মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুরু করা ‘শুল্কযুদ্ধ’ মোকাবিলায় চিন সফরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। নয়াদিল্লি যখন ‘বন্ধুত্বের’ হাত বাড়াতে চলেছে, ঠিক তখনই পিঠে ছুরি বসাতে তৎপর বেজিং। ফের এক বার ‘চিরশত্রু’ পাকিস্তানের সঙ্গে ফৌজি সম্পর্ক আরও মজবুত করতে দেখা যাচ্ছে ড্রাগনকে, যা নিঃসন্দেহে রক্তচাপ বাড়িয়েছে কেন্দ্রের। এর প্রভাবে ভারত-চিন সম্পর্কে ফের শীতলতা আসতে পারে বলে ইতিমধ্যেই দাবি করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
চলতি মাসে পাক বিমানবাহিনীকে আক্রমণাত্মক ‘জে-১০এমই’ হেলিকপ্টার সরবরাহ করে চিন। মুলতান ছাউনিতে সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরের উপস্থিতিতে তা শামিল হয় ইসলামাবাদের বায়ুসেনার বহরে। শুধু তা-ই নয়, মুজ়ফ্ফরনগর ফিল্ড ফায়ারিং রেঞ্জে সংশ্লিষ্ট হেলিকপ্টারটির সামরিক সক্ষমতাও চাক্ষুষ করেন তিনি। বেজিঙের তৈরি কপ্টারটি হাতে পাওয়ায় পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির ফৌজি পাইলটদের শক্তি যে অনেকটাই বৃদ্ধি পেল, তা বলাই বাহুল্য।
এত দিন পর্যন্ত আমেরিকার তৈরি ‘এএইচ-১এফ কোবরা’ নামের একটি সামরিক হেলিকপ্টার ব্যবহার করছিল পাক সেনা। সেগুলির জায়গায় এ বার চিনের ‘জে-১০এমই’ নিতে চলেছে বলে জানা গিয়েছে। বেজিঙের দাবি, তাদের উড়ুক্কু যান রাতের ঘন অন্ধকারের মধ্যেও নিখুঁত নিশানায় হামলা চালাতে সক্ষম। এই সিরিজের হেলিকপ্টার ব্যবহার করে ড্রাগনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ বায়ুসেনা। তাদের কপ্টারগুলির নাম অবশ্য শুধু ‘জে-১০’। তবে রফতানির জন্য যে ‘জে-১০এমই’ বানানো হয়েছে, তার ক্ষমতা কিছুটা কম বলে জানা গিয়েছে।
পাক বায়ুসেনার বহরে জায়গা পাওয়া চিনা সামরিক কপ্টারটির নির্মাণকারী সংস্থাটির নাম ‘চাংহে এয়ারক্রাফ্ট ইন্ডাস্ট্রিজ় কর্পোরেশন’। জটিল যুদ্ধ পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে এর নকশা তৈরি করেছেন ড্রাগনের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। বেজিঙের গণমাধ্যমগুলিকে এর সঙ্গে মার্কিন এএইচ-৬৪ অ্যাপাচে এবং রুশ এমআই-২৮ হ্যাভকের মতো দুনিয়ার সেরা সামরিক আক্রমণাত্মক কপ্টারগুলির সঙ্গে তুলনা টানতে দেখা গিয়েছে। যদিও তা মানতে নারাজ অধিকাংশ প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক।
পাক বিমানবাহিনীতে সদ্য যুক্ত হওয়া ‘জে-১০এমই’ কপ্টারগুলিতে রয়েছে দু’টি অত্যাধুনিক ‘ডব্লিউজ়েড-৯জি’ টার্বোশ্যাফ্ট ইঞ্জিন। এর প্রতিটি প্রায় ১,৫০০ অশ্বশক্তি ক্ষমতাসম্পন্ন। উঁচু পাহাড়ি এলাকা থেকে শুরু করে উষ্ণ মরুভূমি বা ধুলোবালি যুক্ত এলাকায় হামলা চালাতে সংশ্লিষ্ট উড়ুক্কু যানটি সিদ্ধহস্ত বলে জানা গিয়েছে। মূলত খাইবার-পাখতুনখোয়া এবং বালোচিস্তানের বিদ্রোহ দমন করতে বেজিঙের তৈরি কপ্টারগুলি ইসলামবাদের ফৌজ ব্যবহার করবে বলে ইঙ্গিত মিলেছে।
রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তাদের হাতে থাকা ‘এএইচ-১এফ কোবরা’ সামরিক কপ্টারগুলি বেশি উচ্চতায় উড়তে অক্ষম। সেখানে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ছ’হাজারের বেশি উচ্চতায় উঠে নিখুঁত নিশানায় অনায়াসেই হামলা করতে পারে চিনের তৈরি ‘জে-১০এমই’। এতে রয়েছে মিলিমিটার ওয়েভ রেডার, ইলেক্ট্রো-অপটিক্যাল টার্গেটিং সিস্টেম এবং পাইলটদের জন্য হেলমেট-মাউন্টেড ডিসপ্লে। ড্রাগনের তৈরি কপ্টারটি একসঙ্গে একাধিক যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে শত্রুর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে বলে জানা গিয়েছে।
চিনা প্রতিরক্ষা সংস্থা ‘চাংহে এয়ারক্রাফ্ট ইন্ডাস্ট্রিজ় কর্পোরেশন’ সংশ্লিষ্ট কপ্টারটিকে সাজিয়েছে একেডি-১০ ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র, সিএম-৫০২এজি আকাশ থেকে ভূমিতে হামলাকারী ক্ষেপণাস্ত্র, টিওয়াই-৯০ আকাশ থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র এবং প্রিসিশন গাইডেড রকেটে। এতে রয়েছে মোট ছ’টি লঞ্চার। অর্থাৎ, একসঙ্গে ছ’টি লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারে বেজিঙের তৈরি ‘জে-১০এমই’ সামরিক কপ্টার।
১৯৮০-র দশকে আমেরিকার থেকে ‘এএইচ-১এফ’ কোবরা সামরিক কপ্টারগুলি পেয়েছিল পাকিস্তান। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলি বুড়ো হয়ে যাওয়ায় তুরস্কের থেকে ‘টি-১২৯ এটিএকে’ কপ্টার আমদানির চেষ্টা করে ইসলামাবাদ। এর ‘সিটিএস-৮০০’ ইঞ্জিনটি আবার আমেরিকার সরবরাহ করার কথা ছিল, যা দিতে অস্বীকার করে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে বাধ্য হয়ে আঙ্কারার সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেন রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলরা।
এর পরেই কপ্টারের সমস্যা মেটাতে বেজিঙের দ্বারস্থ হয় ইসলামাবাদ। বর্তমানে দ্রুত ‘চিন-পকিস্তান অর্থনৈতিক বারান্দা’ বা সিপিইসি-র (চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর) কাজ শেষ করতে চাইছে ড্রাগন। এই বাণিজ্যিক রাস্তাটি দক্ষিণ-পশ্চিম পাকিস্তানের বালোচিস্তান প্রদেশের গ্বদর বন্দরে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট বন্দরটিও তৈরি করেছে চিনা সরকার, যা নিয়ে ওই এলাকায় জ্বলে উঠেছে বিদ্রোহের আগুন।
গত কয়েক মাসে একাধিক বার বেজিঙের ইঞ্জিনিয়ার এবং কর্মীদের নিশানা করেছে বালোচিস্তানের সশস্ত্র বিদ্রোহীরা। এর জেরে পাক সরকার এবং সেনার উপর ক্ষোভ উগরে দেয় চিন। মাসখানেক আগে বেজিং সফরে যান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। সূত্রের খবর, সেখানেও এই নিয়ে বহু প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় তাঁকে। ফলে রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলরা সদ্য বাহিনীতে শামিল হওয়া কপ্টারগুলি দক্ষিণ-পশ্চিম প্রদেশটিতে মোতায়েন করবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
চিনের থেকে পাক বায়ুসেনা মোট কতগুলি ‘জে-১০এমই’ কপ্টার হাতে পাচ্ছে, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। ‘দ্য ইউরেশিয়ান টাইমস’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, মোট চার থেকে আটটি ইউনিট তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে ইসলামাবাদের বিমানবাহিনীর। সে ক্ষেত্রে ৫০ থেকে ৬০টি কপ্টার রাওয়ালপিন্ডিকে সরবরাহ করবে বেজিং। সংশ্লিষ্ট প্রতিরক্ষা চুক্তিতে কত টাকার লেনদেন হয়েছে, তা-ও সরকারি ভাবে জানায়নি শাহবাজ় শরিফ প্রশাসন।
চিন ও পাকিস্তানের মোকাবিলায় একাধিক কপ্টার ব্যবহার করে থাকে ভারতীয় বায়ুসেনা। সেই তালিকায় রয়েছে আমেরিকার তৈরি এএইচ-৬৪ই অ্যাপাচে এবং সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি লাইট কমব্যাট হেলিকপ্টার ‘প্রচণ্ড’। এর মধ্যে প্রথমটি ওজনে ভারী এবং একাধিক যুদ্ধাস্ত্রে আক্রমণ শানাতে সক্ষম। ‘প্রচণ্ড’ আবার আকারে কিছুটা ছোট এবং হালকা। মূলত, লাদাখ এবং জম্মু-কাশ্মীরের পাহাড়ি এলাকায় আকাশ-যুদ্ধের কথা মাথায় রেখে একে তৈরি করেছে ‘হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড’ বা হ্যাল।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, ভারতীয় বায়ুসেনার কাছে মার্কিন অ্যাপাচে থাকায় চিন থেকে তড়িঘ়ড়ি ‘জে-১০এমই’ কপ্টারটি আমদানি করেছে পাকিস্তান। ‘অপারেশন সিঁদুর’কে কেন্দ্র করে চলা চার দিনের ‘যুদ্ধে’ ইসলামাবাদের বিমানবাহিনীর ২০ শতাংশ পরিকাঠামো ধ্বংস করে দেয় নয়াদিল্লি। ফলে রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলদের ভারতের পরাক্রম নিয়ে আতঙ্কও রয়েছে।
দেশভাগের পর পাক ফৌজের হাতিয়ারের বড় অংশই আসত আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দেশগুলি থেকে। কিন্তু, ২১ শতকের গোড়ার দিকে সেই নীতিতে আসে বড় বদল। বর্তমানে ইসলামাবাদের তিন বাহিনীকে ৮০ শতাংশ হাতিয়ার সরবরাহ করছে বেজিং। এর মধ্যে রয়েছে যুদ্ধবিমান, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও রণতরী। এ বার সেই তালিকায় যুক্ত হল সামরিক কপ্টারও।
গত জানুয়ারিতে দ্বিতীয় বারের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেওয়ার পর প্রথমে চিনের বিরুদ্ধে শুল্কযুদ্ধ শুরু করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এতে আর্থিক ভাবে বড়সড় ধাক্কার মুখে পড়ে বেজিং। ওই সময় থেকেই ভারতকে নিয়ে সুর নরম করতে থাকে ড্রাগন। শুধু তা-ই নয়, আমেরিকার বিরুদ্ধে এককাট্টা হতে ওই সময়ে খোলাখুলি ভাবে নয়াদিল্লিকে আহ্বানও জানান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। একটি বিবৃতিতে তাঁর বিদেশ মন্ত্রক বলে, ‘‘ড্রাগন ও হাতির একসঙ্গে নৃত্য করার সময় এসেছে।’’ কিন্তু, তার পরেও চালবাজ চিনকে বিশ্বাস করে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়নি কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার।
কিন্তু, অগস্টে ভারতীয় পণ্যে অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দেন ট্রাম্প। ফলে রফতানি বাণিজ্যে লোকসান আটকাতে রাশিয়া এবং ব্রাজ়িলের পাশাপাশি ‘ব্রিকস’-ভুক্ত চিনের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে নয়াদিল্লি। বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে তাতে বেজিঙের পক্ষে ইসলামাবাদকে অন্ধ ভাবে সমর্থন করা বেশ কঠিন। এর নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ।
এ বছরের অগস্টের শেষে অবসরগ্রহণ করছেন মার্কিন সেনাবাহিনীর সেন্ট্রাল কমান্ডের শীর্ষ ফৌজি আধিকারিক জেনারেল মাইকেল কুরিল্লা। তাঁর বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেয়ে আমেরিকা যাচ্ছেন পাক সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল মুনির। এ বছরে এই নিয়ে দ্বিতীয় বার যুক্তরাষ্ট্র সফর করবেন তিনি। বিশ্লেষকদের দাবি, ইসলামাবাদ যে ভাবে আমেরিকার দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে, তাতে আগামী দিনে বেজিঙের পক্ষে তাদের বিশ্বাস করা বেশ কঠিন হবে। আর সেই সুযোগ কাজে লাগাতে তৎপর হয়েছে ভারত।
অন্য দিকে, এ বছরের অগস্টেই নয়াদিল্লি আসার কথা রয়েছে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের। এ বছরের জুলাইয়ে ব্রাজ়িলে ‘ব্রিকস’ সম্মেলন চলাকালীন তাঁর উদ্যোগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠক করেন চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। সেখানে দু’দেশের সীমান্ত সমস্যা মেটাতে কিছুটা মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিতে চেয়েছিল মস্কো। এই পরিস্থিতিতে ড্রাগনের পক্ষে ভারতকে চটিয়ে পাকিস্তানের হাত ধরা কঠিন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
অগস্টের শেষে চিনের তিয়ানজিন শহরে বসবে ‘সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা’ বা এসসিও-র (সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজ়েশন) রাষ্ট্রনেতাদের বৈঠক। সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ড্রাগনভূমিতে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ২০২০ সালে লাদাখে দু’দেশের সেনাবাহিনীর সংঘর্ষের পর এটাই তার প্রথম চিন সফর। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এসসিও-র সদস্যপদ রয়েছে ইসলামাবাদেরও। তবে ওই অনুষ্ঠানে পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ যাবেন কি না, তা স্পষ্ট নয়।
তবে তার পরেও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে শুল্কযুদ্ধে চিনের হাত ধরার ব্যাপারে বাড়তি সতর্ক থাকতে হবে নয়াদিল্লিকে। কারণ, পাক মদতপুষ্ট সীমান্তপার সন্ত্রাস থেকে শুরু করে ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা’ বা এলএসি-তে (লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল) বেজিঙের সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে ভারত। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে দখল করা ‘আকসাই চিন’ও ফিরিয়ে দিতে নারাজ ড্রাগন। আর তাই মেপে পা ফেলতে হবে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে, বলছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা।