ঘোষণাটা মার্চেই হয়ে গিয়েছিল। এ বার এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সুদূর ম্যাসিডোনিয়ার স্কপিয়ে শহরের ছোট্ট গন্জা আজ সন্ত হবেন। মাঝে পেরিয়েছে ১০৬ বছর। ‘ঐতিহাসিক’ এই সফরের প্রাপ্তির ঝুলি আজও ভরা অনাবিল আনন্দ আর খুশিতে।
তিনি নেই। তবু আছেন। মিশনারিজ অব চ্যারিটিতে তাঁর প্রিয় সন্তানদের মনে। তাঁদের প্রতি দিনের কর্মকাণ্ডে। যাঁরা তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছেন তাঁদের মনে আজ বিশেষ অনুরণন। তেমনই এক জন অনিল ডিসুজা বলছেন, ‘‘দরিদ্র, অনাথ, অসুস্থ তো বটেই, এমনকী কারও মৃত্যু আসন্ন জেনেও কোলে তুলে নিতে এতটুকু দ্বিধা থাকত না তাঁর। মায়ের স্পর্শ মিলত তাঁর আঁচলে। ভ্যাটিকান তাঁর উপযুক্ত স্বীকৃতি দিচ্ছে।’’
আরও খবর- মানবতা সম্পর্কে ধারণা পাল্টে দিয়েছেন মাদার
মাত্র পাঁচটি টাকা এবং দশ জনকে নিয়ে শুরু। ধীরে ধীরে শহর থেকে রাজ্যে, দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে। তাঁর তৈরি মিশনারিজ অব চ্যারিটি ছড়িয়ে পড়েছে ১৩৯টি দেশে। সঙ্গে রয়েছেন সেই দুঃখী মানুষেরা যাঁদের জন্য এই ‘বিপুল’ কর্মকাণ্ড। সেই ‘বিপুলে’র টানে এই শহরে ছুটে এসেছেন মহম্মদ আলি, দোমিনিক লাপিয়ের, ইয়াসের আরাফত, যুবরাজ চার্লস, ডায়না-সহ তাবড় তাবড় খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব।
গত ডিসেম্বরে ভ্যাটিকানের তরফে জানানো হয়েছিল, সন্ত হওয়ার প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করেছেন মাদার টেরিজা। দু’টি ঘটনাকে অলৌকিক বলে স্বীকৃতি দেয় ভ্যাটিকান এবং সর্বশেষে পোপ। সন্ত হওয়ার শর্ত হিসেবে প্রথম ঘটনা ঘটে ১৯৯৮ সালে। পশ্চিমবঙ্গের এক আদিবাসী মহিলা মণিকা বেসরার পেটের টিউমার সেরেছিল মাদার টেরিজার নামে প্রার্থনা করে। অন্যটি ঘটে ২০০৮ সালে। ভ্যাটিকানের দাবি, ওই বছর ব্রাজিলে মাদার টেরিজার নামে প্রার্থনা করে সুস্থ হন এক যুবক যার মস্তিষ্কে একাধিক টিউমার ছিল। ৫ সেপ্টেম্বর মাদারের ১৯তম মৃত্যুদিন। তার ঠিক আগের দিন রোমে ‘বিয়েটিফিকেশন’ অনুষ্ঠানে মাদারকে ‘সন্ত’ ভূষিত করবেন পোপ ফ্রান্সিস।
আরও খবর- মাদার টেরিজা ঈশ্বরের এক প্রিয় মানুষ
জন্মসূত্রে আলবেনীয় বাবা নিকোলা এবং মা দ্রানা বোজাজিউর পাঁচ সন্তানের সর্বকনিষ্ঠ গন্জা অ্যাগ্নেসের জন্ম ২৬ অগস্ট ১৯১০। আলবেনীয় ভাষায় গন্জার অর্থ ফুলের কলি বা মুকুল। মাকে তাঁরা ডাকতেন ‘নানে লোকে’, যার অর্থ আমার প্রাণের মা। তাঁর কঠোর অনুশাসন এবং নিয়মানুবর্তিতাই যে গন্জার পরবর্তী জীবনকে প্রভাবিত করেছিল এ কথা মাদার টেরিজা বহু জায়গায় বলেছেন। নয় বছর বয়সে বাবা মারা যাওয়ায় পরিবারে বিপর্যয় নামে। রোমান ক্যাথলিক ধর্মচর্চায় বিশ্বাসী তাঁর পরিবার আরও বেশি করে ঈশ্বরকে আঁকড়ে ধরল। ১৯২৮-এর সেপ্টেম্বরে রাথফার্নহাম মঠের উদ্দেশে আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে যাত্রা করেন। সেখানে তাঁর নাম হয় সিস্টার টেরিজা। ওই বছর ডিসেম্বরে জাহাজে চেপে রওনা হন ভারতের লোরেটো আশ্রমের দিকে। ১৯২৯-এর ৬ জানুয়ারি কলকাতায় পৌঁছন। সেখান থেকে দার্জিলিং। ১৯৩১-এর ২৫ মে বিশেষ উপাসনার অনুষ্ঠানে সিস্টার টেরিজা প্রথম সন্ন্যাসব্রত নেন। এর পর এন্টালির লোরেটো কনভেন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। সেখানে সেন্ট মেরিজ স্কুলে ভূগোল এবং ধর্ম বিষয়ে পড়াতে থাকেন। কড়া এবং দয়ালু প্রকৃতির সিস্টার টেরিজা শিক্ষক হিসেবে ছাত্রীদের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯৪৪ সালে সেন্ট মেরিজের অধ্যক্ষা হন।
আরও খবর- আস্তাকুঁড় থেকে ককপিটে মাদারের শিশু
১৯৪৬। ট্রেনে দার্জিলিং যাওয়ার পথে অন্য আহ্বান শুনতে পেলেন। সব কিছু ছেড়ে দরিদ্র, আর্ত, নিপীড়িত, অনাথদের পাশে থেকে যিশুর সেবা করার ডাক।
তাতে সাড়া দিয়ে ১৯৪৮ সালে লোরেটো সঙ্ঘের কালো গাউন ছেড়ে নীল পাড় সাদা শাড়ি পরলেন। লোরেটোর সঙ্গে প্রায় কুড়ি বছরের সম্পর্কের ছেদ ঘটিয়ে চলে গেলেন পটনা। মেডিক্যাল মিশনের সিস্টারদের থেকে নার্সিংয়ের প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিয়ে ওই বছরের ডিসেম্বরে কলকাতায় ফিরে এলেন।
১৯৪৮-এর ডিসেম্বরে মাদার টেরিজা মতিঝিলে একটি স্কুল তৈরি করেন। যার শ্রেণিকক্ষ ছিল একটি গাছতলা এবং ব্ল্যাকবোর্ড বলতে ছিল পায়ের তলার মাটি। অনেক সন্ধানের পর ১৯৪৯-এর গোড়ায় ১৪ নম্বর ক্রিক লেনে গোমস ভাইদের বাড়ির উপর তলায় একটি ঘর পেলেন। ওই বছরের মার্চে প্রথম সহযোগী পেলেন। নাম তাঁর সুবাসিনী দাশ, পরে যিনি সিস্টার অ্যাগনেস। ১৯৫০-এর ৭ অক্টোবর তৈরি হল মিশনারিজ অব চ্যারিটি। তার পর এক লম্বা যাত্রাপথ। মাদারের উদ্যোগে একে একে তৈরি হল ‘নির্মল হৃদয়’, ‘শিশু ভবন’, ‘প্রেমদান’, ‘দয়াদান’, কুষ্ঠরোগীর আশ্রম। সাহায্যের জন্য ছুটে গিয়েছেন এক দেশ থেকে অন্য দেশ। তারই স্বীকৃতিতে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান ১৯৭৯ সালে।
আরও খবর- ‘মেমোরিজ অব মাদার টেরিজা’
মাদারকে নিয়ে আজ গোটা বিশ্ব মাতোয়ারা। কিন্তু মিশনারিজ অব চ্যারিটির মাদার হাউজে ঢুকলে সেই মাতামাতির কোনও আঁচ মেলে না। এটাই যে মাদারের শিক্ষা— জানালেন এক সিস্টার। কোনও আনন্দ বা কোনও দুঃখে আবেগপ্রবণ হলে প্রতি দিনের নিয়মাবলীতে যে ব্যাঘাত ঘটবে! এমনটা কখনও চাইতেন না মাদার। মাদারের সন্তায়নের দিনে রোম থেকে সরাসরি সম্প্রচার অবশ্য দেখানো হবে মিশনারিজ অব চ্যারিটিতে। সেই সময় কোনও কাজ নয়। অনুষ্ঠান শেষে মাদারের নামে থাকবে ‘থ্যাঙ্কস গিভিং’। এটুকুই উদ্যাপন। তার পর ফের দৈনন্দিন ব্যস্ততায় ডুব।
আরও খবর- তিলোত্তমার মাদার
আরও খবর- ফিরে দেখা: মাদারের মহাপ্রয়াণ
আরও খবর- বিপন্ন বিস্ময়