৬২ বছর আগে ‘টেলস অফ সাসপেন্স-৩৯’-এ প্রথম বার আত্মপ্রকাশ করে বিখ্যাত কল্পচরিত্র ‘আয়রনম্যান’। এর পর ১৯৬৮ সালে প্রথম বারের মতো আয়রনম্যানের নামে কমিকস ছাপা শুরু হয়। হু হু করে বিক্রি হতে থাকে সেই বইগুলি। স্রষ্টা স্ট্যান লি-র হাত ধরে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছোয় সেই চরিত্র।
যদিও কমিকসের মাধ্যমে ‘মার্ভেল’-এর স্পাইডারম্যান বা হাল্ক-এর জনপ্রিয়তা কোনও দিন ছুঁতে পারেনি আয়রনম্যান। তবে, ‘মার্ভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্স (এমসিইউ)’-এ একের পর এক সুপারহিরোকে নিয়ে সিনেমা তৈরি হওয়া শুরু হলে হিসাব বদলে যায়।
২০০৮ সালে ‘আয়রনম্যান’ মুক্তি পায়। নামভূমিকায় অভিনেতা রবার্ট ডাউনি জুনিয়র। তার পর থেকে চরিত্র এবং সেই চরিত্রে অভিনয় করা অভিনেতা— দু’জনেরই জনপ্রিয়তা আকাশ ছুঁয়েছে। এমসিইউ-এর অন্যতম ভিত্তি হয়ে উঠেছে আয়রনম্যান।
কিন্তু মহিলাদের মধ্যে জনপ্রিয় বিত্তশালী আমেরিকার ব্যবসায়ী-উদ্ভাবক-প্রযুক্তিবিদ টোনি স্টার্ক বা আয়রনম্যান চরিত্র কি শুধুই একটি কাল্পনিক চরিত্র? স্ট্যান লি একাধিক বার ইঙ্গিত দিয়েছেন, আয়রনম্যান বা টনি স্টার্কের চরিত্রটি তিনি বানিয়েছিলেন আমেরিকার কোটিপতি ব্যবসায়ী এবং উদ্ভাবক হাওয়ার্ড রোবার্ড হিউজ় জুনিয়রের উপর ভিত্তি করে। ঘটনাচক্রে টনি স্টার্ক চরিত্রের বাবার নাম স্ট্যান লি দিয়েছিলেন হাওয়ার্ড স্টার্ক।
কিন্তু কে এই হাওয়ার্ড? হাওয়ার্ড ছিলেন বিংশ শতাব্দীর আমেরিকার অন্যতম ব্যবসায়ী। বিমান থেকে সামরিক শিল্প— উদ্ভাবক হিসাবে বিপুল সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি। সিনেমা প্রযোজনা এবং অন্য জনহিতকর কাজের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। একই সঙ্গে মহিলাদের মধ্যেও সমান জনপ্রিয় ছিলেন হাওয়ার্ড। একাধিক অভিনেত্রীর সঙ্গে নাম জড়িয়েছিল তাঁর।
হাওয়ার্ড হিউজ় জুনিয়র একাধারে ছিলেন মহাকাশবিদ, ব্যবসায়ী, চলচ্চিত্র প্রযোজক, উদ্ভাবক এবং বিনিয়োগকারী। সামরিক এবং রিয়্যাল এস্টেট শিল্পতেও হাত পাকিয়েছিলেন তিনি। ক্যাসিনো এবং সিনেমা স্টুডিয়োও ছিল তাঁর।
১৯০৫ সালে আমেরিকার টেক্সাসের হিউস্টনে হাওয়ার্ডের জন্ম। তাঁর বাবা হাওয়ার্ড আর হিউজেস সিনিয়র ছিলেন মিসৌরির এক জন সফল উদ্ভাবক এবং ব্যবসায়ী। মা ছিলেন অ্যালেন স্টোন গ্যানো।
হাওয়ার্ডের পড়াশোনা আমেরিকাতেই। ছোটবেলা থেকে তাঁর শখ ছিল বিমানের। মাত্র ১১ বছর বয়সে হিউস্টনের প্রথম তারবিহীন (ওয়্যারলেস) ট্রান্সমিটার তৈরি করেন হাওয়ার্ড। ১২ বছর বয়সে তৈরি করেন নিজস্ব মোটরবাইক।
১৪ বছর বয়স থেকেই বিমান চালানোর তালিম নিতে থাকেন হাওয়ার্ড। বাবা ছিলেন বিত্তশালী। তাই শখপূরণের পথে অর্থ বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
১৯ বছর বয়সেই আমেরিকার অন্যতম বিত্তশালীর খাতায় নাম ওঠে হাওয়ার্ডের। পারিবারিক সম্পত্তির ৭৫ শতাংশ হাওয়ার্ডের নামে করে দেন তাঁর বাবা।
বিমানের পাশাপাশি চলচ্চিত্র জগতের প্রতিও আকর্ষণ ছিল হাওয়ার্ডের। হিউস্টন ছেড়়ে হলিউডে পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি। মাত্র ২১ বছর বয়সে সেই সময়ের অন্যতম ব্যয়বহুল ছবি ‘টু অ্যারাবিয়ান নাইটস’ প্রযোজনা করেন। ছবিটি অস্কারের জন্যও মনোনীত হয়েছিল।
১৯২৯ সাল। হাওয়ার্ড তখন ২৩ বছরের তরুণ। সে বছরই বিমান চালানোর লাইসেন্স হাতে পান হাওয়ার্ড। তার চার বছর পরে, অর্থাৎ ২৭ বছর বয়সে আস্ত একটা বিমান সংস্থা চালু করে ফেলেন তিনি। আধুনিক বিমান তৈরির কাজে হাত লাগিয়েছিল তাঁর সেই সংস্থা। একই বছরে নিজের নকশা করা বিমান সর্বোচ্চ গতিতে চালিয়ে নজির গড়েছিলেন তরুণ ব্যবসায়ী হাওয়ার্ড।
৩২ বছর বয়সে বিমান নিয়ে লাস ভেগাস থেকে সাড়ে সাত ঘণ্টার মধ্যে নিউ ইয়র্ক পৌঁছেও নজির গড়েছিলেন তিনি। আর ৩৩-এ নজির গড়েছিলেন বিমানে চড়ে ৯১ ঘণ্টায় সারা বিশ্ব ঘুরে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সামরিক ঠিকাদার হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন হাওয়ার্ড। সরকারের জন্য অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র তৈরি এবং তা নিয়ে গবেষণা করার কাজ করতেন তিনি। আর তা করে বিস্তর উপার্জনও করেছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গরম হাওয়া যখন ধীরে ধীরে ঠান্ডা হচ্ছে তখন আমেরিকার বিমান সংস্থা টিডব্লিউএ-র সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন হাওয়ার্ড। খুব শীঘ্রই সেই সংস্থার সবচেয়ে বেশি অংশের মালিকও হন।
হাওয়ার্ডের যখন ৪২ বছর বয়স তখন একটি মারাত্মক বিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়েন তিনি। হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয় তাঁকে। তবে হাসপাতালে শুয়েও মাথা খাটানো বন্ধ করেননি যুবা ব্যবসায়ী। রোগীদের কী ভাবে সহজে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই রোগীদের সুবিধার জন্য স্বয়ংক্রিয় সুইচ এবং চাকা বসানো বিছানা উদ্ভাবন করেন হাওয়ার্ড। বর্তমান সময়েও নামীদামি হাসপাতালে যে সব বিছানা দেখতে পাওয়া যায়, তা হাওয়ার্ডের নকশা করা সেই বিছানার উপর ভিত্তি করেই তৈরি।
৪৩ বছর বয়সে হলিউডে সেই সময়ের বিখ্যাত স্টুডিয়ো ‘আরকেও পিকচার্স’ কিনে নেন হাওয়ার্ড। তিনিই ছিলেন আমেরিকার প্রথম ব্যবসায়ী, যাঁর কাছে কোনও স্টুডিয়োর একক মালিকানা ছিল।
আরও বছর দুয়েক পর আবার যুদ্ধাস্ত্র তৈরির কাজে হাত লাগান হাওয়ার্ড। আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং প্রযুক্তি নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা চালাতে শুরু করে তাঁর বিমান সংস্থা। নিজের নামে একটি হাসপাতালও তৈরি করান হাওয়ার্ড। পরবর্তী কালে আমেরিকার বায়োমেডিক্যাল সংক্রান্ত গবেষণায় অন্যতম কেন্দ্র হয়ে ওঠে সেই হাসপাতাল।
আমেরিকার মহিলামহলেও যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন হাওয়ার্ড। ৬ ফুট ৪ ইঞ্চির সুপুরুষ ব্যবসায়ীর সঙ্গে নাম জড়িয়েছিল বহু অভিনেত্রীর। তাঁদের মধ্যে জিন হারলো, ক্যাথরিন হেপবার্ন, ইভা গার্ডনার, বেটি ডেভিস, জেন রাসেল, ওলিভিয়া ডি হ্যাভিল্যান্ড, রিটা হেওয়ার্থের মতো জনপ্রিয় অভিনেত্রীরও নাম ছিল। তবে কোনও সম্পর্কই টেকেনি।
সেই সময়ের অনেক আধুনিক বিমান তৈরি করেছিল হাওয়ার্ডের সংস্থা। তৈরি করেছিলেন যুদ্ধাস্ত্রও। হোটেল, ক্যাসিনো, বিলাসবহুল প্রমোদতরীতেই দিন কাটত তাঁর।
জীবদ্দশায় একাধিক বার বিমান দুর্ঘটনার মুখে পড়েছিলেন হাওয়ার্ড। শেষের দিকে তাঁর মাথা কাজ করত না ভাল ভাবে। বাড়ি ছেড়ে লাস ভেগাসের বিভিন্ন হোটেল এবং ক্যাসিনোয় থাকতে শুরু করেন।
মাদকের প্রতিও আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন হাওয়ার্ড। ১৯৭৬ সালের ৫ এপ্রিল তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। সেই সময় তিনি মেক্সিকোয় ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বিমানে করে নিয়ে গিয়ে তাঁকে হিউস্টনের একটি হাসপাতালে ভর্তি করানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ঘটনাচক্রে বিমান তৈরির জন্য খ্যাতি অর্জন করা হাওয়ার্ডের মৃত্যু হয় ওই বিমানেই। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০।
অতিরিক্ত মাদক সেবনের কারণে কার্যত চেনা যায়নি একদা সুপুরুষ হাওয়ার্ডকে। তাঁর চুল, দাড়ি, নখ লম্বা হয়ে গিয়েছিল। ওজন হয়েছিল মাত্র ৪১ কেজি। এফবিআই আঙুলের ছাপ ব্যবহার করে তাঁর মৃতদেহ শনাক্ত করেছিল।
১৯৬০-এর দশকে মার্ভেল কমিক্সের প্রাণপুরুষ স্ট্যান লি এমন এক জন সুপারহিরো তৈরির কথা ভেবেছিলেন যিনি হবেন আপাদমস্তক ব্যবসায়ী। সেই সুপারহিরোকে একাধারে হতে হত বড়লোক, সুপুরুষ, আকর্ষণীয়, কোটিপতি, যুদ্ধাস্ত্র তৈরিতে পটু এবং উদ্ভাবক। আর তা থেকেই আয়রনম্যানের জন্ম।
স্ট্যান ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তাঁর সেই চরিত্র যাঁর থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে বানানো তিনি আর কেউ নন, খোদ হাওয়ার্ড। যদিও অনেকের মতে আয়রনম্যান নন, তাঁর বাবা হাওয়ার্ড স্টার্ক চরিত্রটি আমেরিকার ব্যবসায়ী হাওয়ার্ড হিউজ়ের অনুপ্রেরণায় বানানো।