অনিবন্ধিত ভাবে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ নিয়ে উপদেশ। সমাজমাধ্যমে আর্থিক বিনিয়োগ সংক্রান্ত উপদেষ্টা অস্মিতা জিতেশ পটেলের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করল বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘সিকিউরিটিজ় অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া’ (সেবি)। সেবির তরফে অস্মিতার উপর জরিমানাও চাপানো হয়েছে।
শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ নিয়ে বিভিন্ন উপদেশ দিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন অস্মিতা। ‘শি-উল্ফ অফ স্টক মার্কেট’ এবং ‘অপশন কুইন’-এর তকমা পেয়েছিলেন। পরামর্শ দিয়ে আয় করেছিলেন ১০৪ কোটি টাকা।
কিন্তু সেবির পর্যবেক্ষণ, অনিবন্ধিত ভাবে শেয়ার বাজার সংক্রান্ত বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়ে যে টাকা অস্মিতা আয় করেছেন, তা অবৈধ। আর সেই কারণে অস্মিতা, তাঁর ট্রেডিং স্কুল এবং সংশ্লিষ্ট চারটি সংস্থার কাছ থেকে ৫৩.৬ কোটি টাকা বাজেয়াপ্ত করেছে সেবি।
কে এই অস্মিতা? ভারতীয় শেয়ার বাজারে তাঁর উত্থানই বা কী ভাবে? ১৭ বছরেরও বেশি আগে শেয়ার বাজারে পা রাখেন অস্মিতা। শেয়ার কেনাবেচাও শুরু করেন অল্প বয়স থেকে। যদিও সেই নিয়ে কোনও প্রথাগত পড়াশোনা বা পূর্ব অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল না।
শেয়ার বাজারে ঢুকে তা নিয়ে নিজে নিজেই পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। বাজারে থাকতে থাকতে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। আর সে ভাবেই নাকি শেয়ার বাজারে কেনাবেচা নিয়ে ‘দক্ষ’ হয়ে ওঠেন তিনি।
এর পর শেয়ার কেনাবেচার একটি প্রক্রিয়া শুরু করেন অস্মিতা। তাঁর দাবি, ওই প্রক্রিয়ায় ধারাবাহিক ভাবে লাভ হবে। ২০২০ সালে ‘অস্মিতা পটেল গ্লোবাল স্কুল অফ ট্রেডিং’ নামে একটি সংস্থা চালু করেন অস্মিতা। খুচরো বিনিয়োগকারীদের জন্য শেয়ার বাজার সংক্রান্ত শিক্ষাকে সহজ করার লক্ষ্যে ওই সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে দাবি করেন তিনি।
নিজের সংস্থার শিক্ষামূলক কোর্সগুলির বিপণন শুরু করেন অস্মিতা। নিজেকে শেয়ার বাজার এবং অর্থ সংক্রান্ত শিক্ষায় দড় হিসাবেও দাবি করেন।
প্রথাগত শেয়ার কৌশলগুলিকে সেকেলে বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন অস্মিতা। দাবি করেছিলেন, আর্থিক স্বাধীনতার ‘বিপ্লবী হাতিয়ার’ তার সংস্থার ‘লেটস মেক ইন্ডিয়া ট্রেড’ (এলএমআইটি), ‘মাস্টার্স ইন প্রাইস অ্যাকশন ট্রেডিং’ (এমপিএটি) এবং ‘অপশন মাল্টিপ্লায়ার’ (ওএম) কোর্সগুলি। ওই কোর্সগুলির মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় সূচক এবং ‘মাস্টার প্রাইস অ্যাকশন ট্রেডিং’ এড়ানো যাবে বলেও দাবি করেছিলেন অস্মিতা।
শেয়ার বাজার এবং অর্থ সংক্রান্ত ‘পরামর্শ’ দিতে একটি ইউটিউব চ্যানেলও খুলেছিলেন অস্মিতা। ধীরে ধীরে সেই ইউটিউব চ্যানেলের ‘সাবস্ক্রাইবার’-এর সংখ্যা পাঁচ লক্ষ ছাড়ায়।
সমাজমাধ্যমেও অস্মিতার উপস্থিতি নজরকাড়া। ইনস্টাগ্রামে প্রায় ৯০ হাজার এবং ফেসবুকেও প্রায় ৭৩ হাজার ফলোয়ার রয়েছে তাঁর। আকর্ষক বিষয়বস্তু এবং আর্থিক সাফল্যের ‘প্রতিশ্রুতি’র মাধ্যমে তিনি কলেজপড়ুয়া থেকে শুরু করে পেশাদার এমনকি বধূদেরও আকর্ষিত করেছিলেন।
‘ট্রেডার্স প্রিমিয়ার লিগ’ এবং ‘ফ্রিডম প্রজেক্ট’-এর মতো বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে গ্রাহকদের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা আরও বাড়িয়ে তুলেছিলেন অস্মিতা। প্রায়শই ‘ওয়েবিনার’ এবং প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করতেন তিনি।
তবে তাঁর সেই প্রশিক্ষণ নিজস্ব আর্থিক বৃদ্ধির কৌশল বলে অভিযোগ উঠতে শুরু করলে বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নামে সেবি।
অস্মিতার বিরুদ্ধে তদন্তের শেষে ১২৮ পৃষ্ঠার বিবৃতিতে বিস্তারিত ভাবে সেবি জানিয়েছে, কী ভাবে পটেলের স্কুল টেলিগ্রাম চ্যানেলের মাধ্যমে শেয়ার বাজারে ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত সুপারিশ করেছে অবৈধ ভাবে। সেবির দাবি, অস্মিতার সেই কর্মকাণ্ড অবৈধ, কারণ ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত সুপারিশ কেবলমাত্র আইনত নিবন্ধিত বিনিয়োগ উপদেষ্টারাই দিতে পারেন।
সেবির শো কজ় নোটিসে বলা হয়েছে, ‘অস্মিতা প্যাটেল গ্লোবাল স্কুল অফ ট্রেডিং’ আর্থিক শিক্ষা দেওয়ার অজুহাতে বিভিন্ন শ্রেণির বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ পরামর্শ এবং গবেষণা বিশ্লেষক পরিষেবা প্রদান করছে।
অস্মিতার বিনিয়োগ পরামর্শ মেনে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া ৪২ জন ছাত্রের অভিযোগের পর, তাঁর এবং অন্য পাঁচ জনের উপর ‘সিকিউরিটিজ় মার্কেট’-এ কেনাবাচায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ৫৩.৬ কোটি টাকা বাজেয়াপ্তও করা হয়েছে।
অস্মিতার কাছে জবাবও তলব করেছে সেবি। কেন আর্থিক পরামর্শ দিয়ে আয় করা ১০৪.৬ কোটি টাকা বাজেয়াপ্ত করা উচিত নয় এবং কেন সমস্ত ওয়েবসাইট থেকে তাঁর পরামর্শের ভিডিয়োগুলি সরানোর নির্দেশ দেওয়া উচিত নয়, তা-ও জানতে চাওয়া হয়েছে।
সেবির তদন্তের পর অস্মিতার সংস্থা একটি স্বতঃপ্রণোদিত নিষ্পত্তির আবেদন করেছে। যদিও সেবি স্পষ্ট করেছে যে, নিষ্পত্তির জন্য আবেদন করলেও তদন্ত প্রক্রিয়া থামবে না। পাশাপাশি, পুরো বিষয় নিয়ে, আর্থিক প্রভাবীদের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং শেয়ার বাজারে এই ধরনের অবৈধ কাজকর্ম ঠেকাতে কঠোর নিয়মের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও আওয়াজ তুলেছে।