একসময় ছিলেন দেশের দুঁদে গোয়েন্দা। ভারতের হয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এখনও দিয়ে যাচ্ছেন। কথা হচ্ছে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইসর বা এনএসএ) অজিত ডোভালকে নিয়ে।
কিন্তু জানা আছে কি যে পাকিস্তানেও ছ’বছর ছদ্মবেশে কাটিয়েছিলেন এনএসএ অজিত! এবং সেখানে থাকাকালীন এক গোছা চুল তাঁকে পাকিস্তানের পরমাণু পরিকল্পনা থেকে পর্দা সরাতে সাহায্য করেছিল।
১৯৮০-এর দশক। ভিক্ষুকের বেশে ছেঁড়া শাল জড়িয়ে ধুলোয় ঢাকা ইসলামাবাদের রাস্তায় তখন ঘুরে বেড়াতেন অজিত। পাক সরকারের অলক্ষে সে দেশ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং খবর জোগাড় করতেন।
ছেঁড়া শাল এবং অপরিচ্ছন্ন চেহারার নেপথ্যে ছিল পাকা মাথা। সব সময় চোখ-কান খোলা রাখতে হত তাঁকে। তাঁর লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের সবচেয়ে নিরাপদ গবেষণাকেন্দ্রের খোঁজ প্রকাশ্যে এনে সে দেশের গোপন পরমাণু শক্তিধর হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরা।
সেই সময় যেনতেনপ্রকারেণ পরমাণু অস্ত্র পেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল পাকিস্তান। ভারতে ১৯৭৪ সালের পরমাণু পরীক্ষার পর আরও মরিয়া হয়ে ওঠে ইসলামাবাদ। চিনের মতো বন্ধু দেশের সমর্থনে আক্রমণাত্মক ভাবে নিজস্ব পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছিল তারা।
আর ভারতের হয়ে পাকিস্তানের সেই পরমাণু কর্মসূচি সংক্রান্ত গোপন তথ্যপ্রমাণ এবং নথি জোগাড় করার দায়িত্ব গিয়ে পড়ে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার ‘সুপার কপ’ হিসাবে পরিচিত ডোভালের উপর।
ভারতের কাছে খবর আসে ইসলামাবাদের কাহুতায় পরমাণু অস্ত্র নিয়ে গবেষণা চলছে এবং এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কুখ্যাত ‘খান রিসার্চ ল্যাবরেটরিজ় (কেআরএল)’। সারা বিশ্বের কাছে পাকিস্তান সে বিষয়ে মুখ না খুললেও কাহুতায় যে পাক সরকার গোপন কিছু কাজ করাচ্ছে তা সে শহরের তখনকার হালহকিকত দেখেই স্পষ্ট হয়েছিল।
সেই সময় কড়া নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলা হয়েছিল কাহুতা শহরকে। সে শহরে তখন পরমাণু বিজ্ঞানী এবং সরকারি কর্তাদের আনাগোনা বেড়েছিল। তাঁদের সুরক্ষা দিত সেনারা। সাধারণ মানুষ তাঁদের ধারেকাছেও যেতে পারতেন না।
পাক সরকারের উপর গোয়েন্দাবৃত্তি করতে নাকি সেই কাহুতাতেই পৌঁছেছিলেন ডোভাল। কয়েক মাস ধরে ভিক্ষুক সেজে তিনি ছিলেন সেখানে। সারা দিন নজরদারি চালাতেন। রাতে খবর পাঠাতেন ভারতে।
পাকিস্তান যে মরিয়া হয়ে পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে, সেই সংক্রান্ত খবর জোগাড়ে ডোভালকে সাফল্য এনে দিয়েছিল এক গোছা চুল! ডোভাল দেখেন, কেআরএল-এর বিজ্ঞানীদের বেশির ভাগই তাঁদের চুল কাটাতে আসতেন কাহুতার এক নির্দিষ্ট নাপিতের কাছে।
অন্যদের কাছে বিষয়টি সাধারণ মনে হলেও ওই সেলুন ডোভালকে এনে দেয় অনন্য সুযোগ। বেশ কয়েক দিন ধরে ওই দোকান থেকে বিজ্ঞানীদের কাটা চুলের নমুনা সংগ্রহ করেন ডোভাল। এর পর সেই চুল বিশ্লেষণের জন্য ভারতে পাঠিয়ে দেন গোপনে।
সেই পরীক্ষাতেই উঠে এসেছিল চাঞ্চল্যকর তথ্য। দেখা যায়, পাক বিজ্ঞানীদের চুলের নমুনায় ইউরেনিয়াম এবং তেজস্ক্রীয় বিকিরণের চিহ্ন রয়েছে। সত্যি হয় নয়াদিল্লির দীর্ঘ দিনের আশঙ্কা। ভারত বুঝতে পারে যে পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে হাত লাগিয়েছে পাক সরকার।
এই অভিযানটি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ছিল না। দীর্ঘ ছ’বছর ধরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তান থেকে গোপন তথ্য জোগাড় করে ভারতে পাঠিয়েছিলেন ডোভাল। অনেকের বিশ্বাস, ডোভালের প্রচেষ্টা পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্রধর হওয়ার ইচ্ছাকে প্রায় ১৫ বছর পিছিয়ে দিয়েছিল। ডি দেবদত্তের লেখা বই, ‘অজিত ডোভাল— অন আ মিশন’ বইয়ে এই সাহসী অভিযানের বর্ণনা রয়েছে।
ডোভাল কেরিয়ার শুরু করেছিলেন এক জন আইপিএস অফিসার হিসাবে। পরবর্তী কালে পরিচিত হন ‘ভারতীয় জেমস বন্ড’ নামে। কী ভাবে এক জন আইপিএস অফিসার থেকে ভারতের অন্যতম সেরা গোয়েন্দা হয়ে ওঠেন ডোভাল?
১৯৪৫ সালের ২০ জানুয়ারি উত্তরাখণ্ডের পাউরি গঢ়ওয়ালের ঝিরি বানেলসুন গ্রামে ডোভালের জন্ম। পড়াশোনা করেছেন রাজস্থানের অজমেরের সেনা স্কুল থেকে।
প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণের পর উচ্চশিক্ষার জন্য ১৯৬৭ সালে আগরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ডোভাল। সেখান থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এর পর ইউপিএসসি পরীক্ষা দিয়ে ১৯৬৮ সালে আইপিএস হন তিনি। জানা যায়, কেরিয়ারের শুরুতেই অজিতকে আন্ডারকভার এজেন্ট হিসাবে পাকিস্তানে পাঠিয়েছিল ভারত।
সে সময়ই নাকি ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে পাকিস্তানে ছ’বছর কাটিয়েছিলেন ডোভাল। ওই সময় পাক সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ভারতের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কাজ করেছিলেন পাকিস্তানে থাকা ভারতীয় দূতাবাসেও।
পাক অভিযান সফল করে ভারতে ফিরে আসেন ডোভাল। উত্তর-পূর্ব ভারত এবং পঞ্জাবে সন্ত্রাস দমনের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে তুলে দেয় সরকার। ১৯৮৮ সালে খলিস্তানি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন ব্ল্যাক থান্ডার’-এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ডোভাল। আরও বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি।
মিজ়োরামে শান্তি ফেরাতেও অন্যতম ভূমিকা পালন করেছিলেন ডোভাল। বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অফ নাগাল্যান্ড’কে দমন করতেও তিনি বিভিন্ন সফল অভিযান পরিচালনা করেছিলেন।
১৯৯৯ সালে কন্দহরে অপহৃত এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান আইসি-৮১৪ থেকে যাত্রীদের মুক্তির বিষয়ে জঙ্গিদের সঙ্গে আলোচনা করার ক্ষেত্রেও ডোভাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। পাশাপাশি, ইরাকে বন্দি ভারতীয় নার্সদের মুক্তি এবং পাকিস্তানে আটক ভারতীয় মৎস্যজীবীদের ফিরিয়ে আনা সংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
ডোভাল এক দশকেরও বেশি সময় ধরে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি)-র অপারেশন শাখার প্রধান ছিলেন। ২০০৪ সালে তিনি আইবি-র ডিরেক্টর নিযুক্ত হন। ২০০৯ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
২০১৪-য় নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই প্রাক্তন গোয়েন্দাকর্তা ডোভালকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদে নিয়ে এসেছিলেন। তার পর একে একে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জঙ্গিদমনে তাঁর নেতৃত্বেই পদক্ষেপ করে সরকার।
২০১৬ সালে উরিতে জঙ্গি হানার পর ডোভালের নেতৃত্বেই পাক অধিকৃত কাশ্মীরে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক হয়েছিল বলে দাবি। এর পর ২০১৭ সালে ডোকলামে ভারত-চিন যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। সেই সময় মূলত ডোভালের হস্তক্ষেপেই নাকি পরিস্থিতি শান্ত হয়।
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে পুলওয়ামায় সিআরপিএফ কনভয়ে জঙ্গিহানার পরে পাকিস্তানের বালাকোটে জঙ্গিশিবিরে বিমানহানার নেপথ্যেও ডোভালের মস্তিষ্ক ছিল বলে সরকারের একটি সূত্রের খবর।
পাঁচ বছর দক্ষতার সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার দায়িত্ব সামলানোর ‘পুরস্কার’ হিসাবে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের পরে পুনর্নিয়োগ পেয়েছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ওই আইপিএস আফিসার। শুধু আরও পাঁচ বছর স্বপদে পুনর্বহালই নয়, তাঁর পদমর্যাদাও বাড়িয়ে দিয়েছিল দ্বিতীয় মোদী সরকার। মোদীর প্রথম বারের প্রধানমন্ত্রিত্বের পাঁচ বছরে ডোভালের পদমর্যাদা ছিল কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীর সমান। সেই পদমর্যাদা বাড়িয়ে তাঁকে দেওয়া হয়েছিল পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদা।
দ্বিতীয় দফার মেয়াদে ডোভালের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ৩৭০ ধারা রদের পর অশান্ত হয়ে ওঠা কাশ্মীর উপত্যকায় আইনশৃঙ্খলা ফেরানোর ক্ষেত্রে। পাশাপাশি, ২০২০-র জুনে পূর্ব লাদাখের গলওয়ান উপত্যকার চিনা ফৌজের সঙ্গে ভারতীয় সেনার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পরে দফায় দফায় বেজিংয়ের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমনেও তাঁর উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ ছিল।
যদিও সে সময়ই বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে ডোভালের ‘দূরত্বের’ খবর নিয়েও জল্পনা তৈরি হয়েছিল। ফলে তৃতীয় দফায় মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি পুনর্নিয়োগ পাবেন কি না, তা নিয়ে তৈরি হয়েছিল সংশয়। তবে সেই সংশয়ে ইতি টানেন মোদী। তৃতীয় বার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদে বহাল হন ডোভাল। ডোভাল ভারতের বীরত্ব পুরস্কার ‘কীর্তি চক্র’-এর প্রাপক।