স্মরণ ১...

মাধ্যমিক বলে কি বিশ্বকাপ দেখবে না ছেলেটা

এমনই বলেছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বাগানের শিশু দেবদারু এখন ছিপছিপে তরুণ। ঘরময় নাতি-নাতনি টংলু ও ঝোরার কলকল। আর না-থেকেও আছেন গৃহকর্তা। ২৩ মার্চ ১৯৯৫, তাঁর শেষতম নিরুদ্দেশ-যাত্রার বিশ বছরে এক ছক ওলটপালট করা গার্হস্থ্যের গল্প বললেন শক্তি-জায়া মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়। শুনলেন ঋজু বসু।এমনই বলেছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বাগানের শিশু দেবদারু এখন ছিপছিপে তরুণ। ঘরময় নাতি-নাতনি টংলু ও ঝোরার কলকল। আর না-থেকেও আছেন গৃহকর্তা। ২৩ মার্চ ১৯৯৫, তাঁর শেষতম নিরুদ্দেশ-যাত্রার বিশ বছরে এক ছক ওলটপালট করা গার্হস্থ্যের গল্প বললেন শক্তি-জায়া মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়। শুনলেন ঋজু বসু।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৪ ১৩:১৭
Share:

পত্রিকা: বসার ঘরে এই পোড়ামাটির কাজটা তো চমৎকার...

Advertisement

মীনাক্ষী: আমাদের বন্ধু আলোকময় দত্ত করে দিয়েছিল। বিষ্ণুপুরের মন্দিরের সাজ থেকে নেওয়া। যুদ্ধের দৃশ্য। আলোক জ্যোতির্ময় দত্তের ভাই। গৌরদার (গৌরকিশোর ঘোষ) বাড়িতে, সুনীলের (গঙ্গোপাধ্যায়) বাড়িতেও করে দিয়েছিল। কিন্তু এ বাড়ির মতো সুন্দর কোথাও নেই।

পত্রিকা: বাগানটাও বেশ...

Advertisement

মীনাক্ষী: অগোছালো! কিন্তু আমাদের এমনই পছন্দ। হলিহক, থোকা গোলাপ, হলুদ জবা রয়েছে। দেবদারু, সুপুরি, আম—সব শক্তির শখে।

পত্রিকা: বাঃ শক্তি চট্টোপাধ্যায় যত্ন করে বাড়ি সাজিয়েছিলেন তো...

মীনাক্ষী: তাহলেই হয়েছে (হাসি)! বেলেঘাটার এই বাড়িটা কোঅপারেটিভের মাধ্যমে আমরা করেছিলাম। আমার তদারকিতেই হয়েছে। ওর বন্ধুরা এটা-সেটা করেছে। ও চুপচাপ বসে থেকেছে। শক্তির বেশির ভাগ বন্ধুই খুব ভাল। জীবনের শেষ ছ’টা বছর ও এখানে ছিল।

পত্রিকা: আর ওঁর সঙ্গে আপনার এত দিনের পথ চলা কতটা স্বচ্ছন্দে কাটল...

মীনাক্ষী: তা কী হয়...সাধারণত যেমন হয় স্বামী-স্ত্রী কোনও একটা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছে, বাড়ির বিষয়ে কথা বলছে আমাদের ঠিক তেমনি ছিল না। স্বামী হিসেবে তো ও খুব ডিপেন্ড করার মতো নয়...


৪ অক্টোবর ১৯৬৭, হিন্দুস্থান রোড

পত্রিকা: তা এমন একটা মানুষকে বিয়ে করে বসলেন কী ভাবে? তখন বোঝেননি?

মীনাক্ষী: চিন্তা হত, কী হবে! আমাদের বিয়ের সময়ে ও চাকরি করত না। বিজ্ঞাপনের কপিরাইটারের কাজ করে। আমি তখন স্কুলে পড়াই। তা আমি জানতাম, ও খুব ভাল কবিতা লেখে। ভাবলাম, আমি যখন চাকরি করি, একার রোজগারে তো চলে যেতেই পারে! সব সময়ে স্বামীই চাকরি করবে, স্ত্রী বসে থাকবে, তা-ই বা কেন হবে!

পত্রিকা: একটু পিছিয়ে গিয়ে বলুন না গল্পটা...

মীনাক্ষী: আমরা তখন দল বেঁধে কলকাতার এখানে-সেখানে বেড়াতে যাই। শক্তি, সুনীল (গঙ্গোপাধ্যায়), শরৎবাবুরা (মুখোপাধ্যায়) আমাদের থেকে অনেকটাই বড়। কিন্তু বন্ধুর মতো মিশত। মজা করত। আমরা এমএ পড়ার সময়ে মেয়েদের পত্রিকা বার করতাম। ওঁরা কবি। সেই হিসেবে পরিচয়। আমি একবার শিলচরে আমার বন্ধু রুচিরার কাছে গেছি! শক্তি বেশ ভাবপ্রকাশ করে চিঠি লিখল। তখনই বুঝলাম! দেখলাম, মজাটা তো আর মজা থাকছে না... বিপদে পড়ে গেছি।

পত্রিকা: তা কী করলেন?

মীনাক্ষী: রুচিরা বলল, মজা করেই এড়িয়ে যাও। এর কিছু দিন বাদে আবার শুনি, সবাই বলছে ১৫ অগস্ট না কি আমাদের বিয়ে! তখন আমরা দু’জনে বেরোই মাঝেমধ্যে, কিন্তু বিয়ের কথা তো ভাবিনি! গ্বালিয়র মনুমেন্টের কাছে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, এ-সব কী হচ্ছে! তা ও বলল, দিনটা তো ভাল! ছুটির দিন! সবাই আসতে-টাসতে পারবে!

পত্রিকা: (হাসি) কী কাণ্ড...

মীনাক্ষী: বললাম, আমি যদি মত না দিই। আমার মত নেওয়া তো দরকার ছিল। ও বলল, মত না-দিলে তোমায় গঙ্গার জলে ঠেলে দেব। তো আমি আর কী বলি, বুঝলাম বিয়েটা করতে হবে!

পত্রিকা: মেয়েদের মধ্যে কিন্তু পাড়ার সব থেকে বকাটে ছেলের প্রতি একটা আকর্ষণ কাজ করে! এটাও কি তা-ই!

মীনাক্ষী: (হাসি) ওই আর কি! তখন মাইকেল মধুসূদন দত্তের কথা মনে হত। ১৫ অগস্টই হল বিয়েটা। তবে আমার বাপের বাড়ি প্রথমে মেনে নেয়নি, তাই সোশ্যাল ম্যারেজ হল অক্টোবরে।

পত্রিকা: কত সালে?

মীনাক্ষী: ১৯৬৭। একটা জিনিস ভেবেছিলাম, এমনি যা-ই থাক, লোকটা খুব জেনুইন। এটা মনে হয়েছিল।

পত্রিকা: শেষ অবধি এই ধারণাটাই বজায় থাকল?

মীনাক্ষী: একসঙ্গে চলাটা খুব সোজা ছিল না। কিন্তু মৌলিক ধারণাটা পাল্টায়নি। উদাসীন প্রকৃতির ছিল। কিছুতে কিছু যেত আসত না!

পত্রিকা: একটা থিতু চাকরি তো কিছু দিন পর থেকেই করতেন।

মীনাক্ষী: মেয়ে হওয়ার বছরে ওর আনন্দবাজারে চাকরিটা হল। কিন্তু ওর ভরসায় থাকলে সংসারটা চলত না! আদ্ধেক মাসে তো মাইনেই আনত না। মাইনে পাওয়ার পরে কোথায় চলে গেল। তিন দিন বাদে ফিরল। আমায় সন্তোষদা (সন্তোষকুমার ঘোষ) বলেছিলেন, অফিস থেকে ওর মাইনেটা তুলতে। সে তিন-চার বার গেছি। কিন্তু খুব এমব্যারাসিং লাগত। আমি মধ্যশিক্ষা পর্ষদে চাকরি নিই। ওর ভরসায় চাকরি ছাড়া যেত না।

পত্রিকা: আর বাবা হিসেবে শক্তি কেমন ছিলেন...

মীনাক্ষী: বাবুই (কন্যা) ও তাতার (পুত্র) দু’জনকেই খুব ভালবাসত! স্নেহ ছিল। দায়িত্ব ছিল না।

সাহিত্য অকাদেমি পাওয়ার পর দিন

পত্রিকা: সে তো কোনও কোনও ভুলো বাবার বাচ্চাকে রাস্তায় ফেলে চলে আসার গল্পও শোনা যায়...

মীনাক্ষী: ও সেটাও করেছে। এই যেমন, আনন্দবাজারে নিয়ে যেত মেয়েকে। তার পরে একটু আসছি বলে চলে গেল! আসলে ও হয়তো দেখত ওর কোনও ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছে, যে পৌঁছে দেবে! কিংবা হয়তো কোনও বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে রেখে চলে গেল। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে, আমি চিন্তা করছি, এমন সময়ে কেউ মেয়েকে দিয়ে গেল।

পত্রিকা: আপনি ভরসা পেতেন ওঁর কাছে বাচ্চাদের ছাড়তে?

মীনাক্ষী: না! একবার তো সিউড়িতে রশিদের (আয়ান রশিদ খান) কাছে নিয়ে যাবে বলে মেয়েটাকে নিয়ে বেরিয়েছে। আমার হঠাৎ মনে হল, এ কী ভুল করলাম! অফিস থেকে প্রায় দৌড়তে দৌড়তে এসপ্ল্যানেড গিয়ে দেখি, তখনও বাস ছাড়েনি। সেই মেয়েকে নিয়ে আবার বাড়ি চলে এলাম।

পত্রিকা: উনি কিছু বললেন না!

মীনাক্ষী: ও বলার কে! (হাসি) আমি বললাম ওকে দিয়ে দাও। চুপচাপ তাই দিলও!

পত্রিকা: উনি নিজে কখনও ছেলেমেয়েদের শাসন করতেন না?

মীনাক্ষী: ছোটবেলায় একটু-আধটু ও পড়াত...এই ব্যাকরণ-ট্যাকরণ! পরের দিকে আমি হয়তো বললাম, ওরা পড়ছে না দেখো। কাল বাদে পরশু তাতারের পরীক্ষা, মাধ্যমিক। ও বলল, বিশ্বকাপ হচ্ছে সেটা দেখবে না! তা কী করে হয়! আর কী বলব! পড়াশোনা করাটা ওর কাছে প্রাইমারি ছিল না।

পত্রিকা: এটা শুনে তো নিশ্চয়ই আরও রাগ চড়ে যেত।

মীনাক্ষী: হ্যাঁ রাগ তো হত! আমি রাগ করতাম। ও করত না।

পত্রিকা: চেঁচিয়ে ঝগড়া করতেন?

মীনাক্ষী: আমি করতাম, ও করত না! ঝগড়া করতে করতে হঠাৎ দেখি, ও নেই! বাড়ি থেকেই কোথায় চলে গিয়েছে।

পত্রিকা: মানে ঝগড়া করে কোনও সুখ পেতেন না!

মীনাক্ষী: (হাসি) একদম না!

পত্রিকা: কবিতা না বুঝলেও লোকে তো এই আলোচনাটা করত, শক্তি খুব মদ খান, উড়নচণ্ডী, যা-খুশি করেন...তখন আপনার ছেলেমেয়েরাও বড় হচ্ছে! রাস্তাঘাটে এটা শুনলে কী ভাবে ট্যাক্ল করতেন।

মীনাক্ষী: ট্যাক্ল করা যেত না। লোকের সামনে আর কী বলব! আর বলেও যদি লাভ হত!

পত্রিকা: ছেলেময়েদের কখনও অভিমান হত না।

মীনাক্ষী: হ্যাঁ ওরাও তো অসুবিধে ভোগ করেছে, তাই না!

পত্রিকা: কীরকম অসুবিধে?

মীনাক্ষী: এই যে... হয়তো পরীক্ষার সময়... বাবা রাত-দুপুরে এসে হইহই করেছে। ওদের বন্ধুবান্ধবেরাও নিশ্চয়ই বলেছে কিছু। শুনতে হয়েছে তো!

পত্রিকা: বন্ধুবান্ধবেরা তো সবাই এটা বুঝবে না, ওদের বাবা কী সাংঘাতিক কবিতা লেখেন! ক’জন আর বুঝবে...

মীনাক্ষী: না, বুঝবে না কবিতা আর বাহ্যিক আচরণ, দু’টো এক নয়। কিন্তু ওদের পরীক্ষা এলে আমার টেনশন থাকত। তবে ছেলেমেয়েদের মাধ্যমিক-টাধ্যমিকে ও খুব একটা ঝামেলা করেনি!

পত্রিকা: মানে ওই সময়টা একটু শান্ত হয়ে বাড়ি ফিরতেন?

মীনাক্ষী: না, তা নয়! হয়তো ফিরলই না। ভাবল হয়তো, বাড়িতে ফিরলে বেশি অশান্তি হবে!

পত্রিকা: কিন্তু বাড়িতে না-ফিরলেও তো টেনশন...

মীনাক্ষী: না, না ও তো শুরু থেকেই এ রকম! প্রথম দিকে আমি কয়েকটা চেনা নম্বরে ফোন করতাম। ক’দিনই বা করব? ক’জনকেই বা করব? কোনও দিন সুনীলের বাড়ি। কোনও দিন শান্তি লাহিড়ির বা রসিদের বাড়ি। বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতেও অনেক হুজ্জতি করেছে। ওরা খাইয়ে-দাইয়ে ভাড়া দিয়ে ট্যাক্সিতে তুলে দিয়েছে।

পত্রিকা: একটা কথা বলুন, এই যে বোহেমিয়ান জীবনযাপন, মদ্যপান, যখন-তখন বাড়ি ফেরা, ইচ্ছেমতো নিরুদ্দেশ হওয়া ওঁর জীবনে কবিতা লেখার জন্য এ-সবের কতটা দরকার ছিল?

মীনাক্ষী: এটা তো আমি নয়, উনি বলতে পারতেন! তবে খুব মদ খেয়ে ওঁকে কবিতা লিখতে দেখিনি আমি কখনও।

পত্রিকা: কিন্তু পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে... তুরীয় অবস্থায় মধ্যরাতে ফুটপাথ বদলের যে অভিজ্ঞতা মদ্যপান না-করলে এটাই বা উনি কী ভাবে লিখতেন?

মীনাক্ষী: হ্যাঁ অভিজ্ঞতাটা হয়তো জরুরি ছিল। কিন্তু অ্যালকোহলিক হওয়াটা নয়। ৬১ বছর বয়সটা তো চলে যাবার বয়স ছিল না। সুনীল যেমন একটা ব্যালেন্স করতে পারত। লেখালেখি, মদ খাওয়া, বাইরে মেশার মধ্যে। শক্তির সেটা ছিল না। ও যেখানে শুরু করেছিল, থেকেই গেল সেখানে। শেষ পাঁচ-ছ’বছর ধরেই পার্কিনসন্সে ভুগছিল। তারপরে হার্ট অ্যাটাকটা হল, কোনও সুযোগ পেল না।

পত্রিকা: মদ্যপানের পরিণাম যা দেখছেন, তাতে অন্য কেউ বা সন্তানদের নিয়ে এ জাতীয় উৎকণ্ঠা আপনার মধ্যে কাজ করেনি?

মীনাক্ষী: বাড়িতে মদ নিয়ে যেহেতু অভিজ্ঞতাটা ভাল নয়, তাই একটু টেনশন তো হবেই। আমার মনে হয়, আমার ছেলেমেয়েদের মধ্যেও এমন একটা বোধ কাজ করেছে। মেয়ে তো কখনও ছোঁয়নি।

পত্রিকা: ওঁর সঙ্গে থাকতে থাকতে কখনও মনে হয়নি আর পারা যাচ্ছে না...বিয়েটা আর রাখা সম্ভব নয়!

মীনাক্ষী: দেখো, আমি অনেকবার ওকে এ রকম বলেছি! ও রাজি হয়নি। আমি চলে যেতাম, ও আবার আমার বাপের বাড়ি গিয়ে ডেকেডুকে নিয়ে এসেছে। যা-ই করুক, আমার ওপর ওর নির্ভরশীলতার জন্যও কিছু করতে পারিনি।

পত্রিকা: কিন্তু আপনারও কাউকে ভাল লাগতে পারত! লাগেনি?

মীনাক্ষী: ভাল লাগবে না কেন? কিন্তু সে রকম সম্পর্ক তৈরি হতে পারেনি। তার জন্য তো একটা সময় লাগে। আমার সেই অবসর তৈরি হয়নি। আমি সকালে উঠে রান্না করতাম। দৌড়তে দৌড়তে অফিস যেতাম। আমার শাশুড়ি ছিলেন। কাজের লোক-টোক তখন ছিল না। তার পরে ছেলেমেয়েদের এবং ওঁকেও সামলাতে হত!

পত্রিকা: আর উনি যে এমন বর্ণময় মানুষ, ওঁর কোনও অনুরাগিনী ছিল না?

মীনাক্ষী: অনুরাগিণী তো দেখিনি। তো আমিই বলতাম, সুনীলের এত বান্ধবী, তোমার তো কোনও বান্ধবী নেই!

পত্রিকা: শক্তি কী বলতেন তখন?

মীনাক্ষী: বলত, হ্যাঁ হ্যাঁ আছে, আছে অনেক চিঠি আছে। একটা চিঠি দেখিয়েওছিল...তার পরে আমি ভাবলাম থাক এগুলো ব্যক্তিগত ব্যাপার।...চিঠিফিঠি অত কেউ বোধহয় দিত না। মহিলাপ্রীতিও তেমন ছিল না। জীবনে প্রেম হয়তো দু’-একবার এসেছে।

পত্রিকা: অবান্তর স্মৃতির ভিতর আছে তোমার মুখ অশ্রু ঝলোমলো... এটা তো আমাদের সবার লাইন হয়ে গিয়েছে! কে এই নারী বলুন না! আপনি?

মীনাক্ষী: না, না, এ কবিতা আমার সঙ্গে আলাপ হওয়ার আগের। ওর প্রণয় ছিল চাইবাসায়। সেই মেয়েটির উদ্দেশেই লেখা।

পত্রিকা: আর আপনি কোন কবিতায় এসেছেন?

মীনাক্ষী: এসেছি তো নিশ্চয়ই! সে অনেকগুলো কবিতা... যেমন ওই যে শিলচরে গেছিলাম। তখন ও এয়ারপোর্টে যাবে বলেছিল। যেতে পারেনি, পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছিল! তখনই লিখেছিল, বৃষ্টি নামল যখন আমি উঠোন পানে একা/ দৌড়ে গিয়ে ভেবেছিলাম তোমার পাবো দেখা/ হয়তো মেঘে-বৃষ্টিতে বা শিউলি গাছের তলে/ আজানুকেশ ভিজিয়ে নিচ্ছ আকাশ-ছেঁচা জলে/ কিন্তু তুমি নেই বাহিরে অন্তরে মেঘ করে...

পত্রিকা: এই প্রেম একটা দিক... আরেকটা তো ইনকন্সিসটেন্সি, সংসারে আলগা ভাব...

মীনাক্ষী: হ্যাঁ, লোককে বাড়িতে নেমন্তন্ন করে ডেকে ভুলে যাওয়া বা উধাও হয়ে যাওয়া। শিবনারায়ণ রায় একবার দুপুরে এসে ফিরে যান। পরে খুব ক্ষুণ্ণ হয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। ও খুব মন দিয়ে বাজার করতে ভালবাসত, বাড়ির ওই একটা কাজই করত, যদিও বাজার করতে বেরিয়েও ক-ত দিন ফেরেনি। আমি বসে থেকেছি। একবার ভোপালে দশ দিন কাটিয়ে ফিরল, তার ঠিক একদিন আগে টেলিগ্রামে খবর পাঠিয়েছিল। ফিরে এসে তা-ই কী গর্বের হাসি!

পত্রিকা: সেই যে একটা লাইন আছে ওঁর, সবার বালকবয়স বাড়ে আমার কেন বাড়ে না...

মীনাক্ষী: হ্যাঁ, মানসিকতা একদম ওই রকম ছিল।

পত্রিকা: আপনার কি মনে হয়, এখন মোবাইল ফোনের যুগেও শক্তি অত সহজে নিরুদ্দেশ হতে পারতেন?

মীনাক্ষী: আমার মনে হয়, অত সহজে ওকে জব্দ করা যেত না! ফোন ধরতই না।

পত্রিকা: ওঁর মৃত্যুর ক’বছর পরে একটা সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন যে, মাঝেমধ্যে মনে হয়, ও আবার কিছু দিনের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে আছে!

মীনাক্ষী: তখন তাই মনে হত! হঠাৎ যেন দরজায় বেল বাজল। খুলে দেখি কেউ নেই। আগে বুঝিনি, আসলে এতটা অক্যুপায়েড থাকতাম ওকে নিয়ে, ও কী করতে পারে আর পারে না, ভাবতে-ভাবতে--- ও হুট করে চলে যেতে সব ফাঁকা হয়ে গেল! শেষ দিকটা অসুস্থ থাকলেও ও এখনই যেতে পারে সেটা ভাবিনি!

পত্রিকা: তাই...

মীনাক্ষী: সবাইকে বলে বেড়াত, মীনাক্ষীই আগে যাবে, তখন আমার যা দুর্গতি হবে! সুনীলকে বলত, তুমি যা মোটা তুমি তো থাকবে না! আমি ৮০ বছর বাঁচব। ওর মধ্যে একটা বদল আসছিল। লিখেওছিল, সকল প্রতাপ হলো প্রায় অবসিত! তবু শেষটায় শান্তিনিকেতনে পড়াতে গিয়ে ও অসম্ভব উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। এত হাঁটাহাঁটি, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা! শান্তিনিকেতন থেকেই আমায় জোর করে একটা শাড়ি কিনে দিল। সেটাই প্রথম ও শেষ বার ছিল। তার আগে আমাদের জন্য একটা রুমালও নিজে কিনে দেয়নি।

পত্রিকা: শক্তির জীবন, মদ্যপান নিয়ে যত চর্চা হয়েছে, কবি শক্তির মূল্যায়নে কী ততটা হয়েছে?

মীনাক্ষী: হয়নি তো! ওঁর কবিতার বিষয়ে ইনার ডিসিপ্লিন নিয়ে কেউ বলে না। শঙ্খবাবু (ঘোষ) বা জয় (গোস্বামী) বলেছেন। শক্তি লিখেছিল, এত কবি কেন? ‘দেশ’ পত্রিকায় সুনীল যে-সব কবিতা ছাপাত তার কিছু-কিছু নিয়ে ওর আপত্তি ছিল। তার ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে, শক্তি নতুন কবিদের পছন্দ করে না। ও কিন্তু বলতে চেয়েছে, কবিতা লেখার ব্যাকরণটা শিখে তারপর কবিতা লেখা উচিত! কাগজে দেখলাম, সুনীলকে নিয়ে নাটক হচ্ছে, তাতে শক্তি-চরিত্র থাকবেই এবং শক্তি নতুন কবিদের পছন্দ করতেন না এটাও থাকবে। এর থেকে অসত্য আর কিছু হয় না। নতুন কবি যাঁরা শক্তির প্রশ্রয় পেয়েছেন, তাঁদেরই এর প্রতিবাদ করা উচিত।

পত্রিকা: এত আগে চলে গিয়ে শক্তির কিছু কাজ কি অপূর্ণ থেকে গেল?

মীনাক্ষী: খুব ভালবেসে গীতার অনুবাদ করছিল। চারটে সর্গ করেও ফেলেছিল। সেটা আর শেষ হল না। ওর মধ্যে কবিতা নিয়ে সাংগঠনিক কবিদের শ্রেষ্ঠ কবিতা সিরিজ, পূর্ববঙ্গের কবিদের সংকলন প্রকাশের মধ্যে ছিল। চাইলে আরও কিছু কাজ করতে পারত। আর খুব মনে হয়, ও নাতি-নাতনিদের দেখে যেতে পারল না।

পত্রিকা: কী মনে হয় বাবা শক্তি যে দায়িত্বের ছাপ রাখতে পারেননি, প্রতাপ ফিকে হওয়া দাদু শক্তি তা পুষিয়ে দিতে পারতেন?

মীনাক্ষী: (হাসি) নিশ্চয়ই! ও চলে যাওয়ার পরেও আমাদের বাড়িটা এখনও একই রকম আছে! শুধু ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়েছে। সংসারে কিছু নতুন মানুষ! আর বাচ্চাদের সংস্পর্শে তো মানুষ অনেক উজ্জীবিত হয়।

পত্রিকা: এখানে ঢোকার সময়ে মনে হচ্ছিল, দরজার মুখোমুখি ওঁর ছবি আর পাপোষে রাখা বাচ্চাদের চটিতে বালকবয়সি কবির বাড়ি বেশ মানিয়েছে!

মীনাক্ষী: অনেকেই সেটা বলেন...একটা সময়ে ও নিরুদ্দেশ হলেও ফোনটোন করতাম না, খোঁজ নিতাম না। জানতাম, ঠিক ফিরে আসবে! ও তখন লিখেওছিল, বহুবার হারিয়েছে বলে আজ কেউ লোকটিকে খোঁজে না আর, সুতো ছাড়তে থাকে...শক্তির দীর্ঘ অনুপস্থিতির পরেও মনে হয়, বাড়িতে আমরা একা নই। কেউ একজন সঙ্গে আছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন