আর পাঁচটা দিনের মতো অভ্যাসবশে প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন মিশেল ডুপোঁ। পেশায় কৃষক। মধ্য ফ্রান্সের আউভার্গেন অঞ্চলের বাসিন্দা। ৫২ বছর বয়সি এই চাষি তাঁর জমির মধ্যেই ঘোরাফেরা করছিলেন। বয়ে যাওয়া ছোট জলধারায় পাশে হাঁটতে গিয়ে নজরে আসে এক অদ্ভুত দৃশ্য।
জলের মধ্যে চকচকে ধাতব পদার্থ দেখে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন মিশেল। নিজের জমির চৌহদ্দিতে খনন আরম্ভ করেন তিনি। কয়েক ফুট মাটি খুঁড়তেই চমকে ওঠেন ফরাসি কৃষক। কী ঘটছে প্রথমে নিজেই বিশ্বাস করতে পারেননি ওই কৃষক।
নিজের ভাগ্যকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না মিশেল। জমিতে সামান্য খোঁড়াখুঁড়ি করতেই বেরিয়ে আসে কয়েকটি উজ্জ্বল ধাতব টুকরো। চকচকে ওই হলুদ ধাতু যে খাঁটি সোনা, তা বুঝতেও কিছুটা সময় লেগে যায় তাঁর।
মিশেলের হাতে যেন উঠে এসেছিল ‘কুবেরের ধন’। আক্ষরিক অর্থেই তাঁর চাষের জমিতে লুকিয়ে ছিল সোনার খনি। রাতারাতি মিশেল হয়ে উঠেছিলেন কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক। কারণ তাঁর ব্যক্তিগত মালিকানায় থাকা জমি থেকে পাওয়া গিয়েছিল টন টন খাঁটি সোনার টুকরো।
মিশেল সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন, তিনি প্রতি দিনের মতো জমিতে হাঁটছিলেন। ঠিক তখনই কাদার মধ্যে একটা অদ্ভুত চকচকে বস্তু দেখতে পান তিনি। সেই জমি একটু খনন করতেই বেরিয়ে আসে সোনার টুকরো।
কৃষিজমির নীচে সোনা আবিষ্কারের খবরটি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রাথমিক মূল্যায়ন থেকে জানা যায় যে জমিটিতে ১৫০ টনেরও বেশি সোনা থাকতে পারে। এই তথ্য অভিজ্ঞ ভূতাত্ত্বিকদেরও অবাক করে দিয়েছিল।
১৫০ টন সোনার বাজারদর শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলেন ছাপোষা কৃষক। যে জমিতে এত দিন ফসল ফলিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন, সেই জমিতেই লুকিয়ে রয়েছে ৪০০ কোটি ইউরোর সোনা! ভারতীয় মু্দ্রায় সোনার মূল্য প্রায় ৩৯ হাজার কোটি টাকা হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
রাজৈশ্বর্যের মালিক হয়েছেন ভেবে স্বপ্নের রাজত্বে বিচরণ করতে শুরু করেছিলেন মিশেল। কিন্তু অচিরেই তাঁর সেই স্বপ্ন ভেঙে ধূলিসাৎ হয়ে গেল। মিশেলের খেতের নীচে পাওয়া গুপ্তধনের কথা জানতে পারে সে দেশের সরকার। গোটা বিষয়টি সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে মিশেলের জমি পরিদর্শনে আসেন সরকারি কর্তারা। আর তাতেই স্বপ্নভঙ্গ হয় ৫২ বছর বয়সি প্রৌঢ় চাষির।
ফরাসি সরকারের কর্তারা নির্দেশ জারি করে দিয়েছেন, পূর্ণাঙ্গ তদন্ত সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত কেউ সেখানে কোনও রকম খননকার্য করতে পারবেন না। এখন সেই জমি সম্পূর্ণ সিল করে দেওয়া হয়েছে। ফরাসি প্রাকৃতিক সম্পদ আইন অনুসারে, পরিবেশগত এবং আইনি পর্যালোচনা সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত কোনও খনন বা উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া হবে না।
ফ্রান্সে প্রাকৃতিক সম্পদের উপর কঠোর বিধিনিষেধ রয়েছে। সে দেশে ভূগর্ভস্থ সব কিছুই সরকারের মালিকানাভুক্ত। যদি ব্যক্তিগত মালিকানা পেতে চান, তা হলে সরকারি অনুমতি নিতে হবে।
পরিবেশগত গবেষণা এবং আইনি পর্যালোচনা শুরু হতেই জমিটিতে যাবতীয় কার্যকলাপ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সরকার পরিবেশগত তদন্ত এবং আইনি পর্যালোচনা শুরু করেছে। জমিটি সুরক্ষিত রাখতে সেখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি কড়া পাহারাও বসিয়েছে প্রশাসন। জমির মালিক হওয়া সত্ত্বেও তাই সেখানে প্রবেশের অনুমোদন পাননি মিশেল।
জমির উপরের মালিকানা ব্যক্তিগত হলেও ভূগর্ভস্থ সম্পত্তির উপর সরকারের কর্তৃত্ব পুরোমাত্রায়। যদি ভূগর্ভে কোনও ঐতিহাসিক সম্পদ পাওয়া যায়, তবে উত্তোলনের আগে তার জন্য সরকারি অনুমোদনের প্রয়োজন হয়।
এই ঘটনার পর মিশেলের জীবন সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে। শান্ত এবং ব্যক্তিগত জীবন এখন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। প্রতি দিন তাঁকে ঘিরে থাকছেন সাংবাদিক, গবেষক এবং জমি ক্রেতারা। শান্ত, নিরুপদ্রব গ্রামীণ পরিবেশ সর্বদাই ভিড়ে গমগম করছে।
সংবাদমাধ্যমকে মিশেল বলেন, ‘‘হঠাৎ করেই আমার জীবন যেন খোলা খাতার মতো হয়ে গিয়েছে। প্রতি দিনই অচেনা কেউ না কেউ এসে প্রশ্ন করছেন। কেউ কেউ আমার জমির পাশে থাকা অন্য জমি কেনার চেষ্টা করছেন। তাঁরা আশা করছেন সেই জমিতেও সোনা থাকতে পারে। সেই সোনা তাঁদেরও ভাগ্য বদলে দিতে পারে।"
ফ্রান্সের পরিবেশরক্ষক সংস্থাগুলিও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাঁদের সতর্কবাণী, সোনার খনি চালু হলে তা থেকে হয়তো স্বল্পমেয়াদি অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া যাবে। কিন্তু এর পরিবেশগত ক্ষতি দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। কারণ অভার্গেন অঞ্চলটি সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্রের জন্য পরিচিত। এখানে সোনার খনি তৈরি হলে তা প্রকৃতির উপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা পরিবেশবিদদের।