সাবেক বর্মা মুলুকের গৃহযুদ্ধের আগুনে মুখ পোড়াল চিন। ২৬ দিনের ব্যবধানে বেজিঙের তৈরি দু’টি লড়াকু জেটকে পর পর ‘গুলি করে নামিয়েছেন’ সেখানকার বিদ্রোহীরা। পাকিস্তানের পর মায়ানমারের রণাঙ্গনে ড্রাগনের হাতিয়ার ‘ডাহা ফেল’ করায় সেগুলির কার্যকারিতা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। মান্দারিনভাষীদের বিশ্বব্যাপী অস্ত্র ব্যবসার উপরে অচিরেই যে এর প্রভাব পড়বে, তা বলাই বাহুল্য।
চলতি বছরের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে মায়ানমারের সামরিক জুন্টা সরকারের একটি যুদ্ধবিমানকে ধ্বংস করার দাবি করে ‘কারেন্নি ন্যাশনালিটিস ডিফেন্স ফোর্স’ বা কেএনডিএফ নামের বিদ্রোহী গোষ্ঠী। ইরাবতীর কোলের কায়া রাজ্যের হপাসাং শহরের কাছে জঙ্গলের মধ্যে ভেঙে পড়ে ওই লড়াকু জেট। পরে তার ধ্বংসাবশেষের ছবি ও ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেন কেএনডিএফের ডেপুটি কমান্ডার মাউই। যুদ্ধবিমান ভেঙে পড়ার কথা স্বীকার করলেও নেপথ্যে বিদ্রোহীদের হাত থাকার কথা মানতে চায়নি ইয়াঙ্গনের জুন্টা সেনা প্রশাসনও।
স্থানীয় গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, চিনের তৈরি এফটিসি-২০০০জ়ি লড়াকু জেটকে হপাসাঙের সামরিক ঘাঁটিতে মোতায়েন রেখেছিলেন জুন্টার ফৌজি জেনারেলরা। মূলত, ১৩৪ এবং ১৩৫ নম্বর ব্যাটালিয়ানের সুরক্ষা দেওয়ার নির্দেশ ছিল সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানের। আর তাই বিদ্রোহীরা সংশ্লিষ্ট সামরিক ছাউনিকে ঘিরে ফেলার উপক্রম করলে প্রত্যাঘাত শানাতে মাটি ছাড়ে বেজিং নির্মিত এফটিসি-২০০০জ়ি লড়াকু জেট। যুদ্ধবিমানটি আকাশে উড়তেই নীচ থেকে লাগাতার গুলি ছুড়তে থাকে কেএনডিএফের বিদ্রোহীরা।
সমাজমাধ্যমে পোস্ট করা ভিডিয়োয় কেএনডিএফের ডেপুটি কমান্ডার মাউই জানিয়েছেন, প্রতিরক্ষা নয়, যখন-তখন তাঁদের উপর আক্রমণ শানাতে সংশ্লিষ্ট জেটগুলিকে ব্যবহার করে থাকে জুন্টা সরকার। এ-হেন যুদ্ধবিমান ধ্বংস করে ইয়াঙ্গনকে বড় ধাক্কা দেওয়া গিয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। এর জন্য দলের সমস্ত সদস্যের সাহসিকতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন তিনি। তবে এই অভিযানে কী কী হাতিয়ার ব্যবহার হয়েছে, তা অবশ্য স্পষ্ট করেননি মাউই।
অন্য দিকে একটি বিবৃতিতে জুন্টা প্রশাসন দাবি করে যে, রাজধানী ইয়াঙ্গন থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দূরে আচমকাই নিখোঁজ হয়ে যায় চিনের তৈরি এফটিসি-২০০০জ়ি লড়াকু জেট। এর জন্য মূলত খারাপ আবহাওয়া বা যান্ত্রিক ত্রুটিকে দায়ী করেছে তারা। বিদ্রোহীদের গুলিতে যুদ্ধবিমানটি ধ্বংস হওয়ার কথা সরকারি ভাবে স্বীকার করা হয়নি। জেটটির পাইলট প্রাণে বেঁচে আছেন কি না, তা-ও স্পষ্ট নয়।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘাত তীব্র হওয়ামাত্রই সুযোগ বুঝে জুন্টা সরকারকে বিপুল পরিমাণে হাতিয়ার সরবরাহ শুরু করে চিন। ২০২২ সালে দু’টি এফটিসি-২০০০জ়ি লড়াকু জেট সাবেক বর্মা মুলুকের বাহিনীর হাতে তুলে দেয় বেজিং। এর এক একটির দাম ৮৫ লক্ষ ডলার বলে জানা গিয়েছে। ড্রাগনভূমি থেকে এই শ্রেণির মোট ছ’টি যুদ্ধবিমান পাওয়ার কথা রয়েছে ইয়াঙ্গনের।
গত ১০ জুন সাগাইং এলাকার প্যালে টাউনশিপের কাছে ধ্বংস হয় এফ-১৭ নামের চিনের তৈরি আর একটি যুদ্ধবিমান। এই লড়াকু জেটটিকে বেজিঙের অত্যাধুনিক পঞ্চম প্রজন্মের জেএফ-১৭র পূর্বসূরি বলা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রেও বিবৃতি দিয়ে একই কথা জানায় জুন্টা সরকার। সেখানেও বলা হয়, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ভেঙে পড়েছে ওই যুদ্ধবিমান। ফলে প্রাণ হারিয়েছেন পাইলট।
কিন্তু, ওই বিবৃতির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাল্টা প্রতিক্রিয়া দিয়ে সম্পূর্ণ অন্য কথা বলে বিদ্রোহী গোষ্ঠী ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ। তাঁদের দাবি, স্থলভাগের খুব কাছে নেমে এসে হামলার পরিকল্পনা করেন সংশ্লিষ্ট লড়াকু জেটটির পাইলট। ঠিক তখনই প্রত্যাঘাত শানায় লুকিয়ে থাকা যোদ্ধারা। ফলে মেশিনগানের গুলি গিয়ে লাগে এফ-১৭-র ডানা ও ইঞ্জিনে। সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে গিয়ে বিকট শব্দ করে মাটিতে আছড়ে পড়ে সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমান।
চিনের তৈরি সমরাস্ত্রের এ-হেন ‘বেইজ্জতি’ কিন্তু প্রথম নয়। গত মে মাসে ‘অপারেশন সিঁদুর’কে কেন্দ্র করে চলা চার দিনের ভারত-পাক ‘যুদ্ধে’ তার স্পষ্ট প্রমাণ পায় বিশ্ব। লড়াই চলাকালীন নয়াদিল্লির জেট ধ্বংস করতে চিনের তৈরি পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ইসলামাবাদের বিমানবাহিনী। কিন্তু কোনও রকমের বিস্ফোরণ না ঘটিয়ে এ দেশের পঞ্জাবের সীমান্তবর্তী হোশিয়ারপুর গ্রামে এসে পড়ে বেজিঙের ওই ‘ব্রহ্মাস্ত্র’। অক্ষত অবস্থায় এলাকাবাসীরাই সেটিকে উদ্ধার করে প্রশাসনের হাতে তুলে দেন।
চিনা পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্রটি পাক বিমানবাহিনীতে ‘থান্ডারবোল্ট-১৫’ নামে পরিচিত। মূলত, ডগফাইটের সময় এটিকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। দৃষ্টিশক্তির বাইরে গিয়ে আঘাত হানার ক্ষমতা রয়েছে এই আকাশ থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্রের (এয়ার টু এয়ার মিসাইল)। হাতিয়ারটির নির্মাণকারী সংস্থার নাম চায়না অ্যারোস্পেস সায়েন্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি কর্পোরেশন বা সিএএসআইসি।
‘থান্ডারবোল্ট-১৫’-র নকশা তৈরি করেছে চিনের ৬০৭ ইনস্টিটিউট। এর গতিবেগ ম্যাক ৫ (পড়ুন শব্দের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি) বলে দাবি করে এসেছে বেজিং। পিএল-১৫তে রয়েছে ডুয়েল পাল্স সলিড প্রোপেল্যান্ট রকেট মোটর। যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়ার পর ক্ষেপণাস্ত্রটিকে গতির ঝড় তোলার ক্ষেত্রে ওই মোটরই সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা নিয়ে থাকে বলে জানা গিয়েছে।
বেজিঙের এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ২০০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার। তবে পাকিস্তানকে বিক্রি করা পিএল-১৫গুলি সর্বোচ্চ ১৪৫ কিলোমিটার পর্যন্ত আঘাত হানতে সক্ষম। বিশ্লেষকদের দাবি, কোন যুদ্ধবিমান থেকে এই অস্ত্রটি ব্যবহার করা হচ্ছে, তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিছু কিছু লড়াকু জেটের থেকে এটি ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার পর্যন্তই ছোড়া যায়। অর্থাৎ, যুদ্ধজাহাজের উপর পুরোপুরি নির্ভর করে এর পাল্লা।
সূত্রের খবর, চিনা ক্ষেপণাস্ত্রটি ২০ থেকে ২৫ কেজি উচ্চ বিস্ফোরক নিয়ে উড়তে সক্ষম। জেএফ-১৭ ব্লক থ্রি, জে-১০সি এবং জে-২০র মতো অত্যাধুনিক লড়াকু জেটে ব্যবহার করার জন্য পিএল-১৫কে তৈরি করেছে বেজিং। এই যুদ্ধবিমানগুলির নির্মাণকারী দেশও ড্রাগন। এর মধ্যে জেএফ-১৭ লড়াকু জেট রয়েছে পাকিস্তানের বিমানবাহিনীর বহরে।
মাঝ-আকাশে ডগফাইটের সময় যুদ্ধবিমান, অ্যাওয়াক্স বিমান, ট্যাঙ্কার এবং মালবাহী বিমানকে নিশানা করতে পারে পিএল-১৭। এ হেন উচ্চমূল্যের ক্ষেপণাস্ত্র কাজ না করায় হতাশ ছিল পাক বায়ুসেনা। সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটির পাশাপাশি বেজিঙের তৈরি দু’টি জেএফ-১৭ যুদ্ধবিমানকে উড়িয়ে দেয় এ দেশের বিমানবাহিনী। একে বড় ক্ষতি বলে উল্লেখ করে বিবৃতি দেয় পাক সেনার জনসংযোগ শাখা (ইন্টার সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশন বা আইএসপিআর)।
নয়াদিল্লির প্রত্যাঘাতের পর গত ৮ এবং ৯ মে রাতে ভারতের একাধিক বায়ুসেনা ঘাঁটি লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা চালায় পাকিস্তান। এতে ফল হয় হিতে বিপরীত। নয়াদিল্লি ড্রোন দিয়েই পাল্লা প্রত্যাঘাত শানিয়ে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয় পাক পঞ্জাব প্রদেশের লাহৌরের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। সেখানে চিনের তৈরি এইচকিউ-৯পি মোতায়েন রেখেছিল ইসলামাবাদ, খবর সূত্রের।
বিভিন্ন হালকা কাজে ব্যবহারযোগ্য চিনের তৈরি এক ইঞ্জিনবিশিষ্ট যুদ্ধবিমান জেএফ-১৭-এর মূল নির্মাণকারী সংস্থা চেংডু কর্পোরেশন। পাকিস্তান অ্যারোটিক্যাল কমপ্লেক্সের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট লড়াকু জেটটিকে নির্মাণ করেছে বেজিং। এর প্রথম ক্রেতা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে মায়ানমার। এর জন্য ড্রাগন সরকারের সঙ্গে ৫৬ কোটি ডলারের একটি চুক্তি করে জুন্টা প্রশাসন। সেই শর্ত মেনে ইয়াংগনকে প্রথমে এফ-১৭ সরবরাহ করে চেংডু। পরে জেএফ-১৭ হাতে পায় সাবেক বর্মা মুলুকের বাহিনী।
জুন্টা সেনার অবশ্য অভিযোগ, সংশ্লিষ্ট লড়াকু জেটগুলি যুদ্ধ করার পক্ষে একেবারে উপযুক্ত নয়। কারণ, এগুলিতে প্রায়ই ধরা পড়ছে যান্ত্রিক ত্রুটি। গত ২০ মে সাবেক বর্মা মুলুকের সরকারি ফৌজের দু’টি সামরিক হেলিকপ্টারকে গুলি করে ধ্বংস করে ‘কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি’ নামের আর একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী। সেগুলিও চিনের তৈরি ছিল বলে জানা গিয়েছে।
সূত্রের খবর, পরপর এই ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকায় বর্তমানে ধীরে ধীরে চিনা সামরিক সরঞ্জামের থেকে মুখ ফেরাতে শুরু করেছে জুন্টা প্রশাসন। বেজিঙের বদলে মস্কোর লড়াকু জেট হাতে পেতে বেশি উৎসাহী হয়েছে ইয়াংগন। গত বছর রুশ সংস্থা সুখোইয়ের তৈরি এসইউ-৩০ এসএমই যুদ্ধবিমান হাতে পায় জুন্টার বিমানবাহিনী। মান্দালয়ের মেইকটিলা বায়ুসেনা ঘাঁটিতে সেগুলিকে মোতায়েন রেখেছে তারা।
২০১৮ সালে রাশিয়ার সঙ্গে ৪০ কোটি ডলারের প্রতিরক্ষা চুক্তি করে জুন্টা সরকার। সংশ্লিষ্ট চুক্তি মেনে ওই লড়াকু জেটগুলি সরবরাহ করেছে মস্কো। সূত্রের খবর, আগামী দিনে এই ধরনের আরও সমঝোতা করতে যথেষ্ট আগ্রহী ইয়াংগন। অন্য দিকে ক্রমাগত জুন্টা সরকারকে হাতিয়ার জুগিয়ে যাওয়ায় বিদ্রোহীদের নজরে চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে বেজিঙের শি জিনপিং সরকার। বিশ্লেষকদের দাবি, আগামী দিনে ড্রাগন সরকারকে এর মূল্য চোকাতে হতে পারে।