যে দিকেই তাকাবেন শুধু বন্দুক আর বন্দুক। যেন বন্দুকের মেলা! পিস্তল, রিভলভার, স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান— কী নেই সেখানে! প্রকাশ্যেই দেদারে বিকোচ্ছে সেই সব অস্ত্র। অবিশ্বাস্য লাগছে? অবিশ্বাস্য মনে হলেও সেই কুখ্যাত বেআইনি বন্দুকের বাজার রয়েছে পাকিস্তানে।
উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়ার কোহাতে সফেদ কোহ পাহাড়ের পূর্ব পাদদেশে ছোট ছোট বাড়ি নিয়ে তৈরি হয়েছে একটি বাজার। বেআইনি বন্দুকের কারবার চলে সেখানে। নাম ডেরা আদম খেল। এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বন্দুক বিক্রির অন্যতম কেন্দ্র এটি।
রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে প্রায় ১৪০ কিলোমিটার পশ্চিমে ডেরা আদম খেল বাজারের দুই কিলোমিটার জুড়ে কয়েক ডজন অস্ত্র কারখানা রয়েছে। সেখানে চিনা পিস্তল থেকে শুরু করে আমেরিকার এম১৬ স্বয়ংক্রিয় রাইফেল— বিভিন্ন নামীদামি বন্দুকের আদলে নকল বন্দুক তৈরি এবং বিক্রি হয়।
কারখানার সামনেই রয়েছে ছোট ছোট বন্দুকের দোকান। বলা হয়, বিশ্বের সব দেশের অস্ত্রসম্ভারই রয়েছে ডেরা আদম খেল বাজারে। নকলই বেশি। কিন্তু কোনও আইনই নাকি সেই বাজারে চলে না। এমনই জনশ্রুতি আফগানিস্তান সীমান্ত লাগোয়া পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের অস্ত্রের চোরাবাজার সম্পর্কে।
মূলত স্থানীয় ডেরা উপজাতির মানুষেরা ডেরা আদম খেলের বাজারে অস্ত্র বিক্রি করেন। ঐতিহ্যবাহী উৎপাদন কৌশল ব্যবহার করে আলাদা আলাদা কারিগরের হাতে তৈরি বন্দুকের ব্যবসা বংশপরম্পরায় বাবা থেকে ছেলের হাতে হস্তান্তরিত হয়। ডেরা উপজাতির মূল ব্যবসাই নাকি এই বন্দুকের। সেই বাজারে প্রকাশ্যে বিভিন্ন মাদক বিক্রির অভিযোগও উঠেছে একাধিক বার।
নব্বইয়ের দশকের চিনা ৯ এমএম পিস্তল থেকে হালফিলের জার্মান এমপি-৫ সাব-মেশিনগান পাওয়া যায় ডেরা আদম খেল বাজারে। পাওয়া যায় বিমান ধ্বংস করতে সক্ষম অস্ত্র থেকে ছোট কলম বন্দুকও। পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশের ডেরা আদম খেলের অস্ত্রবাজারে ঢেলে বিকোয় নানা প্রাণঘাতী হাতিয়ার। দাবি, নানা সংবাদমাধ্যমের।
ডেরা আদম খেল বাজারে অস্ত্রের দামও নাকি নাগালের মধ্যেই। একটু পুরনো মডেলের কালাশনিকভ রাইফেল বা পিস্তল মেলে সস্তা স্মার্টফোনের চেয়েও কম দামে। তার চেয়ে কয়েক হাজার পাকিস্তানি টাকা বেশি খরচ করলেই মিলবে বিশ্বখ্যাত অস্ত্রনির্মাতা ‘হেকলার অ্যান্ড কখ’-এর এমপি-৫।
ডেরা আদম খেল বাজারে অস্ত্রব্যবসা প্রথম শুরু হয় ১৮৯৭ সালে। আশির দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত সেনার প্রবেশের পর থেকেই ডেরা আদম খেলের অস্ত্রবাজারের রমরমা শুরু। খাইবার-পাখতুনখোয়ার রাজধানী পেশোয়ারের ৩৫ কিলোমিটার দূরের এই গঞ্জ ছিল আফগান মুজাহিদদের অস্ত্রাগার।
জনশ্রুতি, সোভিয়েত সেনার বিরুদ্ধে লড়ার জন্য আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ পাকিস্তানের আইএসআই মারফত আফগান মুজাহিদদের যে অস্ত্র পাঠাত, তারই একাংশ ঘুরপথে সীমান্ত পেরিয়ে চলে আসত পাকিস্তানের এই চোরাবাজারে।
সোভিয়েত সেনার উপর হামলা চালিয়ে ছিনিয়ে নেওয়া অস্ত্রও সে সময় নাকি দেদার বিকোত পেশোয়ার এবং আশপাশের এলাকায়।
খাইবার-পাখতুনখোয়া এবং সন্নিহিত আফগান অঞ্চলগুলিতে বসবাসকারী উপজাতি গোষ্ঠীগুলির মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র রাখার চল ব্রিটিশ জমানা থেকেই। ধীরে ধীরে দেশি-বিদেশি জঙ্গিগোষ্ঠীগুলিও আকর্ষিত হয় পাক অস্ত্র-বাজারে। বেআইনি অস্ত্র রফতানির ঘাঁটি হয় করাচি।
১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ফৌজ আফগানিস্তান ছাড়ার পরে তাদের ফেলে যাওয়া সাঁজোয়া গাড়ি, হালকা কামানও (মাউন্টেন আর্টিলারি) বিক্রি হয়েছে পাক চোরাবাজারে।
ডেরা আদম খেলের কারিগরেরা ইটালিয়ান ব্যারেটা বা বেলজিয়ান ব্রাউনিং পিস্তলের হুবহু নকল তৈরিতে সিদ্ধহস্ত। পাল্লা বা মারণক্ষমতা প্রায় সমান হলেও নকল অস্ত্র থেকে গুলি ছোড়ার সময় আওয়াজ এবং ঝাঁকুনি (রিকয়েল) বেশি হয়।
তবে ডেরা আদম খেলে বন্দুক কিনতে আসা গ্রাহকদের যা-তা গছিয়ে দেওয়া হয় না। বাতাসে গুলি ছুড়ে পরীক্ষা করতে দেওয়া হয় গ্রাহকদের। যদিও সেখানে ভারী গোলাবারুদ তৈরি বর্তমানে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে খবর।
মাঝখানে শোনা গিয়েছিল, পাকিস্তানের সেই কুখ্যাত অস্ত্রবাজারে বিক্রি পড়ে গিয়েছে। কমেছে বন্দুকের বিকিকিনি। তবে আফগানিস্তানে তালিবানের ক্ষমতা পুনর্দখলের পরে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এলাকা জুড়ে বেআইনি অস্ত্র কারবারে নতুন জোয়ার এসেছে বলে খবর।
হালকা অস্ত্রের পাশাপাশি কুখ্যাত সেই বাজারে নাকি এখন জোগান বেড়েছে মাঝারি ও ভারী মেশিনগান, মর্টার, রকেট লঞ্চারের। আফগানিস্তানে নেটো বাহিনীর রেখে যাওয়া নানা মারণাস্ত্রের কারণে রমরমা নাকি এখন আরও বেশি।
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলেছে ডেরা আদম খেল বাজারের ব্যবসার ধরনও। চালু হয়েছে ‘হোম ডেলিভারি’। নেটমাধ্যমে তালিকা দেখে পছন্দের অস্ত্র বাছাই করে ডিলারকে জানালেই লোক মারফত তা নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
সিলভেস্টার স্ট্যালোন অভিনীত ‘র্যাম্বো-৩’ ছবিতেও দেখা গিয়েছিল পাকিস্তানের এই বেআইনি অস্ত্রবাজারের দৃশ্য।