ভারত পাকিস্তানের সংঘাতের আঁচে উত্তপ্ত দুই দেশ। গত ২২ এপ্রিল পহেলগাঁওয়ে পর্যটকদের উপর জঙ্গি হামলার ঘটনায় ২৬ জনের মৃত্যু হয়। সেই হামলার জবাবে পাকিস্তানে জঙ্গিঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিয়ে প্রত্যাঘাত হেনেছে ভারত। ভারতীয় সেনার সামরিক অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন সিঁদুর’।
মঙ্গলবার মধ্যরাতে পাকিস্তান এবং পাক অধিকৃত কাশ্মীরে জঙ্গিঘাঁটিগুলিকে নিশানা করে সেগুলি গুঁড়িয়ে দিয়েছে ভারতীয় সেনা। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ বেসামাল ইসলামাবাদ। হামলার জবাবে জম্মু ও কাশ্মীরে নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর গোলাবর্ষণ শুরু করছে পাক সেনা। পাকিস্তানের গোলাগুলির পাল্টা জবাব দিচ্ছে ভারতও। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে বহু বার সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করে পাকিস্তানি ড্রোন।
সেনা সূত্রে খবর, ভারতের ৩৬ জায়গায় হামলার চেষ্টা করেছিল পাকিস্তান। প্রতি বারই পাকিস্তানের সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ করেছে ভারতীয় বাহিনী। ৩০০ থেকে ৪০০ বার ড্রোন হামলার চেষ্টা করেছে পাকিস্তান। আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে সেই হামলা প্রতিহত করেছে ভারতীয় সেনা। বেশ কয়েকটি পাক ড্রোন ধ্বংস করা হয়েছে।
পাকিস্তানের আক্রমণ প্রতিহত করার পাশাপাশি কৌশলগত লড়াইয়ের সমস্ত প্রস্তুতি সেরে রাখতে চায় ভারত। ভারত-পাক টানাপড়েনের আবহে কী কী করণীয় তার আগাম পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলতে চায় ভারত। সৈন্যশক্তির নিরিখে হোক বা ক্ষেপণাস্ত্রের ভান্ডার, এমনিতেই ইসলামাবাদের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে নয়াদিল্লি।
ভারতের ক্ষেপণাস্ত্রের ভান্ডার পড়শি দেশের বুক কাঁপিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের অধিকারী দেশ হিসাবে ভারত বিশ্বের সাতটি দেশের মধ্যে নিজের নাম তুলেছে। ভারতের হাতে যে সমস্ত ক্ষেপণাস্ত্রগুলি আছে তা কয়েক মিনিটেই শত্রুঘাঁটি নিকেশ করার জন্য যথেষ্ট। ব্রহ্মোস, অগ্নি এবং প্রলয়ের মতো ক্ষেপণাস্ত্রগুলি শত্রুপক্ষকে ধরাশায়ী করার জন্য একাই একশো।
ভারত ও পাকিস্তান সম্মুখসমরে উপস্থিত হলে যে পাঁচটি ক্ষেপণাস্ত্র সবচেয়ে বেশি ব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে সেগুলি হল ব্রহ্মোস, অগ্নি, প্রলয়, নির্ভয় ও শৌর্য। শত্রুপক্ষকে রুখে দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের হাতে থাকা এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ভারতের প্রতিরক্ষা ও সেনা অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে সক্ষম বলে মনে করেন যুদ্ধবিশেষজ্ঞেরা।
স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত ক্ষেপণাস্ত্রের ভান্ডার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করেছে। ক্ষেপণাস্ত্রের দিক থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। পাল্লার দিক থেকে ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্রগুলির তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে ইসলামাবাদের দূরপাল্লার অস্ত্র। বর্তমানে হাইপারসনিক (শব্দের পাঁচ গুণ বেশি জোরে ছুটতে পারে) ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির দিকে নজর দিয়েছে ডিআরডিও। এতে প্রাথমিক সাফল্যও পেয়েছে ভারত।
ভারত ও রাশিয়ার যৌথ উদ্যোগে তৈরি ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র ‘ব্রহ্মোস’। সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্রটিকে যুদ্ধজাহাজ, যুদ্ধবিমান এবং মাটিতে থাকা লঞ্চার থেকে শত্রুঘাঁটির উপর নিক্ষেপ করা সম্ভব। শব্দের প্রায় তিন গুণ বেশি গতিতে ছুটে গিয়ে নিখুঁত নিশানায় হামলা করতে পারে এই ক্ষেপণাস্ত্র। ২০০৫ সালের নভেম্বর থেকে এই ব্রহ্মাস্ত্র ব্যবহার করা শুরু করে ভারতীয় সেনার তিন বাহিনী।
অস্ত্রের বাজারে বাড়ছে ভারতের এই সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্রের চাহিদা। ৪০০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত যে কোনও লক্ষ্যবস্তুতে সফল ভাবে আঘাত করতে সক্ষম এই ক্ষেপণাস্ত্র। শত্রু দেশের রেডারেও এই অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্রের ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম। স্থলে কিংবা জলে, যে কোনও লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করতে সক্ষম এই ক্ষেপণাস্ত্র।
ভারতের হাতে তিন ধরনের ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। এই তালিকায় ব্রহ্মোস সুপারসনিক, ব্রহ্মোস-২ ছাড়াও রয়েছে নির্ভয়। নির্ভয় ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্রটি এক হাজার থেকে দেড় হাজার কিলোমিটার দূরত্বে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। এটি পারমাণবিক ওয়ারহেড বহনেও সক্ষম।
লক্ষ্যে আঘাত হেনে শত্রু নিকেশের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র নির্ভয়ের সাফল্যের হার ৯০ শতাংশ। এমনটাই দাবি প্রস্তুতকারক সংস্থা ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজ়েশনের (ডিআরডিও)। ৬ মিটার দৈর্ঘ্যের ১ হাজার কিলোমিটার পাল্লার এই ক্ষেপণাস্ত্র ভূমি থেকে ভূমি ‘সাবসনিক’ (শব্দের চেয়ে কম গতিবেগ) গোত্রের।
২০১৩-র ১২ মার্চ নির্ভয়ের উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। কিন্তু প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে উৎক্ষেপণের পরই বিগড়ে যায় সেটি। এর পর ২০১৪-য় উৎক্ষেপণ হয় এই ক্ষেপণাস্ত্রের। ২০১৫ এবং ’১৬-তে আরও দু’বার উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল এই ক্ষেপণাস্ত্র। কিন্তু তখন নিখুঁত লক্ষ্যভেদ করতে সমর্থ হয়নি নির্ভয়। ২০১৭-য় নির্ভয়ের পরীক্ষামূলক সফল উৎক্ষেপণ করা হয়।
শত্রুপক্ষের যুদ্ধজাহাজ এবং ট্যাঙ্ক ধ্বংস করার জন্য ভারতের হাতে রয়েছে অগ্নি-১ থেকে অগ্নি-৫ পর্যন্ত ক্ষেপণাস্ত্র। এগুলির প্রত্যেকটি একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব এবং গতিতে গিয়ে লক্ষ্য ধ্বংস করতে পারে। কার্গিল যুদ্ধের পরবর্তী কালে অগ্নি ১ তৈরি করে ডিআরডিও। ৭.৬ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড গতিবেগে ৭০০ থেকে ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরত্বে গিয়ে আঘাত হানতে পারে অগ্নি ১।
পাঁচ থেকে ছ’কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড গতিতে তিন হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিতে পারে অগ্নি ৩। ২০১১ সালে একে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অস্ত্রভান্ডারের তালিকাভুক্ত করা হয়।
২০২২ সাল থেকে ভারতীয় সেনার হাতে থাকা অস্ত্রের তালিকায় রয়েছে প্রলয়। ১৫০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার পাল্লার এই ক্ষেপণাস্ত্র নিখুঁত নিশানায় আঘাত হানতে সক্ষম। যুদ্ধের সময়ে এর ‘গেম চেঞ্জার’ হয়ে ওঠার ক্ষমতা রয়েছে, বলছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
৩৫০ থেকে ৭০০ এবং ৫০০ থেকে হাজার কেজির উচ্চ শক্তির বিস্ফোরক ব্যবহার করে প্রলয়। স্থলসেনার পাশাপাশি বায়ুসেনাও এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে থাকে। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি প্রলয় ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণে হাত রয়েছে প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিওর। ডিআরডিওর তৈরি ভূমি থেকে ভূমি ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র পৃথ্বীর আদলে তৈরি প্রলয় তুলনায় হালকা।
এই ক্ষেপণাস্ত্রটি পার্বত্য এলাকায় ব্যবহার করা সহজ। তা ছাড়া পরমাণু অস্ত্র বহনের উপযোগী উন্নত প্রযুক্তির এই ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র মাঝ-আকাশে গতিপথ বদলাতেও সক্ষম। ফলে শত্রুপক্ষের ইন্টারসেপ্টর ক্ষেপণাস্ত্রকে এড়িয়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারে প্রলয়। ২০২০ সালে পূর্ব লাদাখে চিনা ফৌজের আগ্রাসন এবং গালওয়ান উপত্যকায় রক্তাক্ত সংঘর্ষের পরে এলএসিতে প্রলয় মোতায়েন করে ভারতীয় সেনা।
ভারতের অস্ত্রভান্ডারে রয়েছে শৌর্য। এটি একটি হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। আধুনিক এই যুদ্ধাস্ত্রটিও পারমাণবিক অস্ত্র বহন করতে সক্ষম। শৌর্য ভূমি থেকে ভূমিতে আঘাত হানতে সক্ষম। এটি শত্রুর রেডারকে ফাঁকি দিতে পারদর্শী। এর পাল্লা ৭০০ থেকে ৮০০ কিলোমিটার এবং এটি ভারতের সবচেয়ে উন্নত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলির মধ্যে অন্যতম। যুদ্ধের পরিস্থিতিতে এটি শত্রুর জন্য ধ্বংসের বার্তা বয়ে আনতে পারে।