অনেক চেষ্টা করেও লাভ হল না। আগামী ১৬ জুলাই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে ইয়েমেনে বন্দি ভারতীয় নার্স নিমিশা প্রিয়াকে। মঙ্গলবার তেমনটাই জানিয়েছে সে দেশের সরকার। ছ’মাস আগেই নিমিশার মৃত্যুদণ্ডের রায় শোনানো হয়েছিল। এ বার ইয়েমেন সরকার জানিয়ে দিল, আগামী ১৬ জুলাই সেই সাজা কার্যকর করা হবে।
নিমিশা কেরলের পালক্কাড় জেলার বাসিন্দা। নার্সের কাজ নিয়ে ২০০৮ সালে ইয়েমেনে গিয়েছিলেন তিনি। স্বামী টমি টমাস এবং মেয়েকে নিয়ে সে দেশেই পাকাপাকি ভাবে থাকতে শুরু করেন। ২০১৪ সালে ইয়েমেনে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা দেখা দিলে স্বামী এবং ১১ বছরের কন্যা ভারতে ফিরে এলেও নিমিশা ইয়েমেনেই থেকে গিয়েছিলেন।
নিমিশার ইচ্ছা ছিল নিজস্ব ক্লিনিক খোলার। সেই সূত্রেই ২০১৪ সালে ইয়েমেনি নাগরিক তালাল আব্দো মাহদির সঙ্গে আলাপ হয় তাঁর। মাহদি তাঁকে নতুন ক্লিনিক খুলতে সাহায্য করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন।
ইয়েমেনের আইন অনুযায়ী, সে দেশে নতুন ব্যবসা শুরু করতে গেলে দেশীয় অংশীদারের দরকার ছিল নিমিশার। ২০১৫ সালে দু’জন মিলে নতুন ক্লিনিক খোলেন। এর পর থেকেই শুরু হয় দুই অংশীদারের মতবিরোধ।
অভিযোগ, নিমিশার টাকা এবং পাসপোর্ট মাহদি কেড়ে নিয়েছিলেন। মারধর করে নাকি নিমিশাকে মাদকসেবনেও বাধ্য করেছিলেন মাহদি। আইনি কাগজপত্রে নিমিশাকে স্ত্রী হিসাবে পরিচয় দিয়ে প্রশাসনিক সাহায্য পাওয়ার পথও প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পুলিশের দ্বারস্থ হয়েও লাভ হয়নি।
মাহদির হাত থেকে বাঁচতে ২০১৭ সালের ২৫ জুলাই তাঁকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দেন নিমিশা। তাঁর দাবি, মাহদিকে ঘুম পাড়িয়ে নিজের পাসপোর্ট পুনরুদ্ধার করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। কিন্তু ওভারডোজ়ের কারণে ইয়েমেনীয় যুবক মাহদির মৃত্যু হয়।
এর পর এক সহকর্মীর সঙ্গে মিলে মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে কেটে জলের ট্যাঙ্কে ফেলে দেন নিমিশা। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। ইয়েমেন ছেড়ে পালানোর সময় ধরা পড়ে যান তিনি।
৩৭ বছর বয়সি নিমিশাকে বন্দি করা হয়েছিল রাজধানী সানার একটি কারাগারে। ইরান-সমর্থিত হুথি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সেই শহর। ২০১৮ সালে মাহদি খুনের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন নিমিশা।
২০২০ সালে একটি ইয়েমেনি আদালত তাঁকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা শোনায়। ২০২৩ সালের নভেম্বরে হুথিদের ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ সেই সাজা বহাল রাখে।
গত সাত বছরে পরিবারের তরফে নিমিশাকে বাঁচানোর ধারাবাহিক চেষ্টা করা হয়েছে। শেষ চেষ্টা হিসাবে ‘দিয়াত’ (নিহতের পরিবারের নির্ধারিত ক্ষতিপূরণের অঙ্ক) দিয়েও মেয়েকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন নিমিশার মা। কিন্তু মাহদির পরিবার তাতে রাজি হয়নি।
গত ডিসেম্বরে ইয়েমেনের সুপ্রিম কোর্ট মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি বহাল রাখে। এর পর নিমিশার প্রাণভিক্ষার আবেদন খারিজ করে দেন সে দেশের প্রেসিডেন্ট রাশাদ আল-আলিমিও। এর পর সাহায্য চেয়ে ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের দ্বারস্থ হয় নিমিশার পরিবার।
সাত বছর ইয়েমেনের জেলে বন্দি অভিবাসী তরুণীকে বাঁচানোর সব রকম চেষ্টা চলেছে। মেয়েকে বাঁচাতে ভারত সরকারের বিশেষ অনুমতি নিয়ে ২০২৪ সালের এপ্রিলে ইয়েমেনে যান নিমিশার মা। সেখান থেকেই ভারত সরকারের কাছে একাধিক বার মেয়েকে বাঁচানোর আর্জি জানিয়েছিলেন তিনি।
নিমিশার মা প্রেমা কুমারী দিল্লির উদ্দেশে বার্তা পাঠিয়েছিলেন, ‘‘শেষ বারের মতো অনুরোধ করছি, কিছু করুন। ওকে বাঁচান। সময় ফুরিয়ে আসছে। দয়া করে ওকে বাঁচান। এটাই আমার শেষ আবেদন।’’
বিদেশ মন্ত্রকও বিবৃতিতে জানিয়েছিল, সরকার সব ধরনের সাহায্য করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছিলেন, ‘‘সমগ্র পরিস্থিতি নিয়ে ভারত সরকার ওয়াকিবহাল। নিমিশার পরিবারও সব রকম চেষ্টা করছে। সরকারও যথাসাধ্য সাহায্য করছে।’’
দীর্ঘ দিন ধরে চলা এই মামলায় প্রথম থেকেই নিমিশার মুক্তির জন্য ভারত সরকারের অনুরোধ সত্ত্বেও চিঁড়ে ভেজেনি। ভারত ও ইয়েমেনের পারস্পরিক সম্পর্ক কিছুটা জটিল। অভিযোগ, সুয়েজ় খাল পেরিয়ে ভারতে আসা পণ্যবাহী জাহাজের উপর গোলাবর্ষণ করেছিল ইয়েমেন সরকার।
ইয়েমেনে ভারতের কোনও প্রতিনিধি নেই। ভারতীয়দের ইয়েমেনে যেতে ভিসার অনুমতি দেওয়া হয় না। ইয়েমেনের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিও বেশ নড়বড়ে। সরকার ও ইরানের মদতপুষ্ট বিরোধী জঙ্গিগোষ্ঠীর মধ্যে লড়াইয়ের আবহ জারি রয়েছে ইয়েমেনে।
তবে এত দিন নিমিশার মুক্তির একটি ক্ষীণ আশা ছিল। সেই উপায়ের নামই ‘দিয়াত’ বা ‘ব্লাড মানি’। ইয়েমেনের আইন বলছে, টাকা দিয়ে মধ্যস্থতা সম্ভব। ইয়েমেনের সরকারের সঙ্গে নিমিশার পরিবারের মধ্যস্থতা করার জন্য এক আইনজীবীকে নিয়োগ করা হয়। তিনি প্রায় ৩২ লক্ষ টাকা দাবি করেন। এ ছাড়া ক্ষতিপূরণের জন্য ‘ব্লাড মানি’ হিসাবে আরও দেড় কোটি টাকা প্রয়োজন ছিল।
নিহতের পরিবারকে মোটা অঙ্কের ‘ব্লাড মানি’ দিলে মুক্তির সম্ভাবনা ছিল নিমিশার। পাশাপাশি নিহত মাহদির পরিবারের সম্মতিও প্রয়োজন ছিল। কিন্তু মাহদির পরিবার নাকি নিমিশার শাস্তিই চেয়েছেন। এর মধ্যেই নিমিশার মৃত্যুদণ্ডের দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গিয়েছে।
১৬ জুলাই নিমিশার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার কথা। তিনি এখনও সানার কারাগারে বন্দি। সূত্রের খবর, এখনও আশা ছাড়েননি নিমিশা। শেষ মুহূর্তের প্রচেষ্টার ফলাফলের অপেক্ষায় রয়েছেন।