‘কৌশলগত অংশীদার’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে এসেছে শীতলতা। এই পরিস্থিতিতে শত্রুতা ভুলে চিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে ভারত। জাতীয় নিরাপত্তার নিরিখে নয়াদিল্লির এ-হেন পদক্ষেপ কতটা বিপজ্জনক? বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে আমজনতার মধ্যে ইতিমধ্যেই উঠে গিয়েছে সেই প্রশ্ন। কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার সরাসরি তার জবাব না দিলেও বর্তমানে উদ্ভূত পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে যে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তা অনেকাংশেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
চলতি বছরের ১৯ অগস্ট ভারত সফরে এসে নয়াদিল্লিতে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বা এনএসএ (ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইসার) অজিত ডোভালের সঙ্গে বৈঠক করেন চিনা বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই। সীমান্ত সংঘাত মিটিয়ে ফেলতে সেখানে দু’তরফে দীর্ঘ আলোচনা হয়। বৈঠক শেষে এই ইস্যুতে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করে বেজিং। তাতে তাইওয়ানকে নিয়ে বিস্ফোরক দাবি করে বসে ড্রাগন সরকার।
চিনা বিদেশ মন্ত্রকের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জয়শঙ্করকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ‘‘স্থিতিশীল, সহযোগিতামূলক এবং দূরদর্শী সম্পর্কের কথা মাথায় রেখে দুই দেশ নিজেদের স্বার্থে কাজ করবে।’’ পাশাপাশি, ভারত নাকি তাইওয়ানকে মূল ড্রাগনভূমির অংশ মনে করে বলে স্বীকার করে নিয়েছে, এমনটাও জানানো হয়েছিল। যদিও প্রকাশ্যে এই ইস্যুতে কোনও বিবৃতি দেননি বিদেশমন্ত্রী। বেজিঙের সরকার নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম ‘গ্লোবাল টাইমস’-এ এই সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে।
মান্দারিনভাষীদের ওই প্রেস বিজ্ঞপ্তির পরই দুনিয়া জুড়ে শুরু হয় হইচই। তবে কি চাপের কাছে নতিস্বীকার করে ‘এক চিন নীতি’ (পড়ুন ওয়ান চায়না পলিসি) মেনে নিল ভারত? না কি যুক্তরাষ্ট্রকে শিক্ষা দিতে এটা নয়াদিল্লির নতুন চাল? বিষয়টি নিয়ে বিদেশ মন্ত্রকের এক শীর্ষকর্তা গণমাধ্যমের কাছে মুখ খোলায় আরও ধোঁয়াশা তৈরি হয়। এ ব্যাপারে বেজিংকে একরকম ‘মিথ্যাবাদী’ বলেছেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদেশ মন্ত্রকের ওই কর্তার দাবি, তাইওয়ান ইস্যুতে পুরনো অবস্থান থেকে সরে আসেনি নয়াদিল্লি। বরং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারত যে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রযুক্তিগত সম্পর্ক বজায় রাখছে, তা ওয়াং ই-র সঙ্গে বৈঠকে স্পষ্ট করে দেন জয়শঙ্কর। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, অতীতে তাইপেকে নিয়ে একাধিক বার নীতি বদল করতে দেখা গিয়েছে কেন্দ্রকে। যদিও গত দেড় দশকে সেখানে একটা স্থিতিশীলতা এসেছে।
১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে মাও-জে-দঙের নেতৃত্বে চিনে প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজতান্ত্রিক সরকার। ওই সময়ে গৃহযুদ্ধে পরাজিত চিয়াং-কাই-শেক তাঁর অবশিষ্ট বাহিনীকে নিয়ে আশ্রয় নেন প্রশান্ত মহাসাগরের ফরমোসা দ্বীপে, বর্তমানে যা তাইওয়ান নামে পরিচিত। গণতান্ত্রিক কাঠামোর আদলে ফরমোসাকে একটি পৃথক দেশ হিসাবে গড়ে তোলেন চিয়াং-কাই-শেক। সরকারি ভাবে তার নামকরণ করা হয় ‘রিপাবলিক অফ চায়না’ বা আরওসি।
এ ভাবে সাবেক ফরমোসার পৃথক রাষ্ট্র হয়ে যাওয়া একেবারেই মেনে নিতে পারেনি চিন। ফলে মাওয়ের আমল থেকেই প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপটিকে তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবি করতে থাকে বেজিং। শুধু তা-ই নয়, গত শতাব্দীর ৫০-এর দশকে ‘এক চিন নীতি’র প্রবর্তন করে মান্দারিন-সরকার। সেখানে বলা হয়, আরওসির কোনও অস্তিত্ব নেই। সারা বিশ্বে চিন নামের একটাই দেশ রয়েছে। সেটা হল ‘পিপল্স রিপাবলিক অফ চায়না’ বা পিআরসি।
৫০-এর দশকে এই ‘এক চিন নীতি’ মেনে নেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। কিন্তু, ১৯৬২ সালে বেজিঙের আক্রমণে লাদাখের বিপুল এলাকা (পড়ুন আকসাই চিন) ড্রাগনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ-র দখলে চলে যাওয়ার পর বদলায় পরিস্থিতি। এ ব্যাপারে কথা বলা একরকম বন্ধ করে দেয় নয়াদিল্লি। পাশাপাশি, তাইওয়ানের সঙ্গে ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে থাকে কেন্দ্র।
২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের আমলে ‘এক চিন নীতি’র ব্যাখ্যা অন্য ভাবে করতে থাকে ভারত। ঠিক হয়, সরকারি ভাবে এ ব্যাপারে কোথাও কোনও বিবৃতি দেবে না নয়াদিল্লি। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নানা ভাবে তাইওয়ানের পাশে দাঁড়াবে কেন্দ্র। এতে ক্রমশ বেজিঙের অস্বস্তি বাড়ছিল। ফলে ২০১০ সাল থেকে ফের সীমান্ত সংঘাত তীব্র করতে থাকে ড্রাগন সরকার। কূটনৈতিক ভাবেও শুরু হয় নানা অশান্তি।
২০১০ সালের পর অরুণাচল প্রদেশকে চিনের অংশ বলে সুর চড়ায় বেজিং। পাশাপাশি, জম্মু-কাশ্মীর, লাদাখ এবং অরুণাচলের বাসিন্দাদের আলাদা করে ‘স্ট্যাপল্ড ভিসা’ দেওয়া শুরু করে মান্দারিন সরকার। এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলিকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মানতে অস্বীকার করে চিন। ফলে হু-হু করে নামতে থাকে দু’দেশের সম্পর্কের সূচক।২০১০ সালের পর অরুণাচল প্রদেশকে চিনের অংশ বলে সুর চড়ায় বেজিং। পাশাপাশি, জম্মু-কাশ্মীর, লাদাখ এবং অরুণাচলের বাসিন্দাদের আলাদা করে ‘স্ট্যাপল্ড ভিসা’ দেওয়া শুরু করে মান্দারিন সরকার। এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলিকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মানতে অস্বীকার করে চিন। ফলে হু-হু করে নামতে থাকে দু’দেশের সম্পর্কের সূচক।
অন্য দিকে, এই সময়সীমার মধ্যে তাইওয়ানের রাজধানী তাইপেতে একটি ‘প্রতিনিধি অফিস’ খোলে নয়াদিল্লি। বর্তমানে সেটি দূতাবাসের মতোই কাজ করছে। ১৯৯০ সাল থেকে ধীরে ধীরে ঊর্ধ্বমুখী হয় দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য। প্রথম পর্যায়ে মাত্র ১০০ কোটি ডলারের পণ্য লেনদেন করত দুই দেশ। ২০২৪ সালে সেই অঙ্ক বেড়ে হাজার কোটি ডলারে পৌঁছে যায়। বর্তমানে তাইওয়ানের ২২৮টি সংস্থা চুটিয়ে ব্যবসা করছে ভারতে। সেই তালিকায় আছে ফক্সকন, ডেল্টা এবং উইসট্রনের নাম।
এ দেশে মূলত ইলেকট্রনিক্স এবং গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরিতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে তাইওয়ান। সাবেক ফরমোসা দ্বীপটির সংস্থাগুলিতে কর্মরত রয়েছে ১.৭ লক্ষ ভারতীয়। তা ছাড়া গুজরাতে সেমিকন্ডাক্টর হাব তৈরিতে শিল্প সংস্থা টাটা গোষ্ঠীকে সাহায্য করছে সেখানকার সরকার। এর জন্য লগ্নি হয়েছে ১,১০০ কোটি ডলার। পাশাপাশি ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পের আওতায় এখানে বৈদ্যুতিক গাড়ি বা ইভি (ইলেকট্রিক ভেহিকল) এবং ল্যাপটপ উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তাইপের।
২১ শতকের গোড়া থেকেই উচ্চশিক্ষার জন্য ভারতীয়দের তাইওয়ান যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে প্রতি বছর এ দেশের তিন হাজারের বেশি ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনার জন্য পাড়ি দিচ্ছে ওই প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপে। এর জন্য ১০০-র বেশি বৃত্তি চালু রয়েছে সাবেক ফরমোসা দ্বীপে। ২০১২ সালে চেন্নাইয়ে চালু হয় ‘তাইপে অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’ (টিইসিসি)। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একে মাইলফলক বলে উল্লেখ করেছেন এ দেশের দুঁদে কূটনীতিকেরা।
নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেওয়ার পর অবশ্য চিন সংক্রান্ত বিদেশনীতিতে বড় বদল আনে কেন্দ্র। ২০১৮ সালে আচমকাই তাইওয়ানের বদলে চাইনিজ় তাইপে শব্দবন্ধের ব্যবহার শুরু করে অসামরিক বিমান পরিবহণ সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়া। এর জন্য নয়াদিল্লির কড়া সমালোচনা করেছিল সাবেক ফরমোসা দ্বীপের সরকার। একে বেজিঙের চাপের কাছে নতিস্বীকার বলেই মনে করেছিল তারা।
কিন্তু, ২০২০ সালে পূর্ব লাদাখে গালওয়ান সংঘর্ষের পর ফের অবস্থান বদলায় ভারত। ২০২৪ সালে মুম্বইয়ে আরও একটি টিইসিসি খোলার অনুমতি পায় তাইওয়ান। এই কেন্দ্রগুলিকে দূতাবাস হিসাবে ব্যবহার করছে তাইপে, যা নিয়ে প্রবল আপত্তি রয়েছে চিনের। এই ইস্যুতে বেশ কয়েক বার নয়াদিল্লিকে হুঁশিয়ারিও দিতে শোনা গিয়েছে বেজিংকে।
গত জুলাইয়ে ভারতীয় পণ্যে অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফলে ২৭ অগস্ট থেকে আমেরিকার বাজারে এ দেশের সামগ্রীর উপর করের মাত্রা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৫০ শতাংশ। এর জেরে সেখানে পণ্য বিক্রি করা নয়াদিল্লির পক্ষে কঠিন হতে চলেছে বলেই মনে করা হচ্ছে। এর প্রভাব সামগ্রিক ভাবে যে অর্থনীতির উপরে পড়বে, তা বলাই বাহুল্য। মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) সূচক ০.৮ শতাংশ নিম্নমুখী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে জয়শঙ্কর-ওয়াং ই বৈঠকে তিনটি জায়গায় নয়াদিল্লি সাফল্য পেয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এত দিন পর্যন্ত ভারতে বিরল খনিজ রফতানি বন্ধ রেখেছিল চিন। কিন্তু, ট্রাম্পের ‘শুল্কবাণ’ ঠেকাতে এ বার সেই দরজা খুলতে রাজি হয়েছে বেজিং। এ ছাড়া রাসায়নিক সার এবং টানেল বোরিং মেশিনও নয়াদিল্লিকে সরবরাহ করবে ড্রাগনভূমির বিভিন্ন সংস্থা। মেট্রো রেলের সম্প্রসারণ এবং পাহাড়ি এলাকায় রাস্তা নির্মাণে সুড়ঙ্গ খুঁড়তে এটি একান্ত ভাবে প্রয়োজন।
বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম বিরল খনিজের রফতানিকারী দেশ হল চিন। ভারতের আমদানি করা এই খনিজ সম্পদের ৬৬ শতাংশ পাঠায় ড্রাগন সরকার। মাঝে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় সেটা বেড়ে ৮৫ শতাংশে পৌঁছেছিল। বৈদ্যুতিন গাড়ি থেকে শুরু করে মহাকাশ গবেষণা, এমনকি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম নির্মাণেও বিপুল পরিমাণে ব্যবহার হয়ে থাকে এই বিরল খনিজ। ২০২০ সালের পর এর রফতানিতে বেজিং রাশ টানায় বিপাকে পড়ে নয়াদিল্লি। গতি হারায় বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচি।
পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির একাংশের দাবি, বিনিময়ে ভারত কঠোর ভাবে ‘এক চিন নীতি’ মেনে চলুক, তা চাইছে চিন। কিন্তু, সীমান্ত সংঘাত এবং বেজিঙের সঙ্গে ইসলামাবাদের ঘনিষ্ঠতার জেরে সেটা কখনওই নয়াদিল্লির পক্ষে সম্ভব নয়। আর তাই ‘সুচতুর’ ভাবেই বিষয়টিকে এড়িয়ে গিয়েছেন বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর। এই নিয়ে সরকারি ভাবে কোনও বিবৃতি দেয়নি কেন্দ্র।
ভারত সফর সেরে কাবুলে যান ওয়াং ই। সেখানে তালিবান এবং পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। আগামী দিনে ‘চিন পাকিস্তান অর্থনৈতিক বারান্দা’য় আফগানিস্তানকে অন্তর্ভুক্ত করছে বেজিং। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটির বড় অংশ রয়েছে পাকিস্তান অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীর বা পিওজেকেতে (পাকিস্তান অকুপায়েড জম্মু-কাশ্মীর)। ফলে তাইওয়ান প্রশ্নে বেজিঙের যাবতীয় দাবি নয়াদিল্লির পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন, বলছেন বিশ্লেষকেরা।