খালিস্তান ইস্যুতে যাবতীয় তিক্ততা এখন শুধুই ইতিহাস। পরমাণু শক্তিকে সামনে রেখে ফের কাছাকাছি ভারত ও কানাডা। ফলে দু’বছরের কূটনৈতিক টানাপড়েন সরিয়ে রেখে নয়াদিল্লিকে ইউরেনিয়াম সরবরাহ করতে রাজি হয়েছে অটোয়া। শুধু তা-ই নয়, এ ব্যাপারে একটি চুক্তি চূড়ান্ত করে ফেলেছে দুই দেশ, যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
ভারত-কানাডা সম্ভাব্য ইউরেনিয়াম চুক্তির খবর প্রথম বার প্রকাশ্যে আনে ‘দ্য গ্লোব অ্যান্ড মেল’ নামের অটোয়ার গণমাধ্যম। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ ব্যাপারে ১০ বছরের সমঝোতা করবে দুই দেশ। চুক্তিটির অনুমানিক মূল্য দাঁড়াতে পারে ২৮০ কোটি ডলার। তবে সমঝোতাপত্রে সই হওয়ার আগে এর শর্তাবলিতে কিছু অদলবদল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সূত্রের খবর, সংশ্লিষ্ট চুক্তিটি চূড়ান্ত রূপ পেলে ভারতে ইউরেনিয়াম সরবরাহ করবে কানাডার ক্যামেকো কর্পোরেশন নামের সংস্থা। এই সমঝোতা নয়াদিল্লি ও অটোয়ার মধ্যে বৃহত্তর পারমাণবিক সহযোগিতার অংশ হতে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে। পাশাপাশি, মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি বা ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্টের (এফটিএ) ব্যাপারেও সম্মত হতে পারে দুই দেশ, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
চলতি বছরের ২২-২৩ নভেম্বর জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে সাউথ আফ্রিকার (দক্ষিণ আফ্রিকা) জোহানেসবার্গ সফর করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেখানে কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয় তাঁর। সূত্রের খবর, সেখানেই ইউরেনিয়াম সরবরাহ সংক্রান্ত চুক্তি প্রায় চূড়ান্ত করেন দুই রাষ্ট্রনেতা। পাশাপাশি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়েও কথা হয় তাঁদের। যদিও এ ব্যাপারে সরকারি ভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া দেয়নি নয়াদিল্লি ও অটোয়া।
২০১৫ সালে ইউরেনিয়াম আমদানির জন্য কানাডিয়ান সংস্থা ক্যামেকোর সঙ্গে পাঁচ বছরের চুক্তি করেছিল ভারত। ওই সমঝোতার বাজারমূল্য ধার্য হয় ৩৫ কোটি ডলার। তেজস্ক্রিয় পদার্থটির দাম তৎকালীন পরিস্থিতির উপর বিচার-বিবেচনা করে ঠিক করা হয়েছিল। ২০২০ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে তা আর পুনর্নবীকরণ করেনি নয়াদিল্লি।
‘দ্য গ্লোব অ্যান্ড মেল’ জানিয়েছে, ২০২৫ সালে পৌঁছে পুরনো চুক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করার কোনও চেষ্টাই করছে না দু’পক্ষ। উল্টে নতুন করে সমঝোতায় আগ্রহ রয়েছে নয়াদিল্লি ও অটোয়ার। ফলে এর শর্তাবলি অনেক বেশি কঠিন এবং জটিল হতে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে। কানাডার সরবরাহ করা ইউরেনিয়ামকে কাজে লাগিয়ে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধির পরিকল্পনা করছে মোদী সরকার, খবর সূত্রের।
ভারতের সঙ্গে সম্ভাব্য চুক্তি নিয়ে গণমাধ্যমের কাছে মুখ খুলতে চায়নি ক্যামেকো কর্তৃপক্ষ। সংস্থার ডিরেক্টর অফ কমিউনিকেশনস পদে থাকা ভেরোনিকা বেকার বলেছেন, ‘‘ইউরেনিয়াম তেজ়স্ক্রিয় পদার্থ হওয়ায় আমাদের সমস্ত সমঝোতাই গোপনীয়। গোটা বিষয়টি চূড়ান্ত রূপ পাওয়ার আগে কোনও তথ্যই প্রকাশ করা সম্ভব নয়।’’ এ দেশের কোথায় কী ভাবে তারা ইউরেনিয়াম সরবরাহ করবে, তা-ও জানা যায়নি।
বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, ইউরেনিয়াম সরবরাহের পাশাপাশি ভারতের পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে পড়ার ইচ্ছা রয়েছে কানাডার। এর জন্য আগামী দিনে ছোট মডুলার আণবিক চুল্লি তৈরি করবে ভারত। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার শর্ত রাখতে পারে অটোয়া। তবে এ ব্যাপারে বিকল্প হিসাবে মোদী সরকারের হাতে রয়েছে রাশিয়া। ইতিমধ্যেই ওই ধরনের মডুলার চুল্লি সরবরাহের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে মস্কো।
জোহানেসবার্গে মোদী-কার্নি বৈঠকের পর বিবৃতি দেয় বিদেশ মন্ত্রক। সেখানে বলা হয়েছে, ‘‘ভারত, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং অংশীদারি নিয়ে দুই রাষ্ট্রনেতার ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। এটা গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি, পারমাণবিক শক্তি, কাঁচমাল ও পণ্য সরবরাহ শৃঙ্খলের বৈচিত্র তৈরি করা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ক্ষেত্রে ত্রিপাক্ষিক সহযোগিতা বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করবে।’’
পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশ্বের উন্নত দেশগুলির তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে ভারত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চিন, জাপান তো বটেই, নয়াদিল্লির থেকে এ ব্যাপারে কয়েক যোজন এগিয়ে আছে সুইডেন ও ইউক্রেনের মতো ছোট ইউরোপীয় রাষ্ট্রও। এই ছবি বদলাতে চলতি আর্থিক বছরের (পড়ুন ২০২৫-’২৬) কেন্দ্রীয় বাজেটে বড় ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ।
বর্তমানে আণবিক শক্তির সাহায্যে মাত্র ৬,৭৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকে ভারত। ২০৪৭ সালের মধ্যে সেটাই বাড়িয়ে ১০০ গিগাওয়াটে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে মোদী সরকারের। এ বছরের বাজেটে সে কথা ঘোষণা করেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। এর পরই ইউরেনিয়াম সরবরাহ নিশ্চিত করতে কানাডার সঙ্গে যোগাযোগ করে নয়াদিল্লি। দু’তরফে চুক্তির জন্য শুরু হয় আলোচনা।
পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল কাঁচামাল হল ইউরেনিয়াম। তেজস্ক্রিয় পদার্থটি গণবিধ্বংসী আণবিক বোমা তৈরিতেও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ফলে কানাডার সংস্থা এর সরবরাহ শুরু করলে পরমাণু হাতিয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধির চেষ্টা নয়াদিল্লি করবে কি না, তা বোঝা দুষ্কর। তবে সম্ভাব্য চুক্তিটি নিয়ে ভারতকে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়তে হবে বলে মনে করছেন না কেউই।
বর্তমানে ভারতের ২২টি রাজ্যে মোট সাতটি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো মহারাষ্ট্রের তারাপুর সংস্থাটি। ১৯৬৯ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয় সেখানে। এ ছাড়া গুজরাতের কাকরাপার, তামিলনাড়ুর কলপক্কম ও কুন্দনকুলম, উত্তরপ্রদেশের নারোরা, কর্নাটকের কাইগা এবং রাজস্থানের রাওয়াতভাটা আণবিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে সরকার।
২০৪৭ সালের মধ্যে ১০০ গিগাওয়েটের পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য একাধিক মডুলার চুল্লির প্রয়োজন হবে ভারতের। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলিতে রাশিয়া ছাড়াও আমেরিকা এবং ফ্রান্সকে লগ্নি করতে দেখা যেতে পারে। এ ব্যাপারে প্রযুক্তিগত লেনদেনের সম্ভাবনাও রয়েছে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে, কানাডার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যকে ২০৩০ সালের মধ্যে দ্বিগুণ করে ৫০ হাজার কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে নয়াদিল্লির। সেই কারণেই উচ্চকাঙ্ক্ষী আর্থিক অংশীদারি চুক্তি করার ব্যাপারে আগ্রহ রয়েছে অটোয়ার। এতে বেসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতা বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। আর তাই ইউরেনিয়াম সরবরাহের জন্য দীর্ঘস্থায়ী চুক্তি করতে চাইছে মোদী সরকার।
দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে অসামরিক পরমাণু বিষয় ছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রে লগ্নি এবং প্রতিরক্ষা, শিক্ষা, মহাকাশ গবেষণা, প্রযুক্তি ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা করেছেন মার্ক কার্নি। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে কৃত্রিম মেধার শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করবে নয়াদিল্লি। কেন্দ্রের এই উদ্যোগের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন তিনি।