গত দু’বছর ধরে সাত ফ্রন্টে লড়ছে ইজ়রায়েল। এর মধ্যে রয়েছে গাজ়া উপত্যকার প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস, লেবাননের হিজ়বুল্লা এবং ইয়েমেনের হুথি। এ ছাড়া পর্দার আড়ালে থেকে তাদের সাহায্য করে যাওয়া ইরানের সঙ্গেও বেশ কয়েক বার মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়েছে ইহুদি ফৌজ। এ-হেন পরিস্থিতিতে ভূমধ্যসাগরের দিকে অষ্টম ফ্রন্ট খুলবে তেল আভিভ? সেখানে তুরস্কের দাপাদাপিকে তাঁদের জন্য ‘বিপজ্জনক’ বলেই মনে করছেন ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। আর তাই আঙ্কারাকে হুমকি দিয়েছেন তিনি।
চলতি বছরের ২২ ডিসেম্বর তুরস্কের ‘চিরশত্রু’ গ্রিস এবং সাইপ্রাসের রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে জেরুজ়ালেমে বৈঠক করেন ইহুদি প্রধানমন্ত্রী। আলোচনা শেষে ভূমধ্যসাগরের নিরাপত্তা নিয়ে একটি ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে সম্মত হয় এই তিন রাষ্ট্র। পরে যৌথ বিবৃতিতে নাম না করে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তায়িপ এর্ডোয়ানকে হুমকি দেন নেতানিয়াহু। ওই সময় তাঁর পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন গ্রিক প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিৎসোটাকিস এবং সাইপ্রাসের প্রেসিডেন্ট নিকোস ক্রিস্টোডোলিদেস।
যৌথ বিবৃতিতে ঠিক কী বলেছেন নেতানিয়াহু? ইহুদি প্রধানমন্ত্রীর কথায়, ‘‘কেউ কেউ পুরনো সাম্রাজ্য ফিরে পাওয়ার অলীক স্বপ্ন দেখছেন। তাঁদের বলব, ওই সমস্ত চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। আমাদের জমি হাতিয়ে নিয়ে সাম্রাজ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা ভেবে থাকলে, তার চরম খেসারত দিতে হবে। ইজ়রায়েল কখনওই তার শত্রুদের রেয়াত করে না।’’ তাঁর ওই মন্তব্যের পর পশ্চিম এশিয়া তো বটেই, নেটো-ভুক্ত তুরস্কেও হইচই পড়ে গিয়েছে।
২০১৪ সালে আঙ্কারার কুর্সিতে বসেন এর্ডোয়ান। ইহুদি গণমাধ্যম ‘দ্য জেরুজ়ালেম পোস্ট’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিনি ক্ষমতার আসার আগে মুসলিম দুনিয়ার দেশগুলির মধ্যে তুরস্কের সঙ্গে বেশ ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ সম্পর্ক রেখে চলছিল ইজ়রায়েল। কিন্তু, কিছু দিনের মধ্যেই তেল আভিভ বুঝতে পারে পুরনো অটোমান সাম্রাজ্য ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখছেন এর্ডোয়ান। সেই লক্ষ্যে পারিচালিত হচ্ছে তাঁর বিদেশনীতি। শুধু তা-ই নয়, ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় সামরিক অভিযানের মাধ্যমে মাত্রচিত্র বদলের পরিকল্পনা আছে তাঁর। ফলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটতে শুরু করে।
ইউরোপ ও এশিয়ার ইতিহাসে অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের আলাদা গুরুত্ব আছে। ১২৯৯ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন প্রথম ওসমান, যা টিকে ছিল পরবর্তী ৬০০ বছর। খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতকে উন্নতির শিখরে ওঠে এই অটোমান সাম্রাজ্য। ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার সম্পূর্ণ গ্রিস, সাইপ্রাস, পশ্চিম এশিয়ার ইজ়রায়েল, প্যালেস্টাইন, সিরিয়া এবং উত্তর আফ্রিকার বিস্তীর্ণ এলাকা ছিল এর অন্তর্ভুক্ত। আজকের তুরস্ককে কেন্দ্র করেই তিন মহাদেশ জুড়ে এ-হেন বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন অটোমান শাসকেরা।
১৯১৪-’১৮ সাল পর্যন্ত চলা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরির সামরিক জোটে যোগ দেয় অটোমান সাম্রাজ্য। লড়াইয়ে ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের মিত্র বাহিনীর কাছে পরাজয় ঘটলে পতন হয় আঙ্কারার। বিরাট সাম্রাজ্যকে কেটেছেঁটে অনেকটাই ছোট করে দেয় বিজয়ী পক্ষ। সেই গ্লানি কখনওই ভুলতে পারেনি তুরস্কের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃবর্গ। ফলে ২১ শতকে পুরনো সাম্রাজ্য ফেরানোর স্বপ্ন এর্ডোয়ান দেখাতে শুরু করলে হু-হু করে বাড়তে থাকে তাঁর জনপ্রিয়তা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পরাজিত অটোমান সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে একাধিক চুক্তি করে ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং গ্রিসের মিত্রপক্ষ। এর মধ্যে অন্যতম ছিল সুইৎজ়ারল্যান্ডের লোজ়ানে হওয়া সমঝোতা। এতে গ্রিস, সাইপ্রাস-সহ ভূমধ্যসাগরীয় একাধিক দ্বীপ, বলকান এলাকা এবং গোটা পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকা হাতছাড়া হয় আঙ্কারার। সংশ্লিষ্ট চুক্তিটির জেরে দক্ষিণ ইউরোপে আধুনিক তুরস্কের আত্মপ্রকাশ ঘটে বলা যেতে পারে। কিছুটা বাধ্য হয়েই অটোমান নেতৃত্বকে তা মেনে নিতে হয়েছিল, যার সালটা ছিল ১৯২৩।
গত শতাব্দীর ৭০-এর দশকের মাঝামাঝি প্রথম বার পুরনো অটোমানের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের পরিচয় দেয় আঙ্কারা। ওই সময় আচমকাই সামরিক অভিযান চালিয়ে সাইপ্রাসের উত্তর অংশ দখল করে তুর্কি সেনা। ফলে ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রটির প্রায় এক তৃতীয়াংশ কব্জা করতে সক্ষম হয় তাঁরা। পরবর্তী সময়ে ‘তুর্কি প্রজাতন্ত্র উত্তর সাইপ্রাস’ বা টিআরএনসি (টার্কিস রিপাবলিক অফ নর্দার্ন সাইপ্রাস) নাম দিয়ে সেখানকার শাসনব্যবস্থা চালাতে থাকে আঙ্কারা।
তুরস্কের এ-হেন পদক্ষেপে প্রমাদ গোনে গ্রিস। কারণ, সাইপ্রাসের একাংশ দখল করার পর এজ়িয়ান সাগরে আথেন্সের একাধিক দ্বীপকে নিজেদের এলাকা বলে ‘আগ্রাসী’ হয়ে ওঠে এর্ডোয়ানের সেনা। ফলে দুই নেটো-ভুক্ত দেশের মধ্যে তীব্র হয় সীমান্ত সংঘাত। এর জেরে পুরনো অটোমান সাম্রাজ্যকে ফিরিয়ে আনতেই আঙ্কারা যে এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তা ইজ়রায়েলের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে এর্ডোয়ানের ‘নাক গলানো’ তেল আভিভের রক্তচাপ আরও বাড়িয়ে তোলে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
সম্প্রতি এই ইস্যুতে ‘দ্য জেরুজ়ালেম পোস্ট’-এ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ইজ়রায়েলি ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফের সাবেক মেজর জেনারেল গিওরা আইল্যান্ড। তাঁর দাবি, ‘‘আঙ্কারা ধীরে ধীরে যে ভাবে তার প্রভাব বাড়াচ্ছে, তাতে আগামী দিনে তাঁদের লক্ষ্য হবে ইজ়রায়েল। কারণ পশ্চিম এশিয়ার ইহুদি রাষ্ট্রকে কব্জা করা ছাড়া পুরনো অটোমান সাম্রাজ্যকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।’’ তবে উচ্চাকাঙ্ক্ষী এর্ডোয়ানকে আটকানো তেল আভিভের জন্য যে ‘অ্যাসিড টেস্ট’ হতে চলেছে, তা বলাই বাহুল্য।
একসময়ে তুর্কি ফৌজের সঙ্গে নিয়মিত সামরিক মহড়ায় অংশ নিত আইডিএফ। ‘দ্য জেরুজ়ালেম পোস্টে’ প্রকাশিত প্রবন্ধে সেই সময়কার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বিস্ফোরক তথ্য দিয়েছেন সাবেক মেজর জেনারেল গিওরা। তাঁর দাবি, ‘‘ওই সময় আঙ্কারার এক পদস্থ সেনাকর্তার মুখে দেশের সীমান্ত বিস্তারের কথা বলতে শুনেছিলাম। ১৯২৩ সালের সমঝোতা যে তাঁরা কখনওই মেনে নিতে পারেননি, সেটা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ফলে তখন থেকেই গোপনে গোপনে প্রস্তুতি নিতে থাকে তেল আভিভ।’’
তুর্কি সেনা অফিসারকে উদ্ধৃত করে আইডিএফের পদস্থ আধিকারিক গিওরা লিখেছেন, ‘‘মহান অটোমান সাম্রাজ্যকে পুরোপুরি ভাবে ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন এখনই দেখছে না আঙ্কারা। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনটি জায়গায় সীমান্ত বিস্তারের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। তার মধ্যে অন্যতম হল সিরিয়া, লেবানন ও ইজ়রায়েলকে দখল করে তুরস্কের সীমানাকে একেবারে সৌদি আরবের গায়ে নিয়ে যাওয়া। সিরিয়ার আলেপ্পো এবং ইরাকের মসুল শহরের মধ্যবর্তী এলাকা পর্যন্ত একটা নিয়ন্ত্রণরেখা তৈরি করতে চাইছেন প্রেসিডেন্ট এর্ডোয়ান, যার উত্তর দিকে থাকবে তাঁর ফৌজ।’’
১৯২৩ সালের সমঝোতা অনুযায়ী, এজ়িয়ান সাগর গ্রিসকে তুরস্কের থেকে আলাদা করেছে। আঙ্কারা মনে করে সীমান্তের এই বিন্যাস একেবারেই ঠিক নয়। গিওরা জানিয়েছেন, ওই এলাকার সমস্ত দ্বীপের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চাইছেন প্রেসিডেন্ট এর্ডোয়ান, যা আথেন্সের সার্বভৌমত্বকে পুরোপুরি নষ্ট করবে। পাশাপাশি এর জেরে স্বাধীন দেশের অস্তিত্ব হারাবে সাইপ্রাস। এতে ইহুদি রাষ্ট্রে হামলা চালানো যে তাদের পক্ষে অনেকটাই সুবিধা হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, তুরস্কের ‘অটোমান স্বপ্ন’ ভেঙে দিতে আগামী দিনে দ্বিমুখী পদক্ষেপ নেবে ইজ়রায়েল। প্রথমত, আঙ্কারার মুদ্রা লিরার অবমূল্যায়ন ঘটিয়ে তাদের অর্থনীতির চরম ক্ষতিসাধন। দ্বিতীয়ত, মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় সামরিক জোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’ বা নেটো (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) থেকে তুরস্কের বহিষ্কার। সেই কারণেই সংশ্লিষ্ট সংগঠনটির অন্যতম সদস্য গ্রিসকে কাছে টেনেছে তেল আভিভ।
বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, তুরস্ককে নেটোর থেকে আলাদা করা ইহুদিদের পক্ষে খুব কঠিন হবে না। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটে থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে রাশিয়ার সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলছেন এর্ডোয়ান। আর তাই মস্কোর থেকে ‘এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ’ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনতে দু’বার ভাবেননি তিনি। ক্রেমলিনের থেকে বিপুল পরিমাণে খনিজ তেলও কিনছে আঙ্কারা। এই ইস্যুগুলিকে সামনে রেখে আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের ব্রিটেন বা ফ্রান্সের মতো দেশগুলিকে উস্কানি দেওয়ার সুযোগ পাবে ইজ়রায়েল।
তবে বেশ কিছু জায়গায় সমস্যাও রয়েছে। গত ১০ বছরে তুমুল জাতীয়বাদী এবং অটোমান যুগের ইসলামীয় আদর্শকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন এর্ডোয়ান। পাশাপাশি, পশ্চিম এশিয়ার প্যালেস্টাইনপন্থী গোষ্ঠীগুলিকে সমর্থন করে আরব দেশগুলির ‘নয়নের মণি’ হয়ে উঠেছে আঙ্কারা। ফলে তেল আভিভ নতুন ফ্রন্ট খুললে তাঁদের সমর্থন পুরোপুরি পেতে পারে তুর্কি ফৌজ, যা আইডিএফের জন্য দুঃস্বপ্নের চেয়ে কম নয়, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
তা ছাড়া সিরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার সঙ্গে যথেষ্ট ‘ভাল’ সম্পর্ক রয়েছে এর্ডোয়ান সরকারের। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, তাঁকে দামাস্কাসের কুর্সিতে বসানোর মূল কারিগর হল আঙ্কারা। তা ছাড়া গত কয়েক বছরে সামরিক দিক থেকে যথেষ্ট উন্নতি করেছে তুরস্ক। বর্তমানে তুর্কি সেনার হাতে রয়েছে অত্যাধুনিক ড্রোন এবং হাইপারসনিক (শব্দের চেয়ে পাঁচ গুণ গতিশীল) ক্ষেপণাস্ত্র। ফলে লড়াইয়ের ময়দানে তাঁদের হারানো একেবারেই সহজ নয়।
গত মে মাসে ‘অপারেশন সিঁদুর’ চলাকালীন খোলাখুলি ভাবে পাকিস্তানের পাশে এসে দাঁড়ায় তুরস্ক। ওই সামরিক অভিযান পরবর্তী সময়ে আঙ্কারার বিরুদ্ধে একাধিক ব্যবস্থা নেয় নয়াদিল্লি। প্রভাব পড়ে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে। তা ছাড়া সাইপ্রাস এবং গ্রিস সফরও করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বিশেষজ্ঞদের দাবি, এর্ডোয়ানের বিরুদ্ধে ফ্রন্ট খুললে ভারতের সমর্থনও পাবে ইহুদিরা। ভূ-রাজনৈতিক এই অশান্তি তেল আভিভ ও দিল্লির সম্পর্ককে আরও মজুবত করবে বলেই মনে করছেন তাঁরা।