১৯৯১ সাল। বিহারের পটনা থেকে রাশিয়ায় ডাক্তারি পড়তে গিয়েছিলেন বছর কুড়ির এক তরুণ। ভেবেছিলেন, পড়াশোনা শেষ করে আবার বাড়ি ফিরে জমিয়ে প্র্যাকটিস করবেন। ফিরেও এসেছিলেন। কিন্তু তাঁর ভাগ্যে লেখা ছিল অন্য কিছু। আবার রাশিয়া ফিরে যেতে হয় তাঁকে। রাশিয়াতেই থেকে যান। পরবর্তী কালে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে পড়েন রাশিয়ার রাজনীতির সঙ্গে!
বছর ৩৫ আগে দেশ ছেড়ে রাশিয়া পাড়ি দেওয়া সেই তরুণের নাম অভয় কুমার সিংহ। যদিও তিনি আর তরুণ নন। বয়স ৫০ পেরিয়েছে। এখন রাশিয়ার রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য নাম অভয়। রুশ প্রেসিডেন্ট খোদ পুতিনের দলের নেতা।
বর্তমানে রাশিয়ার কুরস্ক শহরের আইনসভায় একজন ডেপুট্যাট হিসাবে কাজ করছেন অভয়। তাঁর পদমর্যাদা এবং দায়িত্ব ভারতের একজন বিধায়কের সমতুল্য।
কিন্তু কে এই পটনা-পুত্র অভয়? কী ভাবেই বা রাশিয়ার রাজনীতিতে প্রবেশ করে রুশ একনায়কের দলের নেতা এবং পরে রাশিয়ার ‘বিধায়ক’ হন তিনি?
বিহারের পটনার বাসিন্দা অভয়। পড়াশোনা করেন পটনার লয়োলা হাই স্কুলে। স্কুলের পড়াশোনা শেষ করার পর অভয়কে রাশিয়ায় ডাক্তারি পড়াতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন তাঁর বাবা। ভর্তি করান রাশিয়ার কুর্স্ক স্টেট মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে।
কুর্স্ক স্টেট মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে কয়েক দিন রাশিয়াতেই প্র্যাকটিস করেন অভয়। পরে দেশে ফিরে আসেন। অভয় ঠিক করেছিলেন পটনাতেই ডাক্তারির পসার জমাবেন তিনি। চেম্বারও খুলবেন।
কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতিতে শীঘ্রই রাশিয়ায় ফিরে যেতে হয় অভয়কে। রাশিয়ায় চিকিৎসক হিসাবে প্র্যাকটিস করতে করতে ওষুধের ব্যবসাও শুরু করে ফেলেন তিনি।
ওষুধের ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠার পরে রাশিয়ায় রিয়্যাল এস্টেট এবং নির্মাণ ব্যবসাও শুরু করেন অভয়। চিকিৎসক থেকে পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন শীঘ্রই।
ধীরে ধীরে কুর্স্কে শহরে অভয়ের প্রভাব বাড়তে থাকে। কুর্স্কের ব্যবসায়ী মহলেও পরিচিত নাম হয়ে ওঠেন তিনি। ভারত থেকে রাশিয়ায় গিয়ে প্রতিপত্তি গড়ার কারণে স্থানীয় অনেকের রোষের মুখেও পড়তে হয়েছিল অভয়কে। অনেক বাধার মুখেও পড়তে হয়। কিন্তু সব বাধা অতিক্রম করেন তিনি।
বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পুতিনকে প্রথম দেখেন অভয়। তাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিতও হন। যদিও অভয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন অনেক পরে।
২০১৫ সালে পুতিনের নেতৃত্বাধীন ‘ইউনাইটেড রাশিয়া’ দলে যোগ দেন অভয়। ২০১৭ সালে প্রথম বারের জন্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
২০১৭ সালে কুর্স্ক সিটি অ্যাসেম্বলিতে ‘ডেপুট্যাট’ পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন অভয়। একটি আসনও জিতে নেন। রাশিয়ায় সরকারি পদে নির্বাচিত প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত আইনপ্রণেতা হন তিনি। ২০২২ সালের নির্বাচনেও জেতেন।
ভারতীয় এক সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় রাশিয়ায় তাঁর রাজনৈতিক যাত্রার কথা শুনিয়েছেন অভয়। জানিয়েছেন, কী ভাবে ভারতীয় রাজনীতির ছোঁয়া রাশিয়ার রাজনীতির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন তিনি।
অভয়ের কথায়, ‘‘আমি ২০১৫ সালে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলাম। রাজনীতি আমার অবিচ্ছেদ্য অংশ। জানেন তো, বিহার এবং উত্তরপ্রদেশের স্কুলের বাচ্চারাও রাজনীতি নিয়ে কথা বলে এবং বোঝে। তাই আমাকেও রাজনীতি শেখাতে হয়নি।’’
ভারত-রাশিয়া বার্ষিক সম্মেলন উপলক্ষে দু’দিনের ভারত সফরে এসেছিলেন পুতিন। বৃহস্পতিবার রাতে প্রোটোকল ভেঙে বিমানবন্দরে নিজে তাঁকে স্বাগত জানাতে যান মোদী। রুশ প্রেসিডেন্টের ভারত সফরের সময় দু’দেশের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার কথা বার বার স্পষ্ট হয়েছে।
তবে পুতিনের দশম ভারত সফরের কয়েক দিন আগে থেকেই তাঁর জন্মদেশ এবং কর্মদেশের বন্ধুত্বের কথা বার বার শোনা গিয়েছে অভয়ের মুখে। এক দিকে তিনি যেমন রাশিয়ার তৈরি ভারতের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-৪০০-এর দরাজ প্রশংসা করেন, তেমনই আবার ভারতকে এস-৪০০-এর অত্যাধুনিক এবং বর্ধিত ক্ষমতাসম্পন্ন উত্তরসূরি ‘এস-৫০০ প্রমিথিউস’ নেওয়ারও আহ্বান জানান।
অভয় বলেন, ‘‘এস-৪০০ একটি খুব ভাল আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। কিন্তু এস-৫০০ আরও আধুনিক। রাশিয়াতেই কেবল এই প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। রাশিয়া এটি অন্য কোনও দেশকে দিচ্ছে না। চিনের কাছেও এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই। রাশিয়া যদি এটি ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তা হলে ভারতই প্রথম এই অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি পাবে।’’