স্মরণ ৩

বামশিবির বহুবার কুত্‌সা করেছে ওঁকে

মুখ খুললেন শাঁওলী মিত্রসত্যি কথা যদি স্বীকার করতে হয়, তাহলে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলতে হয়কমিউনিস্ট পার্টি কখনওই শম্ভু মিত্রকে নস্যাত্‌ করবার চেষ্টা ছাড়েনি। এ কথা এইজন্যেই বলাখুব সম্প্রতি একজন অনুগত পার্টি সদস্য শম্ভু মিত্র সম্পর্কে একটি বই প্রকাশ করেছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৪ ০০:০০
Share:

কন্যার সঙ্গে।

(কংগ্রেস নেতা হুমায়ুন কবীরের আমন্ত্রণে শম্ভু মিত্র একটি ‘সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান’-এ কবিতা আবৃত্তি করতে যান। তা নিয়ে বামপন্থী মহলে তাঁর ‘বন্ধু’-দের মধ্যে প্রচুর বিতর্ক তৈরি হয়। সেই বিতর্কের শ্লেষ অনেকটাই প্রকাশ পায় ‘পরিচয়’ পত্রিকার একটি প্রবন্ধে। ১৩৬৮-র পত্রিকার ফাল্গুন সংখ্যায় যে প্রবন্ধ লেখেন তখনকার সম্পাদক গোপাল হালদার। ‘সংস্কৃতি সংবাদ’ বিভাগে। শিরোনাম ছিল ‘ক্যাজুয়েলটি’। তার জবাবও দেন শম্ভু মিত্র। এ দুটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে মিত্র-কন্যা এই নিবন্ধটি লেখেন।)

Advertisement

সত্যি কথা যদি স্বীকার করতে হয়, তাহলে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলতে হয়কমিউনিস্ট পার্টি কখনওই শম্ভু মিত্রকে নস্যাত্‌ করবার চেষ্টা ছাড়েনি। এ কথা এইজন্যেই বলাখুব সম্প্রতি একজন অনুগত পার্টি সদস্য শম্ভু মিত্র সম্পর্কে একটি বই প্রকাশ করেছেন। তাতে তিনি অনায়াসে লিখেছেন, গণনাট্য সংঘ এবং কমিউনিস্ট পার্টি কখনওই শম্ভু মিত্র-র বিরুদ্ধে কোনও কুত্‌সা করেননি। তাঁরা বরং অপর পক্ষের দোষারোপ নীরবে সহ্য করেছেন!কী উত্তর হবে এই মিথ্যাভাষণের? বইটি যে কোনও কারণেই হোক শম্ভু মিত্র-র কন্যাকে উত্‌সর্গ করা হয়েছে। আশ্চর্য ঘটনাই বটে!

Advertisement

বর্তমান লেখক শম্ভু মিত্র-র একটি জীবনীগ্রন্থ লিখেছে ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের অনুরোধে। তাতে অনেক সত্য কথা প্রকাশ করতে সে বাধ্য হয়েছে। সেই বইতে প্রকাশিত কিছু তথ্যের পুনরাবৃত্তি হয়তো এখানে ঘটবে। কিন্তু তা আমাদের মেনে নিতে হবে। এখানে আমাদের বিশেষ লক্ষ্য তাঁর সঙ্গে রাজনীতির সম্বন্ধ। আমাদের অন্যতম আলোচ্য বিষয় থিয়েটারের মাধ্যমে সমাজকে সচেতন করবার যে-ব্রত তিনি নিয়েছিলেনতা সত্যিই কতটা সত্‌ ছিল!

কারণ এর পরেই আমাদের উত্তর দিতে হবে ‘নবনাট্য আন্দোলনএ নামের শেষ হোক’এই কথাটা তিনি কীসের প্রেক্ষিতে, কেন বলেছিলেন। কারণ আমাদের সমাজের অনেক ‘বিদ্বজ্জন’ এখনও পর্যন্ত এসবের যে-ব্যাখ্যা উপস্থাপিত করে চলেন তা যেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই প্রেক্ষিতবিহীন বিকৃত ব্যাখ্যা। এ-সম্পর্কিত লেখাটিও খুব সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত হয়েছে।

তাঁর মৃত্যুর ১৫ বছর পরেও তাঁকে নিয়ে এই মিথ্যা এবং বিকৃত ভাষণ করতে হচ্ছে এও লক্ষণীয়!

১৯৬১-’৬২ নাগাদ, যখন নির্বাচন পুনরায় এগিয়ে এসেছে, তখন কংগ্রেস মন্ত্রী হুমায়ুন কবীরের আয়োজিত একটি সভায় তাঁর যোগদান নিয়ে কুত্‌সার ঢেউ তোলে পার্টি। মনে করলে মজা লাগতে পারে তখন তারা নিজেরাই দ্বিধাবিভক্ত এবং নিজেরাই নিজেদের মধ্যে দ্বিচারিতা করে চলেছে। তার জন্যে পার্টির সঙ্গে সম্পর্কিত নন এমন একজন শিল্পীকে তাঁদের আক্রমণ করতে বাধেনি। শুধু তিনিই নন, আক্রান্ত হয়েছিলেন উদয়শঙ্করের মতো ব্যক্তি, লেখক মনোজ বসু।

তখন কমিউনিস্ট পার্টির সাহিত্য পত্রিকা পরিচয়-এ তদানীন্তন খ্যাতনামা কমিউনিস্ট সাহিত্যিক গোপাল হালদার এই নিয়ে একটি কুত্‌সিত প্রতিবেদন লেখেন তাঁর মতো বয়োজ্যেষ্ঠ সাহিত্যিকের কলম থেকে লেখার এই ভাষা অপ্রত্যাশিত। সেই প্রতিবেদনে তিনি লিখেছিলেন,কংগ্রেস মন্ত্রীর কাছ থেকে অর্থ ও অন্য নানা সুবিধার বিনিময়ে শম্ভু মিত্র নিজের আদর্শকে জলাঞ্জলি দিলেন এবং তাঁর নির্বাচনী সভায় যোগদান করলেন।

শম্ভু মিত্রকে তাঁর সম্পর্কে নানা বিরূপ সমালোচনা নিয়ে প্রতিবাদ করতে আমরা খুব একটা দেখতে পাই না। কিন্তু এইবার তিনি পরিচয় কাগজে একটি প্রতিবাদ-পত্র লেখেন। তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, তিনি কোনও নির্বাচনী সভায় যাননি। গিয়েছিলেন একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করতে আমন্ত্রিত হয়ে।

তিনি তাঁর চিঠিতে এও জানান যে, একটি গণতান্ত্রিক দেশে যে-কোনও রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করবার অধিকার তাঁর রয়েছে। ফলে যদি তিনি তা-ই করতেনও, তাতেও তা নিয়ে কুত্‌সিত মন্তব্য করা পার্টির পক্ষে শোভা পায় না। পাল্টা আঘাত করে তিক্ত শম্ভু মিত্র লিখেছিলেন, ধরা যাক কোনও সভায় তিনি ‘গোপালদা’কে সমর্থন করতে গেলেন, তাহলে তো তিনি নিশ্চয়ই পার্টির কাছে মহত্‌ শিল্পী বলে স্বীকৃত হতেন!

শম্ভু মিত্র-র এই চিঠি থেকেই আমরা জানতে পারি, পথিক, চার অধ্যায়, দশচক্রপ্রত্যেকটি প্রযোজনার সময়ে পার্টি তাঁকে কী পরিমাণ কালিমালিপ্ত করেছে। তিনি এই চিঠিতে এ-অভিযোগও তুলেছেনবিশ্বভারতী যখন রক্তকরবী নাটক বন্ধ করে দিতে উদ্যত হয়েছিল, তখন তো কই পার্টির বন্ধুরা কেউ তাঁর পাশে দাঁড়াননি!

তাঁর চিঠি থেকে এ কথাও আমরা জানতে পারিপার্টির সমর্থিত দৈনিক কাগজে নাকি এই সময়ে লেখা হয়েছিল যে বিসর্জন নাটক মঞ্চস্থ করবার সময়ে শম্ভু মিত্র তাঁর নিজের রচনা রবীন্দ্রনাথের নাটকের মধ্যে জুড়ে দিয়েছেন। সে-কাজ করেছেন কিন্তু বিশ্ববরেণ্য চিত্র পরিচালক এবং তাঁকে অনুসরণ করে আরও কেউ কেউ। আর এখন তো সেটাই আরও স্বাভাবিক গতিপথ! কিন্তু শম্ভু মিত্র রবীন্দ্রনাথের ভাষার প্রতি এত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, তিনি এই কাজ কখনও করেননি। তিনি ভাবতেই পারতেন না এ কথা। অথচ তাঁর সম্পর্কেই কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র এরকম মিথ্যা অভিযোগ এনেছিলেন।

আরও জানতে পারি গোপাল হালদার মহাশয়ের ‘ক্যাজুয়েলটি’ লেখাটি প্রকাশ পাবার কয়েকটি সংখ্যা আগে কমিউনিস্ট পার্টি তাঁদের পরিচয় কাগজটিতে যে তাঁর সম্পর্কে মিথ্যা রচনায় তাঁকে ছোট করবার প্রয়াস হয়েছিল, তা এই চিঠি থেকে জানতে পারি। তাই খানিক অনুসন্ধান করা গেল। দেখা গেল তাতে লেখা হয়েছে ‘...সাম্প্রতিক কালে ‘বহুরূপী’ থেকেও যেন নেই। শম্ভু মিত্র মহাশয় ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণ ক’রে, তৃপ্তি মিত্র পেশাদারি নাটকে অভিনয় ক’রে এবং ‘বহুরূপী’র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বহু ব্যক্তি একে একে দল ছেড়ে হয়তো এই নাট্যপ্রতিষ্ঠানটিকে দুর্বল করে ফেলেছেন।...ক্বচিত্‌ দু-একটি অভিনয়, তাও পুরোনো নাটকের অভিনয় মারফত মাঝে মাঝে নিউ এম্পায়ার হলে ‘বহুরূপী’ নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখেছেন।...’

আমরা উল্লেখ করেছি ১৯৫৯ সালে বহুরূপী শম্ভু মিত্র-র নির্দেশনায় মুক্তধারা মঞ্চস্থ করেছিল। সে প্রযোজনা সাফল্য পায়নি সে কথা স্বতন্ত্র। ১৯৬০ সালেই কেবল বহুরূপীর নতুন কোনও প্রযোজনা হয়নি। কিন্তু ১৯৬১ সালে দু’টি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিলকাঞ্চনরঙ্গ এবং বিসর্জন। তবু এঁরা ওই উক্তি করলেন তাঁদের মুখপত্রে। এবং বহুরূপীর ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পেরেছি১৯৬০ সালে এই নাট্যগোষ্ঠী ওই সময়কালের মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক অভিনয় করেছিলেন।

তাই আমরা বুঝতে পারি কোনও সংঘ যদি ঠিক করে নেয় তারা মিথ্যাভাষণের দ্বারা কাউকে ‘হীন’ প্রতিপন্ন করবে, তাহলে সর্বৈব মিথ্যার আশ্রয় নিতে তাঁরা দ্বিধা করেন না।

কারণ বহুরূপী থেকে যখন অনেক মানুষ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন সে ১৯৫২-র কথা। তার পরে রক্তকরবী, পুতুল খেলা, এবং ১৯৬১-তে কাঞ্চনরঙ্গ এবং বিসর্জন অভিনয় করেছেন। এবং আর কোনও ভাঙনের ইতিহাস এই সময়ে নেই। তাহলে ‘একে একে চলে’ যাওয়ার কথাটিও মিথ্যাভাষণ!

অথচ যে-লেখাটিতে তাঁরা বলছেন ‘বহুরূপী থেকেও নেই...’ এই লেখাতেই এঁরা ’৬১-র ওই দুই প্রযোজনার কথা উল্লেখ করেছেন! এঁরা লিখেছেন, ‘...‘বিসর্জন’ প্রযোজনার দেখার সুযোগ এখনো আমরা অর্জন করিনি। তাই সে সম্পর্কে কোনো আলোচনা সম্ভব হল না। আমরা ভরসা রাখি ‘মুক্তধারা’-র মতো এ-নাটকটি ‘কাঞ্চনরঙ্গ’র বন্যায় তলিয়ে যাবে না।...’এ-বাক্য কি বিদ্বেষপ্রসূত রচনা নয়?

তবুও আজকের যুগে দাঁড়িয়ে কোনও এক কমিউনিস্ট ‘সাংস্কৃতিক কর্মী’ উচ্চারণ করেনকমিউনিস্ট পার্টি কখনওই শম্ভু মিত্র-র নামে বিষোদ্গার করেনি। খুব আশ্চর্য নয় কি? জানতে ইচ্ছে করে আজ কেন তাঁদের এ কথা বলতে হচ্ছে? তাহলে কি মৃত্যুর ১৫-১৬ বছর পরেও শম্ভু মিত্রকে ঠিক উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না?

যাঁদের নিজেদের নীতির ঠিক নেই, যাঁরা দেশের ভালর জন্যে কোনও সত্‌কাজে সহায় হতে পারেন না, যাঁরা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রকে গড়ে তোলবার চেষ্টা না করে, ‘পলিসি’কে প্রাধান্য দিতে নিজেদের অমন তৈরি-হয়ে-ওঠা গণনাট্য সংঘ-র অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলতে দ্বিধা করেন নাতাঁদের কাছে অপরের কুত্‌সা করা ছাড়া আর কোনও উপায় অবশিষ্ট থাকে না। এই ট্র্যাডিশন আজও চলেছে।

এমন-কী রাজনৈতিক সংগঠনকে সচল রাখতে বিদেশি প্রভুদের কাছে দরবার করে চলেন নিয়ত, সোভিয়েত রাশিয়ার কিংবা চিনদেশের নেতৃবৃন্দের কাছে যাঁদের ছুটতে হয় নিজেদের নীতি নির্ধারণের জন্য এবং সদস্য সংখ্যার জোরে নিজেদের ‘সদুদ্দেশ্য’ প্রমাণ করবার চেষ্টা করে চলেন অবিরততাঁরা যে কেমন করে ব্যক্তিমানুষের কুত্‌সায় তত্‌পর হয়ে ওঠেন তা এক আশ্চর্যের ঘটনা! আশ্চর্য কী? না! হয়তো এই-ই স্বাভাবিক!

আমাদের এই সূত্রে মনে পড়তে পারে ১৯৫৭-র পর থেকে পার্টির মধ্যে কত উপদল তৈরি হচ্ছিল। মনে পড়তে পারে ১৯৬১-১৯৬২-র সময়ে পার্টি নিজেই তার রাজনৈতিক সংগঠনকে শক্ত রাখতে পারছিল না। আর সেই সূত্রেই কিছু দিনের মধ্যেই কমিউনিস্ট পার্টিতে ভাঙন ধরল। ভাগ হয়ে গেল পার্টি! যারা নিজেদের মধ্যেই কলহ করে নিজেদের আদর্শকে অপমান করছিল, তারাই অপরের কাজের উচিত-অনুচিত নিয়ে কাগজে লেখালেখি করছিল।

এ কথা আজও সত্যি, একই রকম ভাবে ঘটে চলেছে। আর আজও ঘটছে বলেই ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য বলে মনে হল।

সৌজন্য: আনন্দ পাবলিশার্স (প্রকাশিতব্য একটি গ্রন্থের অংশবিশেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন