ্জন মজুমদারের ১১৪ তম ও রবীন্দ্র নাট্যাচার্য শম্ভু মিত্রের শততম জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠান পালিত হল রবীন্দ্রসদন প্রেক্ষাগৃহে। অনুষ্ঠানের প্রারম্ভে শৈলজারঞ্জনের প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপির একটি গান ‘মম মন উপবনে চলে অভিসারে’ সম্মেলক কণ্ঠে পরিবেশন করেন সংস্থার গায়ক-গায়িকারা। এর পর সংস্থার কর্ণধার সঞ্জয় গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর স্বাগত ভাষণে রবীন্দ্র শিল্পকর্মের দুই রূপকার সম্বন্ধে কিছু তথ্যসমৃদ্ধ বক্তব্য রাখেন। পরে সংস্থার শিল্পীরা শম্ভু মিত্র অভিনীত ও নির্দেশিত রবীন্দ্রনাটকের সঙ্গীতসমৃদ্ধ ‘নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু’ আলেখ্যগীতি পরিবেশন করেন। মূলত ‘চার অধ্যায়’, ‘রক্তকরবী’, ‘রাজা ও রাণী’, এবং ‘ডাকঘর’ এই চারটি সংলাপ নাটকের কিছু নির্বাচিত অংশের কথোপকথন ও গান ছিল এই পর্বে।
রক্তকরবীর আসল দ্বন্দ্বটা হল মানুষের সঙ্গে যন্ত্রের, প্রাণের সঙ্গে জড় বস্তুর, প্রেমের সঙ্গে লুব্ধ প্রচেষ্টার। যক্ষপুরীর রাজা পাতালের অন্ধকারে স্বেচ্ছায় আবদ্ধ, নন্দিনী পৃথিবীর উপরের মুক্ত জীবনের ও আলোর সন্ধান নিয়ে রাজার কাছে আসে। প্রাণের গতিবেগকে, প্রেমের গতিবেগকে মেনে নিতে বা স্বীকার করে নিতে রাজার অন্তর্দ্বন্দ্ব ফুটে ওঠে নন্দিনীর সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের ভিতর দিয়ে। রেকর্ডে ধৃত এই সংলাপ যা শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্রের চরিত্রাভিনয়ের মধ্য দিয়ে অমর হয়ে আছে সেই অংশগুলি রেকর্ডের মাধ্যমে পরিবেশিত হয়েছিল, যেটি খুব প্রাসঙ্গিক। সঙ্গীত ও সংলাপ দুইই স্বচ্ছ পরিবেশন। তানপুরা, এস্রাজ, বাঁশি, মন্দিরা ও তবলা— এই ছিল অনুষঙ্গ যন্ত্র। বিভিন্ন রকম যন্ত্র এবং যন্ত্রীদের কোলাহল থেকে মুক্তি মিলল। যোগ্য রচনা, নির্দেশনা ও পরিবেশন।
এর পর সমবেত এস্রাজ ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’ রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর বাদন। ইদানীং অনেক রকমের বাদ্যযন্ত্রের সমাবেশে ‘এস্রাজ’ বাদ্যযন্ত্রটি লুপ্তপ্রায়। অথচ যথাযথ রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনের ক্ষেত্রে ‘এস্রাজ’ অপরিহার্য। এর পর ‘ব্যথার বাঁশি আনন্দগান’ শীর্ষক নির্বাচিত কিছু গান ও সঙ্গে স্মৃতিচারণ করেন সঞ্জয় গঙ্গোপাধ্যায়। ১৩টি গান পরিবেশন করেন। নির্বাচনেও বোধের ছাপ স্পষ্ট। এক সময় লক্ষ করা যাচ্ছিল গানের অবসান, যেখানে সেটি কোনও ভাবেই অর্থবহ নয়। বিশ্বভারতী স্বরলিপি বিভাগ এই বিষয়ে কয়েক জন বিশেষজ্ঞ নিয়ে কাজ শুরু করেছিল। জানি না কতখানি এই কাজ এগলো। সেদিন গায়ক এই দিকটাতে বিশেষ ভাবে লক্ষ রেখে সঙ্গীত অবসান যেন অর্থবহ হয় তার চেষ্টা করেছেন। কিছু কথা ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে’ এই গানটির! আমায় কেন বসিয়ে রাখো’ এই অংশের ‘আমায় কেন’র পরিবেশিত সুরটি যদিও স্বরলিপিতে রয়েছে তথাপি শৈলজারঞ্জনের অনেক ছাত্রছাত্রীর কণ্ঠে গীত সুরের সঙ্গে এই সুরটির মিল পাওয়া যায় না। দ্বিতীয়ত ‘তোমায় গান শোনাব’ এই গানটিতে ‘কান্নাধারার’ স্থলে ‘কান্নাহাসির’ উচ্চারিত হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে গায়কের বিশ্লেষণ ‘কান্নাধারার’ কথাটি শুধু বয়ে যাওয়া বোঝায়। কিন্তু ‘কান্নাহাসি’ থাকলে ঢেউয়ের মতো অনুভূতি হয়। তাই ‘কান্নাহাসির’ কথাটিই এখানে উপযুক্ত মনে হয়। গীতবিতানে উল্লিখিত বাণী ও স্বরবিতানে স্বরের তলায় বাণীর মধ্যে অনেক সময় পার্থক্য লক্ষ করা যায়। শোনা যায় এটাই নিয়ম যে সুরের সঙ্গে যেহেতু বাণীর সম্পর্ক তাই স্বরের নীচের বাণীগুলিই গানের বাণীরূপে চিহ্নিত করা হয়। ‘আমার বোধ হচ্ছে’ এই কথা বলে যদি বিভিন্ন জন বিভিন্ন ভাবে তাঁর নিজস্ব বোধ থেকে বাণীর পরিবর্তন করেন তাহলে আসল স্থান থেকে আমরা অনেক দূরে সরে যাব যা রবীন্দ্রনাথ কখনওই চাননি।
তাঁর গান এখনও
কান্তকবির ১৫০ তম জন্মদিবস উপলক্ষে শিশিরমঞ্চে অনুষ্ঠিত হল ‘তব চরণ নিম্নে’। সমবেত সঙ্গীতে অংশগ্রহণে নিয়েছিলেন সংযুক্তা ভাদুড়ি, মৈত্রেয়ী ভাদুড়ি, অরিজিৎ রায়চৌধুরী প্রমুখ। পরে সংযুক্তা গাইলেন ‘তব চরণ চিহ্নে’। মৈত্রেয়ী ভাদুড়ি গাইলেন ‘স্থান দিও করুণায়’। অরিজিত রায়চৌধুরী কণ্ঠে ‘মা আমি যেমন তোর’ গানটি বেশ উপভোগ্য। এ দিন উজ্জ্বল ভট্টাচার্যের পাঠ বেশ নজর কাড়ে। অগ্নিবীণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাজারের হুদ্দা’ এবং ‘যদি কুমড়োর মতো’ গান দু’টি অনেক দিন পরে শোনা গেল। ১৯০৯ সালে দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন কান্তকবি। তাঁর লেখা ‘বেলা যে ফুরায়ে যায়’ রীণাদোলন গাইলেন আন্তরিকতার সঙ্গে। অতুলপ্রসাদের গানে ভগবত প্রেম ফুটে ওঠে অরিজিত রায়চৌধুরীর ‘আমার এ আঁধারে’ গানটিতে। টপ্পা ও খেয়ালের সংমিশ্রণে দ্বিজেন্দ্রগীতি ‘নীল আকাশের অসীম’ গানটি এ দিনের সেরা প্রাপ্তি।
সুরেলা কণ্ঠে
বাণীচক্রের নিবেদন ‘রিমিকি রিমিকি ঝরে’ অনুষ্ঠানের সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন সুব্রত সেনগুপ্ত। এ দিন সুব্রত তাঁর সুরেলা কণ্ঠে বেশ কয়েকটি গান শোনালেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘আমার প্রিয়ার ছায়ায়’, ‘এমন দিনে তারে’, ‘তিমির অবগুণ্ঠনে’ প্রভৃতি। এ ছাড়াও এ দিন গাইলেন সংস্থার ছাত্রছাত্রীরাও। ভাল গাইলেন অর্কপত্রা ভট্টাচার্য, অর্পিতা মেটিয়া, ইন্দ্রাণী বসু, অপরাজিতা রায় প্রমুখ। সংযোজনায় ছিলেন সুকুমার ঘোষ।