ভারতের উপর প্রথমে ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। পরে রাশিয়া থেকে তেল কেনার কারণে ‘জরিমানা’ হিসাবে আরও ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপান নয়াদিল্লির উপরে। বর্তমানে ভারতের উপরে সব মিলিয়ে ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে রেখেছেন তিনি। এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে ভারতের উপরেই মার্কিন শুল্কের হার সবচেয়ে বেশি।
ট্রাম্পের এই শুল্কনীতির জেরে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ভারতের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ধাক্কা খেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে বস্ত্রশিল্পের ক্ষেত্রে প্রতিযোগী ভিয়েতনাম এবং বাংলাদেশের তুলনায় আন্তর্জাতিক বাজারে কিছুটা পিছিয়ে পড়তে পারে ভারত। ধাক্কা খেতে পারে গহনা শিল্পও।
তবে আপাতদৃষ্টিতে ট্রাম্পের শুল্কবাণে ভারতের যে ক্ষেত্র সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে তা হল— সামুদ্রিক খাবারের ব্যবসা। ইতিমধ্যেই বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছেন সামুদ্রিক মৎস্যচাষিরা। প্রভাবিত হচ্ছে তাঁদের জীবন।
আমেরিকার চাপানো শুল্কের কারণে প্রভাব পড়ছে ভারতীয় রফতানি শিল্পে। সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত সামুদ্রিক খাবারের রফতানি। ভারতে উৎপন্ন সামুদ্রিক খাবারের যতটা না এ দেশে খাওয়া হয়, তার থেকে অনেক বেশি রফতানি হয়। মোট উৎপাদনের ৫০ শতাংশেরও বেশি রফতানি করা হয়।
সামুদ্রিক খাবারের মধ্যে ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি যে পণ্য বিদেশে রফতানি করা হয়, তা হল চিংড়ি। পরিমাণের দিক থেকে এবং মূল্যের নিরিখে ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি রফতানি হওয়া পণ্যগুলির মধ্যেও অন্যতম এটি। ভারত থেকে রফতানি হওয়া সামুদ্রিক খাবারের দুই-তৃতীয়াংশই চিংড়ি।
এত দিন চিংড়ি-সহ যে পরিমাণ সামুদ্রিক খাবার ভারত থেকে রফতানি করা হত, তার মধ্যে প্রায় ৩৫ শতাংশ যেত আমেরিকায়। বাকি অন্যান্য দেশে রফতানি করা হত।
বিগত কয়েক বছরে সামুদ্রিক খাবার রফতানির দিক থেকে ফুলেফেঁপে উঠেছিল ভারত। বাণিজ্য মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবর্ষে ৭৪৫ কোটি ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকারও বেশি) মূল্যের প্রায় ১৭ লক্ষ টন সামুদ্রিক খাবার রফতানি করেছে ভারত। এর মধ্যে চিংড়ি রফতানি থেকে আয় হয়েছিল প্রায় ৫০০ কোটি ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকারও বেশি)।
২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে ভারত থেকে ২৪০ কোটি ডলার মূল্যের চিংড়ি আমদানি করেছিল আমেরিকা। ভারতে সামুদ্রিক মৎস্যচাষকে উদীয়মান ক্ষেত্র হিসাবে দেখা হচ্ছিল এত দিন। সামুদ্রিক খাদ্যপণ্যের উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছিল ভারতের অভ্যন্তরে। বৃদ্ধি পেয়েছিল কৃত্রিম ভাবে ভেড়ি তৈরি করে চিংড়ির চাষ।
কিন্তু ট্রাম্পের শুল্কবৃদ্ধির কারণে চাপে পড়েছেন সামুদ্রিক মৎস্যচাষিরা। ভারতীয় রাজ্যগুলির মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশে সবচেয়ে বেশি চিংড়ি চাষ হয়। তাই সে রাজ্যের চাষিদের উপরই প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে বেশি।
ট্রাম্পের শুল্কনীতির পর ইতিমধ্যেই চিংড়ি রফতানি ১৫-১৮ শতাংশ কমেছে বলে মনে করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে সামুদ্রিক খাদ্যপণ্যের রফতানি কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ।
ফলে স্বাভাবিক ভাবেই সামুদ্রিক খাদ্যপণ্যের দাম কমাতে বাধ্য হচ্ছেন চাষিরা। বিশেষ মুনাফা না হওয়ায় কৃত্রিম ভাবে চিংড়ির চাষও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বেশ কিছু জায়গায়। অন্য চাষের দিকে ঝুঁকছেন সামুদ্রিক মৎস্যচাষিদের একাংশ।
মনে করা হচ্ছে আমেরিকার শুল্কের চাপে সামুদ্রিক খাদ্যপণ্য উৎপাদনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে যুক্ত প্রায় ২ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষের জীবনে প্রভাব পড়েছে।
তবে এই আবহে লাভ হচ্ছে ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, তাইল্যান্ড, ইকুয়েডরের সামুদ্রিক মৎস্যচাষিদের। কারণ, ভারতের মতো ওই দেশগুলিতেও সামুদ্রিক খাদ্যপণ্য উৎপাদনের পরিমাণ বেশি।
অথচ এর মধ্যে বেশির ভাগ দেশেই ট্রাম্পের চাপানো শুল্কের পরিমাণ ভারতের উপর চাপানো শুল্কের অর্ধেকেরও কম। আর তাই আমেরিকার বাজার দখল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ওই দেশগুলির সামুদ্রিক খাদ্যপণ্য রফতানিকারকেরা। কিছু ক্ষেত্রে সফলও হচ্ছে তারা।
তাই বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, পরবর্তী কালে শুল্ক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও আমেরিকার বাজারে সামুদ্রিক খাবার নিয়ে ঢোকার ক্ষেত্রে বেগ পেতে হবে ভারতীয় মৎস্যচাষিদের।
ইতিমধ্যেই পুরো বিষয়টি নিয়ে সক্রিয় হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। সামুদ্রিক খাবার রফতানিকারকদের বিকল্প বাজার অনুসন্ধান করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে সরকারের তরফে।
আমেরিকা ছাড়া সামুদ্রিক খাবারের চাহিদা রয়েছে এমন দেশ, যেমন রাশিয়া, ব্রিটেন, নরওয়ে, সুইৎজ়ারল্যান্ড, চিন, জাপান এবং পশ্চিম এশিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলিতে বিকল্প খোঁজার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া মৎস্যচাষে ত্রাণ দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথাও জানিয়েছে সরকার। রফতানি ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সামুদ্রিক মৎস্যচাষিরা যাতে উৎপাদন বন্ধ না করেন, সেই আবেদনও জানানো হয়েছে কেন্দ্রের তরফে।
রাজ্য সরকারগুলিও এ বিষয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ করছে বলে খবর। অন্ধ্রপ্রদেশে দীর্ঘমেয়াদি কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। সামুদ্রিক খাবার রফতানির চেষ্টা করা হচ্ছে ইউরোপের বাজারে।
এ ছাড়াও যাতে দেশে সামুদ্রিক খাবারের চাহিদা বৃদ্ধি করা যায়, সে চেষ্টাও করা হচ্ছে। বিশ্ববাজারে সামুদ্রিক খাবারের চাহিদা বিপুল। তাই চেষ্টা চলছে সামুদ্রিক খাবারের শিল্প বহুমুখী করারও।
যদিও বিশেষজ্ঞদের মত, পুরো বিষয়টি স্থিতিশীল হতে বেশ খানিকটা সময় লাগবে। আমেরিকার উন্নত পরিকাঠামো এবং শক্তিশালী বিতরণ নেটওয়ার্কের জন্য সে দেশে ব্যবসা করা অনেক লাভজনক ছিল ভারতীয় চিংড়ি রফতানিকারিদের জন্য। কিন্তু বিকল্প বাজারগুলিতে সেই সুযোগ না-ও থাকতে পারে।