‘জল-যুদ্ধে’ ইসলামাবাদ! ভারতের পর এ বার পাকিস্তানে যাওয়া নদীর জল আটকাতে তৎপর আফগানিস্তান। সেই লক্ষ্যে নতুন বাঁধ তৈরির সিদ্ধান্ত একরকম নিয়েই ফেলেছে সেখানকার তালিবান সরকার। সূত্র মারফত এই খবর প্রকাশ্যে আসতেই প্রবল জলসঙ্কটের আশঙ্কায় ভুগছে পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশ। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, হিন্দুকুশের কোলের মুলুকটিতে বাঁধ নির্মাণের দায়িত্ব নয়াদিল্লিকেই দিতে পারে কাবুল। শেষ পর্যন্ত তালিবান নেতৃত্ব সেই পদক্ষেপ করলে আঞ্চলিক শান্তি বজায় থাকবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
আফগানিস্তানের অন্যতম বড় নদী হল কুনার। ৪৮০ কিলোমিটার লম্বা এই নদীটির জন্ম হিন্দুকুশের চিয়ানতার হিমবাহ থেকে। পাক অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরের (পাক অকুপায়েড জম্মু-কাশ্মীর বা পিওজেকে) গিলগিট-বাল্টিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকায় রয়েছে ওই হিমবাহ। লম্বা রাস্তা পাড়ি দিয়ে কুনার মিশেছে কাবুল নদীতে। এই কাবুল নদী আবার আফগানিস্তান পেরিয়ে পাকিস্তানে ঢুকে সিন্ধু নদীতে গিয়ে পড়েছে। পঞ্জাব প্রদেশের আটক শহর হল তাদের সঙ্গমস্থল। এ হেন কুনার নদীর উপর বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে তালিবানের।
বিশ্লেষকদের দাবি, কুনারের উপর বাঁধ তৈরি হলে পাকিস্তানে কমবে নদীর জলের প্রবাহ। এমনিতেই ভারতের পশ্চিমের দেশটির বিস্তীর্ণ এলাকায় রয়েছে মারাত্মক জলসঙ্কট। সিন্ধ ও বালোচিস্তানের মতো প্রদেশগুলিতে ঠিকমতো পানীয় জলই পাওয়া যায় না। এই অবস্থায় তালিবান সরকার কুনার নদীর উপর বাঁধ নির্মাণ করলে পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের কৃষিতে মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। ফলে ‘কাবুলিওয়ালার দেশ’-এর ওই সিদ্ধান্ত কখনওই মেনে নেবেন না রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলরা।
তালিবান প্রশাসন অবশ্য সরকারি ভাবে কুনার নদীর উপর বাঁধ তৈরির কথা ঘোষণা করেনি। তবে সম্প্রতি পূর্ব আফগানিস্তানের কুনার প্রদেশের বিশেষ একটি এলাকা পরিদর্শনে যান সেখানকার সেনাপ্রধান জেনারেল মুবিন খান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন কাবুলের বেশ কয়েক জন পদস্থ আধিকারিক। এর পরই জেনারেল মুবিন সম্ভাব্য বাঁধ নির্মাণের এলাকা ঘুরে দেখতে গিয়েছিলেন বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। সেই আগুনে ঘি ঢালে বালোচ আন্দোলনকারী তথা লেখন মীর ইয়াব বালোচের এক্স হ্যান্ডলে করা একটি পোস্ট।
গত ১৯ মে এক্স হ্যান্ডলে মীর ইয়াব লেখেন, ‘‘পাকিস্তানের শেষের শুরু হল। ভারতের পর এ বার জল বন্ধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে আফগানিস্তান।’’ উল্লেখ্য, হিন্দুকুশের দেশটির সঙ্গে নদীর জলবণ্টন নিয়ে ইসলামাবাদের কোনও চুক্তি নেই। ফলে যে কোনও নদীর উপর ইচ্ছামতো বাঁধ নির্মাণ করতেই পারে তালিবান সরকার। এ ক্ষেত্রে কাবুলের উপর আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করা পাকিস্তানের পক্ষে যে যথেষ্টই কঠিন হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
স্থানীয় গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এলাকা পরিদর্শনের সময়ে জেনারেল মুনিব বলেন, ‘‘এই জল আমাদের রক্ত। সেটা আমরা শিরার বাইরে বয়ে যেতে দিতে পারি না। আফগানিস্তানের কৃষিকে শক্তিশালী করার জন্য এবং বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে বাঁধ তৈরি করে জল আমাদের আটকাতেই হবে।’’ হিন্দুকুশের কোলের দেশটিতে আরও একটি বাঁধ তৈরির বরাত পেয়েছে ভারত। তার নাম শাহতুত বাঁধ। এটি তৈরি হলে এক দিকে যেমন বদলাবে কাবুলের অর্থনীতি, অন্য দিকে তেমনই পাকিস্তানে যাওয়া জল আটকাতে পারবে আফগানিস্তান।
শাহতুত বাঁধের নির্মাণ খরচ ২৩ কোটি ৬০ লক্ষ ডলার ধার্য করা হয়েছে। এটি তৈরি হলে কাবুল এবং তার সংলগ্ন এলাকার ২০ লক্ষ আফগান নাগরিক পাবেন পরিস্রুত পানীয় জল। এ ছাড়া চার হাজার হেক্টর জমির সেচের সমস্যা দূর হবে। জলসঙ্কটের জেরে ‘কাবুলিওয়ালার দেশে’ কৃষিকাজ তেমন জনপ্রিয় নয়। সারা বছরই সেখানে থাকে জলসঙ্কট। একের পর এক বাঁধ নির্মাণের ফলে এ বার সেই সমস্যা মেটাতে চাইছেন তালিবান নেতৃত্ব।
অন্য দিকে, শাহতুত বাঁধ নিয়ে ইতিমধ্যেই হুমকি দিয়েছে ইসলামাবাদ। পাক সরকারের হুঁশিয়ারি, ওই বাঁধের কাজ শুরু হলে তাকে যুদ্ধ হিসাবে দেখা হবে। তালিবান অবশ্য বিষয়টিকে একেবারেই গুরুত্ব দেয়নি। উল্টে এ ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ তৈরির চেষ্টা করছে তারা। গত ১৫ মে আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত বিদেশমন্ত্রী মৌলবি আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে ফোনে কথা বলেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী মন্ত্রিসভার কোনও সদস্যের আফগানিস্তানের বর্তমান শাসকদের সঙ্গে এটাই প্রথম আনুষ্ঠানিক কথোপকথন।
কাবুলের বর্তমান সরকারকে এখনও স্বীকৃতি দেয়নি ভারত। তবে ইতিমধ্যেই বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রী একাধিক বার তালিবান নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সূত্রের খবর, সেখানে প্রস্তাবিত বাঁধের কাজ দ্রুত শুরু করতে নয়াদিল্লিকে অনুরোধ করেন আফগান শাসকেরা। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক ভাবে জঙ্গি সংগঠনের তকমা তালিবানের গায়ে সেঁটে থাকায় এত দিন জল মাপছিল দিল্লি। এ বার বাঁধ তৈরি করে তাঁদের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চাইছে কেন্দ্রের মোদী সরকার।
তবে বিশ্লেষকেরা মনে করেন, আগামী দিনে জলের জন্য পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। কারণ ইতিমধ্যেই এই ইস্যুতে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে সিন্ধ প্রদেশ। সেখানকার মরু এলাকার মধ্যে চোলিস্তান খাল প্রকল্পের কাজ চালাচ্ছে শরিফ প্রশাসন। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি নিয়ে প্রবল আপত্তি রয়েছে তাঁরই সরকারের অন্যতম বড় জোট শরিক পাকিস্তান পিপল্স পার্টির (পিপিপি)। তাঁদের বিরোধিতার জেরে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে সিন্ধ প্রদেশের নওশাহরো ফিরোজ় জেলা।
গত ২১ মে সিন্ধ প্রদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জিয়াউল হাসান লাঞ্জারের বাসভবনে হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় একদল উন্মত্ত বিক্ষোভকারী। ঘরে ঢুকে চলে দেদার ভাঙচুর। পরে মন্ত্রীর বাড়ি সংলগ্ন দু’টি ১০ চাকার ট্রেলারেও অগ্নিসংযোগ করে তারা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে স্থানীয় পুলিশ সেখানে পৌঁছোলে দু’পক্ষের মধ্যে বেধে যায় তুমুল সংঘর্ষ। পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠে গুলি চালানোর অভিযোগ। তাতে দু’জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। আহত হন এক ডিএসপি-সহ ছয় পুলিশকর্মী।
কৃষিভিত্তিক পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের দক্ষিণাঞ্চল বেশ শুষ্ক। আর তাই সেখানকার চাষের জমিতে জল পৌঁছে দিতে চোলিস্তান সেচ খাল প্রকল্পের পরিকল্পনা করে শরিফ সরকার। কিন্তু প্রথম দিন থেকেই সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি নিয়ে আপত্তি তোলে একাধিক শরিক দল। এর মধ্যে অন্যতম সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকর আলি ভুট্টোর তৈরি পাকিস্তান পিপল্স পার্টি বা পিপিপি।
শরিফ সরকারের অন্যতম বড় শরিক হল পিপিপি। পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশ এই রাজনৈতিক দলটির গড় হিসাবে পরিচিত। পিপিপির অভিযোগ, চোলিস্তান সেচ খাল প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে চাষের জলের একচেটিয়া অধিকার পাবেন পঞ্জাবের কৃষকেরা। অন্য দিকে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে সিন্ধ নদীর নিম্ন অববাহিকার সিন্ধ প্রদেশ। আর তাই প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হতে না হতেই রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে শামিল হয় পিপিপি।
গত মাসে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি বাতিল করে শাহবাজ় সরকারের ‘কমন ইন্টারেস্ট কাউন্সিল’ বা সিসিআই। জলবণ্টন এবং সেচ খাল নিয়ে পাক পঞ্জাব ও সিন্ধ প্রদেশের মধ্যে সুনির্দিষ্ট চুক্তির দাবি তুলেছে পিপিপি-সহ একগুচ্ছ শরিক দল। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটির জন্য ২১ হাজার ১৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল শাহবাজ় প্রশাসন। এর মাধ্যমে চার লক্ষ একর জমিকে চাষযোগ্য করার পরিকল্পনা ছিল তাদের।
২০২৩ সালে ‘পাকিস্তানের সবুজায়ন উদ্যোগ’ (গ্রিন পাকিস্তান ইনিশিয়েটিভ) নামের একটি প্রকল্পের সূচনা করে ইসলামাবাদ। এর মূল উদ্দেশ্য হল কৃষির উন্নতিসাধন। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটির আওতায় চোলিস্তান সেচ খাল কাটার কথা ছিল। এর মাধ্যমে পঞ্জাব, সিন্ধ ও বালোচিস্তান— এই তিনটি প্রদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় চাষের জল পৌঁছোনোর কথা রয়েছে।
চোলিস্তান প্রকল্পে কয়েক লক্ষ একর মরু এলাকায় মোট ছ’টি খাল কাটার কথা বলা রয়েছে। এর মাধ্যমে পঞ্জাব, সিন্ধ ও বালোচিস্তান— তিন প্রদেশের জন্য দু’টি করে খাল বরাদ্দ করেছিল পাক সরকার। শুধু তা-ই নয়, পাঁচটি খাল সিন্ধু নদী এবং একটি খাল সিন্ধুরই শাখানদী শতদ্রু থেকে কাটার পরিকল্পনা করে ইসলামাবাদ। গত মার্চে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটিকে কেন্দ্র করে সিন্ধ প্রদেশে সর্বাধিক বিক্ষোভ দানা বাঁধে।
গত ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের বৈসরন উপত্যকায় পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিদের হামলায় প্রাণ হারান পর্যটক-সহ ২৬ জন। এর ঠিক এক দিনের মাথায় (পড়ুন ২৩ এপ্রিল) সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিতের কথা ঘোষণা করে কেন্দ্রের মোদী সরকার। সঙ্গে সঙ্গেই এই নিয়ে যুদ্ধের হুমকি দিয়েছিল ইসলামাবাদ। কিন্তু, রক্ত ও জল একসঙ্গে বইতে পারে না বলে স্পষ্ট করে দেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। ভারতে সন্ত্রাসী হামলা বন্ধ না হলে নয়াদিল্লি যে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরবে না, তা একরকম স্পষ্ট।
১৯৬০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও তৎকালীন পাক প্রেসিডেন্ট জেনারেল আয়ুব খানের মধ্যে সিন্ধু নদীর জলবণ্টন নিয়ে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পাকিস্তানের করাচি শহরে গিয়ে এই চুক্তিপত্রে সই করেছিলেন পণ্ডিত নেহরু। দীর্ঘ ন’বছর আলোচনা চলার পর চুক্তিটি বাস্তবের মুখ দেখেছিল। এর মধ্যস্থতাকারী হিসাবে বিশ্ব ব্যাঙ্ক একটি সালিশি আদালত তৈরি করে। এর প্রবল বিরোধিতা করে এসেছে নয়াদিল্লি।
চুক্তি অনুযায়ী, সিন্ধু অববাহিকার পূর্ব দিকের তিনটি নদী, অর্থাৎ বিপাশা, ইরাবতী ও শতদ্রুর উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে ভারতের। অন্য দিকে পশ্চিম দিকের সিন্ধু, চন্দ্রভাগা ও বিতস্তার জল ব্যবহার করতে পারবে পাকিস্তান। জলের নিরিখে সিন্ধু এবং তার শাখা ও উপনদী মিলিয়ে ৩০ শতাংশ ভারত ও ৭০ শতাংশ পাবে পাকিস্তান।
পশ্চিম দিকের তিনটি নদী, অর্থাৎ সিন্ধু, চন্দ্রভাগা ও বিতস্তার জল নয়াদিল্লি যে একেবারেই ব্যবহার করতে পারবে না, এমনটা নয়। চুক্তিতে বলা হয়েছে এই তিনটি নদীর জল স্থানীয় ভাবে সেচের কাজে ব্যবহার করতে পারবে ভারত। পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন, নৌ চলাচল ও মাছ চাষের জন্য ভারতের এই তিনটি নদী ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনও বাধা নেই।
বিশ্লেষকদের দাবি, সিন্ধু জলবণ্টন চুক্তি স্থগিত হওয়ার ফলে এই নদীর অববাহিকার যে কোনও জায়গায় বাঁধ তৈরি করতে পারে ভারত। দিল্লি সেই সিদ্ধান্ত নিলে পাকিস্তানে বাড়বে জলসঙ্কট। অন্য দিকে, আফগানিস্তানেও বাঁধ তৈরি হলে জলের অভাবে ইসলামাবাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা বেশ কঠিন হবে। সেই কারণেই ‘পরিণাম ভুগতে’ হবে বলে এখন থেকে সুর চড়াচ্ছে পাক সরকার।