সূত্রপাত হয়েছিল ৯ অক্টোবর। তার পর গত এক সপ্তাহ ধরে আফগানিস্তানের তালিবান সরকারের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়িয়েছে পাকিস্তান। গত ৯ অক্টোবর আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে বিমানহানা চালায় পাকিস্তান বায়ুসেনা। ১০ অক্টোবর সীমান্ত লাগোয়া পকতিকা প্রদেশের মারঘি এলাকায় একটি বাজারে বিমানহানা চালানো হয়।
ঘটনাচক্রে, আফগান সরকারের বিদেশমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির ভারত সফর শুরুর দিনেই হামলা হয়েছিল কাবুলে। পাক সেনার দাবি, কাবুল এবং পকতিকায় টিটিপির ঘাঁটি ছিল বিমানহানার নিশানা। এর পর গত মঙ্গল ও বুধবার সীমান্ত সংঘর্ষের মধ্যেই দক্ষিণ আফগানিস্তানের শহর কন্দহর ও আশপাশের এলাকায় বিমান ও ড্রোন হামলা চালানো হয়। এর পরেই পুরোদস্তুর সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায় দু’পক্ষের মধ্যে।
পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক সংঘাত, বিগত কয়েক দশকে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে হওয়া সবচেয়ে গুরুতর সংঘর্ষ বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু কেন দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে কাবুল এবং ইসলামাবাদ?
নেপথ্য কারণ, নুর ওয়ালি মেহসুদ। আফগান তালিবানের একাংশের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ‘তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান’ বা টিটিপির প্রধান। ইসলামাবাদের অভিযোগ, পাকিস্তানের মাটিতে প্রতিনিয়ত আক্রমণ শানিয়ে যাওয়ার মূল কাণ্ডারী তিনিই। তাঁর নির্দেশেই বিদ্রোহীরা সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানের বুকে।
পাকিস্তানের প্রধান অভিযোগ, শীর্ষ সঙ্গীদের সঙ্গে আফগানিস্তানেই ঘাঁটি বেঁধে রয়েছেন মেহসুদ। আফগানভূম থেকেই পাকিস্তানের মাটিতে একের পর এক হামলার নির্দেশ দিচ্ছেন তিনি।
যদিও আফগানিস্তানের তরফে পাকিস্তানি বিদ্রোহীদের আশ্রয় দেওয়ার কথা অস্বীকার করা হয়েছে। বরং তালিব সরকারের পাল্টা অভিযোগ, ইসলামাবাদই তাদের প্রধান সশস্ত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামিক স্টেটের স্থানীয় শাখাকে আশ্রয় দিয়েছে।
গত সপ্তাহে কাবুলে একটি বিমান হামলা চালানো হয়েছিল। লক্ষ্য ছিল, একটি টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজ়ার। সেই গাড়িতেই নাকি অস্ত্রশস্ত্র এবং সঙ্গীদের নিয়ে ছিলেন মেহসুদ। মনে করা হচ্ছিল, বিমান হামলায় মারা গিয়েছেন টিপিপি প্রধান মেহসুদ।
আনুষ্ঠানিক ভাবে এই বিমান হামলার দায় স্বীকার করেনি পাকিস্তান। এর আগে কাবুলে শেষ বিমান হামলা চালানো হয় ২০২২ সালে। আল কায়েদা নেতা আয়মান আল-জ়াওয়াহিরিকে খতম করতে সেই হামলা চালিয়েছিল আমেরিকা। এর পর আবার গত সপ্তাহে মেহসুদকে লক্ষ্য করে সেই বিমান হামলা চালানো হয়।
পাকিস্তান মনে করছিল, ওই হামলায় মৃত্যু হয়েছে টিপিপি প্রধানের। কিন্তু এখন পাকিস্তানি কর্মকর্তারা বলছেন, সেই বিমান হামলা থেকে সম্ভবত বেঁচে গিয়েছেন মেহসুদ। টিপিপির তরফ থেকেও সেই মর্মে একটি অডিয়োবার্তা প্রকাশ করা হয়েছে।
২০১৮ সালে মার্কিন ড্রোন হামলায় তিন পূর্বসূরি নিহত হওয়ার পর টিটিপির নেতৃত্বভার কাঁধে তুলে নেন মেহসুদ। তত দিনে পাক সেনাবাহিনীর লাগাতার অভিযানের কারণে তাদের শক্ত ঘাঁটি থেকে আফগানিস্তানে চলে এসেছে টিপিপি।
টিপিপির দায়িত্ব নিয়েই সংগঠনটিকে পুনরুজ্জীবিত করার কাজে হাত দেন মেহসুদ। কৌশল পরিবর্তন করেন। কূটনৈতিক দক্ষতার সঙ্গে যুদ্ধরত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজেও নাকি হাত লাগান।
ইসলামাবাদের দাবি, ২০২১ সালে তালিবান দ্বিতীয় বার কাবুল দখলের পর রমরমা বেড়েছে মেহসুদ নেতৃত্বাধীন টিটিপির। তাদের অবাধ অভিযান যেমন বেড়েছে, তেমনই বৃদ্ধি পেয়েছে তাদের হাতে থাকা অস্ত্রশস্ত্রের পরিমাণও।
পাকিস্তানের অভিযোগ, তালিব সরকার ক্ষমতায় ফেরার পর থেকেই তাদের মাটিতে, বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী এলাকায় ঢুকে একের পর এক হামলা চালাচ্ছে টিপিপি।
অতীতে, মসজিদ এবং বাজারের মতো জনবহুল এলাকায় হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছিল টিপিপির বিরুদ্ধে। তার মধ্যে ২০১৪ সালে একটি স্কুলে হামলায় ১৩০ জনেরও বেশি শিশু নিহত হয়েছিল। এর পরেই নাকি বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন মেহসুদ।
মেহসুদের নাকি মনে হয়েছিল, সেই হামলাগুলি পাকিস্তানের জনসাধারণের মনে তাঁদের নিয়ে বিদ্বেষ তৈরি করছে। এর পরেই কৌশল বদলে সংগঠনটিকে কেবল পাক সামরিক বাহিনী এবং পুলিশকে লক্ষ্য করে হামলা চালানোর নির্দেশ দেন তিনি।
চলতি বছরের শুরুতে, মেহসুদের একটি ভিডিয়োবার্তা প্রকাশ্যে আসে। সেই ভিডিয়োয় পাক সেনাবাহিনীকে ‘ইসলামবিরোধী’ বলে আক্রমণ করেন তিনি। পাশাপাশি, রাজনীতিতে সেনার ভূমিকা নিয়েও সমালোচনা করেন। মেহসুদ মন্তব্য করেন, ‘‘পাক জেনারেলরা গত ৭৮ বছর ধরে পাকিস্তানের জনগণকে অপহরণ করে রেখেছে।’’
অন্য দিকে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পাল্টা অভিযোগ, টিটিপিই ইসলামকে ‘বিকৃত’ করেছে এবং ভারতের সমর্থন পাচ্ছে সংগঠনটি। যদিও ইসলামাবাদের সেই দাবি অস্বীকার করেছে নয়াদিল্লি।
টিপিপি প্রধান মেহসুদ এক জন ধর্মীয় পণ্ডিত। বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, ধর্মের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন তিনি। তিনটি বইও লিখেছেন মেহসুদ, যার মধ্যে ৭০০ পৃষ্ঠার একটি বইয়ে তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সময় টিপিপির উত্থান এবং বিদ্রোহ সম্পর্কে লিখেছেন।
আফগানিস্তানের সশস্ত্র সংগঠনগুলির বিশেষজ্ঞ আবদুল সঈদের মতে, উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানে বসবাসকারী পশতুন গোষ্ঠীর পক্ষে কথা বলেন মেহসুদ।
সঈদ লিখেছেন, ‘‘মেহসুদ পশতুন উপজাতির অধিকারের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন এবং তাঁর লড়াইকে একটি সশস্ত্র আন্দোলনে পরিণত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।’’ তবে উল্লেখ্য, বিশেষজ্ঞদের একাংশ এ-ও মনে করছেন, উত্তর-পশ্চিম বা আফগানিস্তানের অন্য কোথাও টিটিপির জনসমর্থন নগণ্য।