এবারে দ্যাখা যায় শ্মশান উত্সব/আগুন জবা রং, গুঞ্জরন/ ছায়ার কোলাহল, ছায়ার ঘোরাফেরা/ ব্যস্ত নিরাকার মানুষজন।
স্বপ্ন দেখছি কি? স্বপ্নই বটে...এ তো শ্মশান...এখানে পৌঁছলাম কী ভাবে? কেনই বা এলাম? চারিপাশে অ্যাতো স্তব্ধতা...কেন?
এখানে রাত নেই, এখানে দিন নেই/থেমেছে চুম্বকে আয়ুর ঘড়ি/ মৃতেরা হেসে ওঠে, জীবিত উদাসীরা/ হেলায় ছুঁড়ে দেয় পারের কড়ি।
হ্যাঁ, আবছা মনে পড়ছে বটে, কোনও এক মানুষের মৃত্যুর আগে, তাঁর রেখে যাওয়া ‘ইচ্ছাপত্র’টি পড়ছিলাম...মৃত্যুর পর যে মানুষ ‘নিভৃতি’ চেয়েছিল। চেয়েছিল সকলের অলক্ষ্যে ঢুকে পড়তে ‘অগ্নিকুণ্ডে’।
সেই মানুষ যিনি লিখেছেন“কাল নিরবধি এবং পৃথ্বী বিপুলাএ কথা বলতে পারেন লেখক, বলতে পারেন চিত্রকর। কিন্তু আমরাঅভিনেতারা তা পারি না। আমাদের জন্য নয় ভাবীকালের স্বীকৃতি। আমরা আজকের। একান্ত করেই আজকের...” সেই মানুষটির ‘ইচ্ছাপত্র’টি পড়ছিলাম। তার পরই...
দূরে দু’একটা কুকুর ডেকে উঠল। বাতাসে ভেসে এল ‘সাগরঘ্রাণ’। হঠাত্ সচকিত হয়ে দেখি, শিরদাঁড়া সোজা করা এক মানুষ, গেরুয়া পাঞ্জাবি, পাটভাঙা ধুতি, দৃপ্ত পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন ইলেকট্রিক চুল্লিটির দিকে।
আকাশে তখন ঘন মেঘ, অ্যাতোটুকু আলো নেই। গাঢ় আঁধারে, চুল্লির গনগনে লাল আভায় ‘মানুষ’টিকে লাগছিল এক অভিশপ্ত ‘রাজা’র মতোযে রাজা ‘সত্যি’টা জানতে চেয়ে বাজি রেখেছিলেন নিজের যাবতীয় সুখ। কিংবা সেই ডাক্তার, যিনি মানুষের, সমাজের ভাল করতে গিয়ে ক্রমশ আবিষ্কার করেন তিনি কত ‘একা’, আবার সেই ‘একাকীত্ব’কেই প্রবল শক্তিতে রূপান্তরিত করে তোলেন অনায়াসে।
মানুষটি যত হেঁটে যাচ্ছেন ‘অগ্নি’র দিকে, ততই নানান রূপে, নানান ভঙ্গিতে প্রকাশিত হচ্ছেন আমার কাছে। মানুষটির নাম জানি ‘শম্ভু মিত্র’...
কিন্তু নাম জানলেই কি একজন মানুষকে ‘জানা’ যায়? বিশেষ করে, এমন একজন মানুষ, যিনি একটি বাঙালি উপাদানকে বিশ্ব উপাদানে পরিণত করেছিলেন।
কথাটা আমার নয়। সাহিত্যিক দেবেশ রায়ের। একটি প্রবন্ধে উনি লিখছেন এবং ব্যাখ্যা করছেন যে, কী ভাবে শম্ভু মিত্র আমাদের বাংলা শব্দের উচ্চারণ শুনিয়েছেন। সেই শব্দোচ্চারণ এমন বৈভব রচনা করতে সমর্থ হয়েছিল যে, বাঙালি বুঝতে শিখেছিল যে বাংলা নাটক কাকে বলে।
বাঙালি বিশ্বাস করেছিল ‘বাঙালি’ নট হয়েও বিশ্বনট হওয়া যায়। অবধারিত ভাবে এসে পড়ে শিশির ভাদুড়ীর কথা। প্রশ্ন ওঠে, পাশ কাটিয়ে একটা ভুল ইতিহাস তৈরির চেষ্টা হচ্ছে না তো?
শম্ভু মিত্রের ‘দর্শকের দায়িত্ব’ নামক প্রবন্ধে জানতে পারি, শিশির ভাদুড়ী অভিনীত ‘রঘুবীর’ নাটকের একটি অংশের অভিনয় দেখে শম্ভুবাবুর মনে হয়েছিল, বাহান্ন বছর বয়সি শিশিরকুমার যেন ‘ঈগলে’র মতো ছোঁ মেরে মনটাকে কোথায়, কোন উর্ধ্বে নিয়ে যান, সেখানে মহান মৃত্যুর সামনে মানুষ ‘একা’। সত্যিই তো, আমাদের বাংলা রঙ্গমঞ্চের ক’জন নট-এর অভিনয় বা প্রয়োগ-কৌশল নিয়ে যথাযথ আলোচনা হয়েছে?
আমরা, যারা বহু পরে বাংলা নাট্যমঞ্চে যুক্ত হয়েছি, যাদের কাছে শিশিরকুমার সম্পূর্ণই একটা অলীক ইতিহাস, আর নাটকের পরিবারে জন্মানোর সুবিধার্থে, খুব ছোটবেলায় দেখা শম্ভু মিত্রের কিছু অভিনয়ের আবছা স্মৃতি...‘আমরা’ কী ভাবে বিশ্বাস করব, কেনই বা করব দেবেশ রায়ের ব্যাখ্যা“শম্ভু মিত্রই আমাদের শিখিয়েছেন বাংলাভাষার কথ্যরূপকে কী ভাবে মঞ্চে এনে ফেলা যায়...।”
নানান সময়ে নানান লেখা পড়তে পড়তে এটা অবশ্যই বোঝা যায় যে শিশিরকুমারের মতো অমন অভূতপূর্ব প্রতিভাধর নির্দেশক-অভিনেতাকেও একটা ঘেরাটোপে আটকে যেতে হয়েছিল। দুর্বল নাটকের ঠেলায় নাটকের সমগ্রতা নষ্ট হল। শক্তিমান অভিনেতারা শুধুমাত্র তাঁদের নিজস্ব প্রতিভার স্ফুরণে আকর্ষণ করতেন দর্শকদের। তাই একটা সময় এল যখন মানুষ একটা সামগ্রিক প্রযোজনা দেখতে নয়, দেখতে যেতেন ‘শিশিরকুমার’কে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এতে দোষের কী আছে? ‘থিয়েটার’ তো ‘অভিনেতা’রই জায়গা। ‘অভিনেতা’ই তো শাসন করবেন মঞ্চকে!
প্রশ্নটা হচ্ছে, শাসন করবেন কী দিয়ে? দর্শকককে মন্ত্রমুগ্ধ করবেন কী দিয়ে? কণ্ঠ, উচ্চারণ, শরীর..! বেশ! তার পর? তার পরও দর্শকদের খিদে রয়ে যায়, আকাঙ্ক্ষা থেকে যায়। মানুষ থিয়েটার দেখতে আসে অবশ্যই খুব ভাল ‘অভিনয়’ দেখতে, কিন্তু তার পরেও সে খুঁজে পেতে চায় তার ‘সময়’টাকে।
দেবেশ রায় লিখছেন : “নবান্ন’র মোড়ল যে আপনহারা আর্তিতে শেয়ালদা স্টেশনে ঘুরে বেড়ায়, ‘রক্তকরবী’র বিশুপাগলও সেই আপনহারা আর্তিতে সোনার খাদানে ঘুরে বেড়ায়। শম্ভুবাবুর আগে কেউ এই মিলটি দেখতেই পাননি। এক-এক ভাষায় আর্তনাদের এক-এক ধরন। আর্তনাদের সেই ধরনগুলিকে শম্ভুবাবুর জানা হয়ে গিয়েছিল ‘ছেঁড়া তার’, ‘উলুখাগড়া’য়। সেই জানা আর্তনাদ এ বার নতুন মাত্রা পায় নন্দিনীর গলায় ‘পাগলভাই’ ডাকে।”
দেবেশবাবু এই বাংলা উচ্চারণ আবিষ্কারের মধ্যে পেয়েছেন সাঙ্গীতিক প্যাটার্ন। আমার মতো সামান্য নির্দেশক-অভিনেতার কাছে এ হল ‘সময়’-এর উচ্চারণ। তবে কি বহমান ‘সময়’ অভিনেতাকে দিয়ে বলিয়ে নেয় তার কথা! ‘সময়’ই কি তা হলে নির্ধারণ করে সব? এক অর্থে হ্যাঁ আবার ‘না’। ‘সময়’কে প্রকাশ করার তাগিদে আমরা, এখনও, বহু ক্ষেত্রেই সীমা পার করি। বহু সময়ে ‘সময়’কে প্রকাশ করার তাড়নায় লঘু করে ফেলি নাট্যমুহূতর্কে। ওই মানুষটা, যিনি হেঁটে যাচ্ছেন ‘অগ্নিকুণ্ডে’র দিকে, তিনি যখন একটা পরিপূর্ণ বাঙালি নাটকের চেহারা কেমন হবে ভাবতে গিয়ে নির্বাচন করলেন রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’, তখন বোঝা যায় কী ভাবে শুধু একজন নট-নির্দেশক নন, একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, গভীর ভাবে চিন্তা করতে পারা ‘মানুষ’ ব্যাখ্যা করতে চাইছেন ‘সময়’কে। শুধু রবীন্দ্রনাটকের নির্বাচনই নয়, শম্ভু মিত্র স্থির করলেন রবীন্দ্রনাটকের অভিনয়ের প্যাটার্ন।
ওই কাঠামোটি ছিল বলেই সুমন মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় ‘বিসর্জন’ নাটকে ‘জয়সিংহে’র চরিত্রে অভিনয় করার ‘চেষ্টা’ করেছিলাম। তারও আগে ‘ডাকঘর’ নাটক মঞ্চস্থ করতে গিয়েও একই কথা মনে হয়েছিল। জয়সিংহ যখন অপর্ণাকে বলে‘হা অপর্ণা এমন রাত্রির মাঝে দেবী নাই’, বা গৃহস্থ মাধবদত্ত যখন আকুল হয়ে প্রশ্ন করে‘তারার আলোয় আমার কী হবে?’এই দুই সংলাপের উচ্চারণ কী ভাবে হবে?
রবীন্দ্রনাটকের সংলাপ তো এই কারণেই এত মোহময় যে, তা একই সঙ্গে কাছের ও দূরের। খুব সাধারণ ভাবে সংলাপ বলে গেলে মনে হবে ‘কাছের’, কিন্তু তার ভিতরেই আটকে যেতে পারেন অভিনেতা। ‘কাব্য’ বেরোবে না, ‘চরিত্র’টি আটকে যাবে, আবার অতিমাত্রায় ‘কাব্যিক’ করে তুলতে গেলে ‘দর্শক’ থেকে দূরে সরে যাওয়ার ভয় থাকে। ফলে এই সব নাটকের বাচনের বুনোট সারাক্ষণই ত্রস্ত করে রাখে অভিনেতাকে। তাকে ফেলে দেয় একটা নিরন্তর পরীক্ষার সামনে।
জয়সিংহ’র সঙ্গে অতি সাধারণ গৃহস্থ মাধবদত্ত-র কোনও মিল নেই, তবু জয়সিংহ ‘দেবী’কে নিয়ে যখন বিভ্রান্তিতে পড়ে, আবার ‘অমল’কে নিয়ে যখন ‘মাধবদত্ত’ কী করবে ভেবে পায় না, তখন সেই ‘বিভ্রান্তি’ বা ‘ভেবে না পাওয়ার’ মধ্যেও নানান অমিল থাকলে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি যে ‘একটা মানুষ’ তার যাবতীয় সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে গিয়ে একটা ‘সত্য’কে বুঝতে চাইছে। বুঝতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে রাজপুত জয়সিংহ। মাধবদত্ত বেঁচে থাকছে। কিন্তু আন্দাজ করা শক্ত নয় যে ‘অমল’-এর মৃত্যুর পর মাধবদত্তর ঘরদুয়ার যেমন আর আগের মতো থাকবে না, তেমনই মাধবদত্ত-ও রইবে না পূর্বের মতো। বদল ঘটবে তারও। ছোট-বড় নানান চরিত্রগুলিকে সমান গুরুত্ব সহকারে বিচার-বিশ্লেষণ-এর এই পদ্ধতিও শম্ভু মিত্রের অবদান।
‘রক্তকরবী’ নিয়ে ওঁর লেখায় তারই ইঙ্গিত আছে, যা থেকে আমরা আজও শেখার চেষ্টা করে চলেছি। সেই কারণেই উনি লিখছেন : “রবীন্দ্রনাথের নাটকে জোড়গুলো বেমালুম মেলানো, এবং হৃদয় ও বুদ্ধি উভয়েরই আবেদনের একটা সাম্য আছে....”।
এই সাম্য আবিষ্কার করেছিলেন যিনি, সেই মানুষটা হেঁটে চলেছেন আগুনের দিকে। আধো-স্বপ্নে, আধো-জাগরণে আমার মনে হল, যত তিনি এগোচ্ছেন আগুনের দিকে, ততই স্পষ্ট হচ্ছে তার ফেলে আসা পথ, যেখানে আমাদের ‘দেখতা-সত্যি’ আর ‘আকাশছোঁয়া’ স্বপ্ন মিলেমিশে যাচ্ছে।
ক্রমশ আগুন লেলিহান হয়ে উঠছিল। গ্রাস করে ফেলতে চাইছিল সব কিছু। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল একবার ওঁকে ডাকতে। গলা দিয়ে স্বর বেরোল না। শুধু মনে মনে বললাম, আপনার তো কিছুই রইল না। ঠিক যেমনটা আপনি চেয়েছিলেন, ঠিক তেমনটাই যত দূর সম্ভব “চড়া দরে নিজেকে বেচেছেন যমের কাছে”।
তবু আপনার ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে যাওয়া কিছু কথা তো রয়ে গেল। আমি নিজের কানে শুনিনি, বাবার (শ্যামল সেন) কাছে শুনেছি। বাবার নির্দেশনায় ‘যদুবংশ’ দেখে আপনার খুব ভাল লেগেছিল। বাড়িতে ডেকে কথাও বলেছিলেন তরুণ শ্যামলের সঙ্গে। অনেক কথার মধ্যে একটা কথা বাবা কোনও দিন ভুলতে পারেননি। আর বাবার কাছ থেকে শুনে আমিও পারিনি ভুলতে।
আপনি বলেছিলেন, “আচ্ছা শ্যামল, যখন তুমি কোনও একজন মেয়েকে ভালবাসো, তখন তার কথা ভাবার জন্য তোমাকে কি আলাদা করে সময় বার করতে হয়? তুমি তোমার দৈনন্দিন সমস্ত কাজের মধ্যেই তাকে খুঁজে পাও। থিয়েটারের প্রতি ভালবাসাটা তো তেমনই হতে পারে।” এটাই বোধহয় আপনি যেটাকে বলেছেন ‘প্রেমের পরিশ্রম’... এই কারণেই যখন ‘আন্ধার’ এসে ঢেকে নগরীর আকাশবাতাস তখনও আজও শহর-শহরতলির নাম-না-জানা অগণিত নাট্যবন্ধুরা এই ভালবাসায় রত থাকেন, শম্ভুবাবু, আপনি জানেন কিনা জানি না, তারা সবাই চেতনে অবচেতনে, বুঝে অথবা না-বুঝে প্রতিদিন আপনাকেই স্মরণ করে...