লোকসভা এবং রাজ্যসভার পর রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কাছ থেকে অনুমোদন পেয়েছে সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে পাশ হওয়া ‘সাসটেনেবল হারনেসিং অ্যান্ড অ্যাডভান্সমেন্ট অফ নিউক্লিয়ার এনার্জি ফর ট্রান্সফর্মিং ইন্ডিয়া (শান্তি)’ বিল।
বৃহস্পতিবার সংসদে বিলটি পাশ হয়। একটি সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি মুর্মুও শনিবার শান্তি বিলে অনুমোদন দিয়েছেন। এখন আর সেটি বিল নয়, আইন।
ভারতের পরমাণু শক্তি খাতে বেসরকারি সংস্থাগুলির প্রবেশের পথ প্রশস্ত করেছে এই আইন। একই সঙ্গে ১৯৬২ সালের পরমাণু শক্তি আইন এবং ২০১০ সালের পরমাণু দুর্ঘটনা দায়বদ্ধতা আইন বাতিল করেছে, যা ভারতে অসামরিক পারমাণবিক খাতের বিকাশে বাধা দিচ্ছিল বলে দাবি উঠেছিল।
শান্তি আইন নিয়ে ইতিমধ্যেই দেশ জুড়ে হইচই পড়েছে। কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারকে এই নিয়ে কাঠগড়াতেও দাঁড় করিয়েছে বিরোধীরা।
কিন্তু কী এই শান্তি আইন? খাতায়-কলমে এই আইনের প্রধান লক্ষ্য, স্বাধীনতার ১০০ বছর তথা ২০৪৭-এ পরমাণু বিদ্যুতের পরিমাণ ১০০ গিগাওয়াটে নিয়ে যাওয়া।
দেশের পরমাণু বিদ্যুৎক্ষেত্র বেসরকারি সংস্থার জন্য খুলে দিয়ে এবং পরমাণু চুল্লি সরবরাহকারী বিদেশি সংস্থাগুলিকে যে কোনও দুর্ঘটনা থেকে দায়মুক্ত করে দিয়ে মোদী সরকার সংসদে ‘শান্তি’ বিল এনেছিল।
বিরোধীরা এই বিল সবিস্তারে আলোচনার জন্য সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বা যৌথ সংসদীয় কমিটিতে পাঠানোর দাবি তুলেছিল। তবে সেই দাবি অগ্রাহ্য করে মোদী সরকার লোকসভায় এই বিল পাশ করিয়ে দেয়। পরে তা পাশ হয় রাজ্যসভাতেও।
ইউপিএ সরকারের আমলে ভারত-আমেরিকা পরমাণু চুক্তির পরে অসামরিক পরমাণু দায়বদ্ধতা আইন তৈরি হয়েছিল। এর মূল বিষয় ছিল, পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রে যদি পরমাণু চুল্লিতে ত্রুটির ফলে দুর্ঘটনা ঘটে, তা হলে সেই চুল্লি সরবরাহকারী বিদেশি সংস্থাগুলিকে তার দায় নিয়ে পুরো ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
মোদী সরকারের দাবি, পুরনো সেই আইনের ফলে পরমাণু বিদ্যুৎক্ষেত্রে লগ্নি করছে না বেসরকারি সংস্থাগুলি। কারণ, পরমাণু চুল্লিতে দুর্ঘটনার ফলে এত দিন পরমাণু চুল্লি সরবরাহকারী সংস্থার কাছে যত খুশি ক্ষতিপূরণ চাইতে পারত পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন সংস্থাগুলি।
এ বার সেই ক্ষতিপূরণের দাবির উপরে ঊর্ধ্বসীমা চাপানো হবে বলেই জানিয়েছে সরকার। যে সব বেসরকারি সংস্থা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাবে, তারা ক্ষতিপূরণ দেবে। বিদেশি সংস্থাগুলির সঙ্গে তারা এ বিষয়ে চুক্তি করবে। দুর্ঘটনার দায় কেন্দ্রও নিজের ঘাড়ে নেবে। বেসরকারি সংস্থাগুলির ক্ষতিপূরণ যথেষ্ট না হলে সরকারের পরমাণু দায়বদ্ধতা তহবিল থাকবে।
মোদী সরকারের দাবি, পরমাণু বিদ্যুৎক্ষেত্রে বেসরকারি লগ্নি আনতে ও আমেরিকা থেকে পরমাণু চুল্লির আমদানির রাস্তা খুলতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আর সেই কারণেই বিলের নামকরণ হয়েছে ‘শান্তি’ বা ‘সাসটেনেবল হারনেসিং অ্যান্ড অ্যাডভান্সমেন্ট অফ নিউক্লিয়ার এনার্জি ফর ট্রান্সফর্মিং ইন্ডিয়া’ বিল।
মোদী সরকার এ-ও যুক্তি দিয়েছে, ইউপিএ জমানায় আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তি হলেও লাভ হয়নি। আইনি দায়ের ফলেই গত ১৫ বছরে আমেরিকার কোনও সংস্থা পরমাণু চুল্লি জোগানে রাজি হয়নি। মোদী সরকার তাই পরমাণু শক্তি আইনের সঙ্গে ইউপিএ সরকারের সেই দায়বদ্ধতা বিলও প্রত্যাহার করে নতুন ‘শান্তি’ বিল এনেছে।
মনে করা হচ্ছে, আমেরিকাও দীর্ঘ দিন ধরে এ নিয়ে চাপ দিচ্ছে ভারতকে। বিশেষ করে ভারত-আমেরিকার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যচুক্তির প্রেক্ষিতে ট্রাম্প প্রশাসন চাইছে, আমেরিকা থেকে পরমাণু চুল্লি কেনার রাস্তা খুলুক ভারত। বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়াল অবশ্য দাবি করেছেন, পরমাণু চুল্লির সঙ্গে ভারত-আমেরিকার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যচুক্তির সম্পর্ক নেই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই ভারতের ‘শান্তি’ আইন ২০২৫-কে স্বাগত জানিয়েছে। বিলটি পাশ হওয়ার পরেই এটিকে ‘শক্তিশালী শক্তি নিরাপত্তা অংশীদারি’ এবং ‘শান্তিপূর্ণ বেসামরিক পরমাণু সহযোগিতা’র দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে মন্তব্য করেছে আমেরিকা।
অন্য দিকে, লোকসভায় শান্তি বিল পেশের পর থেকেই তা নিয়ে আপত্তি তুলেছেন বিরোধীরা। বিরোধী কংগ্রেসের অভিযোগ, বেসরকারি সংস্থার কাছে মুনাফাই প্রধান লক্ষ্য। সেই বেসরকারি সংস্থাকে ঝুঁকিপূর্ণ পরমাণুক্ষেত্রে কাজকর্ম করার ক্ষমতা দেওয়া হবে। অথচ তার দায় থাকবে সীমিত। রক্ষাকবচও দেওয়া হবে। সীমিত করে দেওয়া হবে বিচারবিভাগের কাছে সুরাহা চাওয়ার উপায়ও।
শিল্পপতি গৌতম আদানির আদানি গোষ্ঠী নভেম্বরে ঘোষণা করেছিল, পরমাণু বিদ্যুৎক্ষেত্রে লগ্নি করবে। ডিসেম্বর মাসেই মোদী সরকার পরমাণু বিদ্যুৎক্ষেত্র বেসরকারি সংস্থার জন্য খুলে দেওয়ার জন্য আইন পাশ করেছে। এ ঘটনা নিছকই কাকতালীয় কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে কংগ্রেস।
কংগ্রেস-সহ বিরোধীদের ইঙ্গিত, আমেরিকার ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনকে খুশি করতেই মোদী সরকার এই নীতি নিচ্ছে। পাশাপাশি তাদের প্রশ্ন, কার চাপে এই আইনি দায়বদ্ধতা প্রত্যাহার করা হচ্ছে? দুর্ঘটনা ঘটলে বা তার দায় কে নেবে?
শান্তি আইন নিয়ে মোদী সরকারের তাড়হুড়ো দেখে কংগ্রেস সাংসদ মণীশ তিওয়ারি গোড়াতেই প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘‘সরকারি সম্পদ লিজ়ে নিয়ে ব্যবসা করে সাম্রাজ্য গড়ে তোলা আদানি গোষ্ঠী নভেম্বর মাসেই পরমাণু বিদ্যুৎক্ষেত্রে পা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ডিসেম্বরে বেসরকারি সংস্থাকে পরমাণু বিদ্যুৎক্ষেত্রে লগ্নির ছাড়পত্র দিয়ে সরকার বিল আনছে। এ কি কাকতালীয়?”
সেই অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছে কেন্দ্র। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের প্রতিমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহ বলেন, এখন ৮.৮ গিগাওয়াট পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। ২০৪৭-এ তা ১০০ গিগাওয়াটে নিয়ে যাওয়া, যাতে পেট্রল-ডিজ়েল আমদানির উপরে নির্ভরতা কমানো সম্ভব হয়, সে জন্যই পরমাণু বিদ্যুৎক্ষেত্রে বেসরকারি লগ্নি প্রয়োজন।
শান্তি আইন নিয়ে যুক্তি-পাল্টা যুক্তি চলছেই। তবে এই আইনের মূল বিষয়, বেসরকারি সংস্থা এবং যৌথ উদ্যোগগুলিকে সরকারের লাইসেন্সের অধীনে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, মালিকানা, পরিচালনা এবং বন্ধ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।