দুটো দিন প্রতিদিন

নামেই দুই দিনের গল্প। আসলে জীবন জুড়েই রয়েছে কাহিনির প্রবাহ। ‘পঞ্চম বৈদিক’-এর নতুন নাটকের মহলা দেখলেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়।আরও তুচ্ছ জিনিসের, আরও মৌলিক অনুভূতির ইতিহাস চাই। বলেছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তাঁর ‘অপরাজিত’ উপন্যাসে। ব্রাত্য বসুর লেখা নতুন নাটক ‘দুটো দিন’-এর মহলা ওই বাক্যবন্ধকে মনে করিয়ে দিল। প্রযোজনায় ‘পঞ্চম বৈদিক’। পরিচালনায় অর্পিতা ঘোষ। প্রথম শো ১২ নভেম্বর, একাডেমি, সন্ধে সাড়ে ছ’টা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০২
Share:

মহলায় দেবশঙ্করের সঙ্গে পৌলমী ও অর্পিতা। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।

আরও তুচ্ছ জিনিসের, আরও মৌলিক অনুভূতির ইতিহাস চাই।

Advertisement

বলেছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তাঁর ‘অপরাজিত’ উপন্যাসে।

ব্রাত্য বসুর লেখা নতুন নাটক ‘দুটো দিন’-এর মহলা ওই বাক্যবন্ধকে মনে করিয়ে দিল। প্রযোজনায় ‘পঞ্চম বৈদিক’। পরিচালনায় অর্পিতা ঘোষ। প্রথম শো ১২ নভেম্বর, একাডেমি, সন্ধে সাড়ে ছ’টা।

Advertisement

এ নাটক ব্রাত্যর ‘১৭ই জুলাই’, ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ কী ‘রুদ্ধসঙ্গীত’ নয়, যেখানে গবেষক-নাট্যকার রাজনৈতিক ধারাবিবরণী দিতে দিতে সময়ের জাল বোনেন।

এ তাঁর ‘ভাইরাস এম’ নয়, যেখানে গূঢ় সামাজিক তত্ত্বের কাটাছেঁড়া চলে।

এ নাটক ব্রাত্যর ‘শহরইয়ার’, ‘হেমলাট’ কী ‘আলতাফ গোমস’ও নয়, যেখানে মুড়িমুড়কির মতো অন্ত্যজ ভাষার লাফালাফি হয়।

আবার ‘মুখোমুখি বসিবার’-এর মতো কাব্যময়তাও এখানে অনুপস্থিত।

বদলে কী আছে?

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় কী বিমল করের মতো মানবিক সম্পর্কের ওপর সার্চলাইট ফেলা। তার তরঙ্গে গা-ভাসান দেওয়া কাহিনি।

আবার আছে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের মতো পাশাপাশি বাস করা মানুষের নির্লিপ্ততা, একা হয়ে যাওয়ার ভাষ্য।

কখনও’বা অজয় কর কী তপন সিংহর ছবির নাটকীয়তা।

তার সঙ্গে অনেকটা চেখোভিয়ান স্টাইলে একটা সময়ের ভেতর নতুন সময় জন্ম নেওয়ার কথাও।

শেষমেশ এ নাটক স্বীকারোক্তির গল্প বলে। নিজের অক্ষমতা, সীমাবদ্ধতা, অপারগতা গোপন করার বদলে তাকে উগরে দিয়ে পাপ ধুতে চাওয়ার কাহিনি শোনায়।

আর এই চলনের মধ্যেই ভেসে ওঠেন বিভূতিভূষণ, তুচ্ছ জিনিস আর মৌলিক অনুভূতির ছোঁওয়া নিয়ে।

ব্রাত্যর নাটকের চরিত্র কখনই গোল-গোল হয় না, বরং তারা অধিকাংশই অসম্পূর্ণ, আধাখ্যাঁচড়া। কিন্তু তার মধ্যেও একটা আভিজাত্যের মোড়ক থাকে। এই প্রথম বার বোধহয় সেই চৌহদ্দি থেকে নিজেকে উপড়ে এনে অনভিজাত একটি পরিবারের কাহিনি বললেন তিনি।

তাঁর নাটক নিয়ে প্রথম বার কাজে নেমেছেন পরিচালক অর্পিতা। ‘পশুখামার’ করে লাইমলাইটে আসা অর্পিতা, এ পর্যন্ত যা কাজ করেছেন তার অধিকাংশই ক্লাসিকস্‌। এই প্রথম বার তাঁর সমকালের বড় মাপের কোনও নাট্যকারকে নিয়ে থিয়েটার, এমনকী কোনও নিপাট সামাজিক কাহিনিতে হাত রাখা। ফলে এই থিয়েটারের সাফল্য-অসাফল্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর পরিচালক-জীবনের বড় বাঁক।

গোড়াতেই গল্পের আঁচটা ধরিয়ে দেয় প্রায়-নিটোল একটি সেট (দেবাশিস রায়)। ম্যাড়ম্যাড়ে দেওয়াল, আলমারি, সোফা, একচিলতে খাট। তার মাথায় দড়িতে ঝুলিয়ে রাখা লুঙ্গি, ফতুয়া, গামছা।

ঘরের এক কোণে উঁকি মারে রেকর্ড প্লেয়ার, তো অন্য কোণে গ্যাসের সিলিন্ডার। তার ওপর রাখা ঝুড়িতে কাঁচা আনাজপাতি।

সব মিলিয়ে ঝট করে ঘাই মেরে যায় মৃণাল সেনের ছবিতে দেখা মধ্যবিত্ত অগোছালো সংসারের চালচিত্র।

কাহিনির কেন্দ্রে আছেন বাড়ির কর্তা অতুল (দেবশঙ্কর হালদার)। সত্তর-বাহাত্তর বছরের এই বৃদ্ধ আদ্যন্ত ন্যালাখ্যাপা একজন মানুষ। বিপত্নীক। স্ত্রীর স্মৃতি রোমন্থন করে, গহরজান, ফৈয়াজ খান, পঙ্কজ মল্লিকের গান আর নিজের বিয়েতে সানাইয়ের যে সুরটা বেজেছিল, তাকে নিয়েই তিনি ঘোরের মধ্যে দিন কাটান। স্বগতোক্তি করেন।

অতুলের দুই মেয়ে ললিতা (অর্পিতা ঘোষ) আর রণিতা (পৌলমী বসু)।

ললিতা বিধবা। বাবার কাছেই থাকেন। খানিকটা মানসিক ভারসাম্যহীন। সব সময় ঘোরতর অনিশ্চয়তার ভয় তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়। মাঝে মাঝেই তিনি ভেবে বসেন বাইরে থিকথিকে লোকে ঠাসা পৃথিবীটা তাঁর বাড়ির মধ্যে ঢুকে সব লন্ডভন্ড করে দেবে।

রণিতা বিবাহিতা। কিন্তু স্বামী উজ্জ্বলের (সোহন বন্দ্যোপাধ্যায়) অতি-নারীসঙ্গে তিনি বিধ্বস্তা। যে দিন রণিতা স্বামীঘর ছেড়ে বাবার বাড়িতে গিয়ে ওঠেন, সে দিন থেকেই নাটকের শুরু। শেষ তার পরের দিনের কাহিনিতে গড়িয়ে। রণিতার একমাত্র লক্ষ্য তাঁর দুশ্চরিত্র বরকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া।

এ বাড়িতে বাস করা হাতে গোনা এই ক’টিই মানুষ। কিন্তু স্বভাবে, অভাবে, চাহিদায়, যন্ত্রণায়, আশঙ্কায় এঁরা অধিকাংশ সময়ই একে অন্যের সমান্তরালে দাঁড়িয়ে। আর সেই সময়টুকুর বাইরে যখনই এদের কাটাকাটি হয়, তখনই ছিলার মতো ছিটকে বেরোয় বহু দিনের জমে থাকা ক্ষোভ, হতাশা, রাগ, বিরক্তি।

দেখতে বসে এক-একটা সময় মনে হয় ‘সায়ক’-এর নাটক চলছে। মেঘনাদ ভট্টাচার্যীয় ঘরানায় পাল্টাচ্ছে দৃশ্যপট। তার পরই ধারণাটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে, যখন কাহিনিতে মুহুর্মুহু ঘটনা আছড়ে পড়ে না। উল্টে এক ধরনের পরাবাস্তবতা, মিস্টিসিজমে সওয়ার হয় নাটকের চরিত্র। আপাত সরল গদ্যের আড়ালে বাঁকা শব্দে সংলাপ চলে অহরহ।

দুর্ধর্ষ কাজ করছেন দেবশঙ্কর হালদার। অনভিজাত, ম্যাদম্যাদে, ভীরু, কিছুটা’বা আত্মসুখী, কখনওবা লোভাতুর একজন বৃদ্ধকে ফুটিয়ে তুলতে অদ্ভুত একটা গলার স্বর এনেছেন তিনি। তার সঙ্গে জিবের জড়তা, হাত-পা-মুখের সঞ্চালনে জুড়ে দিয়েছেন বেশ কিছু ম্যানারিজম। সম্প্রতি কোনও চরিত্রর জন্য নিজেকে এতটা ভাঙতে তাঁকে কি দেখা গেছে? হয়তো বা না।

পাল্লা দিয়ে অভিনয় করে বড় আশা জাগিয়েছেন পৌলমী। বিশেষ করে গুমরে ওঠা কান্না চাপা গলায় একের পর এক সংলাপে তিনি আশাতীত ভাবে স্বাভাবিক। ‘রুদ্ধসঙ্গীত’ তো বটেই, ‘সিনেমার মতো’ বা ‘কে’-এর জড়সড় ভাবটা ঝেড়ে পৌলমী তাঁর পাঁচ নম্বর অভিনয়ে তুলনায় অনেক পরিণত।

চরিত্র নির্মাণে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে অর্পিতা, কিছুটা সোহনও। আসলে ব্রাত্যর নাটকে চরিত্র গড়াতে গড়াতেই অদ্ভুত কিছু উত্তরণ ঘটায়। সংলাপের গড়ন সেখানে হঠাত্‌ই চলে যায় অন্য তারে। তাকে বিশ্বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে না পারলে চূড়ান্ত অবাস্তব মনে হতে পারে। তখন দায় চেপে যায় নাট্যকারের ঘাড়ে।

অথচ এই উত্তরণকে যথাযথ মিলিয়ে দিলে, তার জারনকে বাগে আনতে পারলে উল্লম্ফন হয়ে যায় গোটা নাটকেরই।

ভারসাম্যহীন ললিতার এ ঝুঁকি পায়ে পায়ে। দুশ্চরিত্র উজ্জ্বল যখন অন্তর্গত কথা বলে নিজেকে প্রকাশ করে, সেখানেও এই ঝুঁকি প্রবল। তাকে কাটিয়ে তোলার ওপর দাঁড়িয়ে এ-নাটকের ক্লাইম্যাক্স।

নাট্যকারেরই হাতে ধরে এখানে প্রায় চরিত্র হয়ে উঠছে আবহ (দিশারী চক্রবর্তী)। আর অবশ্যই আলো (জয় সেন)। থেকে থেকেই যখন বেজে ওঠে মুলতানি রাগ, সানাইয়ের সুর, গহরজানের গলা আর পাকড়ে ধরে আলোর জাদু (জয় সেন), আবেগী মনকে বাগে রাখা তখন বিড়ম্বনা বইকী!

তুচ্ছ জিনিসের, মৌলিক অনুভূতির ইতিহাস জন্ম নিল কি না, তা নিয়ে তর্ক চলতেই পারে, কিন্তু ‘দুটো দিন’ কোথায় যেন হৃত্‌পিণ্ডে এসে কড়া নাড়ার, চোখের তারা ঝাপসা করে দেওয়া এলোমেলো ঝোড়ো হাওয়া, এ নিয়ে কোনও সংশয় নেই। থাকতে পারে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন