এলিয়েন বা ভিন্গ্রহের প্রাণী সম্পর্কে আগ্রহ নেই, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। অন্য গ্রহে আদৌ প্রাণের অস্তিত্ব আছে কি না, থাকলেও কী রকম দেখতে তাদের— সব কিছু নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে অনেক। ভিন্গ্রহীদের নিয়ে সিনেমাও হয়েছে অনেক। ফিল্মে বার বার পৃথিবীর বুকে নেমেছে তারা। অনেকে বলেন, এখনও পৃথিবীর বুকে রয়েছে ভিন্গ্রহীরা। কোথায় রয়েছে? অনেকেরই দাবি, সেই জায়গা হল এরিয়া ৫১।
এরিয়া ৫১ হল পশ্চিম আমেরিকার নেভাদা মরুভূমির একটি অংশ। লাস ভেগাস থেকে ৮৩ কিলোমিটার দূরে গ্রুম লেকের ধারে অবস্থিত এই এলাকা। নেভাদার গ্রুম লেক কিন্তু কোনও হ্রদ নয়। এটি আসলে মরুভূমির মাঝে এক সমতল ভূমি, যেখানে প্রচুর পরিমাণে নুন ও অন্যান্য খনিজ পাওয়া যায়। সম্পূর্ণ সমতল হওয়ায় এরিয়া ৫১-এর গ্রুম লেককেই বিমানের রানওয়ে হিসাবে ব্যবহার করা শুরু হয়। তৈরি হয় ওয়ার্কশপ, হ্যাঙারও। তিন মাসের মধ্যেই তৈরি হয়ে যায় বাঁধানো রানওয়ে, কন্ট্রোল টাওয়ার।
এই জায়গার বিশেষত্ব হল, ভিন্গ্রহীদের অস্তিত্বের কাহিনি। কাহিনিগুলি কতটা সত্যি, কতটা মিথ্যে তা জানা না গেলেও আমেরিকার সেনাবাহিনী যে সব সময় এই জায়গাটিকে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে চায়, তা স্পষ্ট হয়েছে বহু বার।
তবে এর মধ্যে একটি ঘটনা মানুষের মনে ভিন্গ্রহীদের নিয়ে জল্পনা-কল্পনাকে বাড়িয়ে তুলেছে। খবর, আমেরিকার অন্যতম রহস্যময় বিমান র্যাট৫৫-কে সম্প্রতি এরিয়া ৫১-এর উপর দিয়ে উড়তে দেখা গিয়েছে।
বিমানপ্রেমী মাইকেল রোকিতা ঘাঁটি থেকে প্রায় ৪২ কিমি দূরে অবস্থিত ‘টিকাবু পিক’ থেকে সেই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করেছেন বলে দাবি। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রানওয়ে ৩২-এ অবতরণের আগে তিনি বোয়িং ৭৩৭-২০০ র্যাট৫৫ বিমানটিকে দেখেন।
মাইকেলের দাবি, অবতরণের পর বিমানটি এরিয়া ৫১-এর হ্যাঙ্গার ১৮-এর দিকে এগিয়ে যায়। এর পরেই নাকি একটি বিশাল দরজা খুলে যায় এবং বিমানটি ভিতরে ঢুকে যায়। অনেকটা যেমন কল্পবিজ্ঞানের সিনেমায় দেখা যায়।
কিন্তু কী এই র্যাট৫৫? সামনের দিকে অস্বাভাবিক লম্বা ‘হাম্পব্যাক’ বিমানটি রাডার তথ্য সংগ্রহ করে। এর কাজ, উড়ানের সময় অন্যান্য বিমানের গোপনীয়তা পরীক্ষা করা। সম্ভবত আরকিউ-৮০ ড্রোন এবং নতুন বি-২১ রাইডার স্টিলথ বম্বারের মতো বিমানগুলিকে সুরক্ষা প্রদান করে র্যাট৫৫।
আমেরিকার এডওয়ার্ডস বিমানঘাঁটির কাছে সুরক্ষিত আকাশসীমায় উড়তে দেখা গিয়েছে বিমানটিকে। এরিয়া ৫১-এর হ্যাঙ্গার ১৮-এ সেই বিমানের আগমন তাই স্বাভাবিক ভাবেই কৌতূহল তৈরি করেছে ভিন্গ্রহীদের অস্তিত্ব নিয়ে আগ্রহীদের।
এরিয়া ৫১-এর হ্যাঙ্গার ১৮-কে নিয়েই জল্পনা রয়েছে সবচেয়ে বেশি। ষড়যন্ত্রতত্ত্ববাদীদের মতে, ভিন্গ্রহীদের নিয়ে আমেরিকার সরকার গোপন প্রকল্প চালায় ওই জায়গাতেই।
সবচেয়ে চলতি গুজব হল, হ্যাঙ্গারটিতে ভিন্গ্রহীদের ভেঙে পড়া একটি যান, প্রযুক্তি এবং বহির্জাগতিক জীবনের প্রমাণ সংরক্ষণ করে রাখা রয়েছে। অনেকের আবার ধারণা, অতি গোপন মহাকাশ কর্মসূচি নিয়ে গবেষণা চলে ওই জায়গায়।
এরিয়া ৫১ নিয়ে প্রথম জল্পনা শুরু হয় ১৯৪৭ সালে রোসোয়েল বিমান দুর্ঘটনার পর। শোনা যায় এই বিমানের চালক ছিল ভিন্গ্রহীরা। আবার অনেকের মতে, সে দিন প্লেন নয়, উড়েছিল ‘স্পেসশিপ’। ভিতরে ছিল অদ্ভুত চেহারার ‘মানুষের মতো’ এক প্রাণী।
আমেরিকার প্রথম চাঁদে পা রাখা নিয়ে বিতর্কের কথা অনেকেই জানেন। ষড়যন্ত্রতত্ত্ববাদীদের মতে, ১৯৬৯ সালে চাঁদে নীল আর্মস্ট্রঙের পা রাখার ছবি নাকি এই এরিয়া ৫১-এই তোলা হয়েছিল।
ভিন্গ্রহীদের নিয়ে কোনও সঠিক তথ্যপ্রমাণ না মিললেও এরিয়া ৫১ যে এখনও সক্রিয়, সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আমেরিকা প্রথমে এই জায়গা সম্পর্কে কিছু বলতে না চাইলেও তথ্য স্বাধীনতার অধিকার আইন অনুযায়ী বেশ কিছু তথ্য জানাতে বাধ্য হয়।
সরকারের তরফে জানানো হয়, গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ (সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সি) ১৯৫৫ সালে যুদ্ধবিমানের পরীক্ষার জন্য প্রথম এই জায়গায় ঘাঁটি তৈরি করে। প্রকল্পের নাম দেওয়া হয় ‘অ্যাকোয়াটোন’।
‘ড্রাগন লেডি’ নামে পরিচিত একটি বিমানের পরীক্ষামূলক উড়ানকে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখার জন্য নাকি আদর্শ স্থান হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল এরিয়া ৫১-কে। ওই জায়গায় নাকি বিমানচালকদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হত।
এ-ও বলা হয়, ‘বার্ড অফ প্রে’, ‘এফ-১১৭এ’, ‘ট্যাসিট ব্লু’ নামক যুদ্ধবিমানগুলি তৈরি এবং পরীক্ষা করা হয়েছে এই এরিয়া ৫১-এ। ১৯৭০ সালে ‘হ্যাভ ডোনাট’ নামে একটি গোপন নথি অনুযায়ী, একটি সোভিয়েত মিগ বিমানকে নিয়ে নানা পরীক্ষা চালানো হয় ওই জায়গায়।
১৯৫৫ সালে যুদ্ধবিমানের পরীক্ষামূলক উড়ান শুরু হওয়ার পর থেকেই এরিয়া ৫১ এলাকায় অনেক উঁচুতে ইউএফও বা ভিন্গ্রহী যান দেখতে পাওয়া নিয়ে ভূরি ভূরি জল্পনা তৈরি হতে শুরু করে। একাধিক বাণিজ্যিক বিমানের চালক দাবি করেছেন, এত উচ্চতায় কোনও বিমানের ওড়া অসম্ভব। বিমানের এত উচ্চতায় ওড়ার ঘটনা ভিন্গ্রহীদের অস্তিত্বের যুক্তি আরও জোরালো করেছিল সে সময়।
এ-ও গুজব তৈরি হয়, ১৯৯৬ সালে সাংস্কৃতিক গবেষক জেরি ফ্রিম্যান হারিয়ে যাওয়া কিছু গবেষণাপত্রের অনুসন্ধান করার সময় নাকি দুর্ঘটনাক্রমে এরিয়া ৫১-এর একটি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় প্রবেশ করেছিলেন।
জেরি নাকি দাবি করেছিলেন যে, ওই এলাকায় অস্বাভাবিক আলো দেখেছিলেন তিনি। মাটির নীচে গর্জনও অনুভব করেছিলেন। পরে তিনি নাকি ভিন্গ্রহী যান নিয়ে গবেষণা করা জর্জ ন্যাপকে সেই অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছিলেন।
জর্জকে নাকি জেরি বলেছিলেন, ‘‘জায়গাটি আমার কাছে একটি শুকনো হ্রদের তলদেশের মতো মনে হচ্ছিল। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম যে, নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে উজ্জ্বল আলো জ্বলছিল। আমি হ্রদের কেন্দ্রস্থলে আলো জ্বলতে এবং নিবতে দেখেছিলাম। কোনও কিছুর গর্জনের আওয়াজও শুনেছিলাম।’’
তবে মার্কিন সেনাবাহিনী ভিন্গ্রহীদের উপস্থিতিকে বার বার গুজব বলেই উড়িয়ে দিয়েছে। যদিও এরিয়া ৫১-কে আজও কঠোর নিরাপত্তায় মুড়ে রাখা হয়েছে। নির্দিষ্ট একটি সীমা অবধিই সাধারণ মানুষ যেতে পারেন। কাঁটাতারের ওই পারে কী রয়েছে তা অগোচরেই থেকে গিয়েছে। তার মধ্যেই মাইকেলের ছবি এবং এরিয়া ৫১-য় আমেরিকার অন্যতম রহস্যময় বিমান র্যাট৫৫-এর উপস্থিতি নতুন করে জল্পনা তৈরি করেছে।