ঋণ সংক্রান্ত অবৈধ অ্যাপের রমরমা বাড়ছে ভারত জুড়ে। গত কয়েক বছরে দ্রুত গতিতে বেড়েছে ডিজিটাল ঋণ নেওয়ার প্রবণতা। ভুয়ো অ্যাপের মাধ্যমে ঋণ দেওয়ার নাম করে সর্বস্বান্ত করে দেওয়ার চক্রান্ত করছে অসাধু ঋণদাতা সংস্থাগুলি।
সাম্প্রতিক সময়ে ডিজিটাল ঋণের নামে ভূরি ভূরি সাইবার অপরাধের ঘটনার অভিযোগ জমা পড়েছে কেন্দ্রের কাছে। চটজলদি ঋণ দেওয়ার নামে গ্রাহকদের জালিয়াতি, হয়রানি, এমনকি ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার মতো অভিযোগের কিনারা করতে গিয়ে কড়া পদক্ষেপ করল কেন্দ্র।
অ্যাপের মাধ্যমে ঋণ দেওয়ার নাম করে সাধারণ মানুষকে প্রতারণা করার পথ বন্ধ করতে একগুচ্ছ অবৈধ সংস্থার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করল কেন্দ্রীয় সংস্থা। সম্প্রতি সরকার সংসদে জানিয়েছে, ইলেক্ট্রনিক্স এবং তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রক তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ধারা প্রয়োগ করে ৮৭টি ঋণ সংস্থাকে অবৈধ বলে ঘোষণা করেছে। এ দেশে সেই সব সংস্থার কাজকর্মের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে মন্ত্রক।
সরকারি মান্যতাপ্রাপ্ত বা সরকারের তালিকায় নাম থাকা ডিজিটাল অ্যাপগুলি থেকেই শুধুমাত্র ঋণ নেওয়া যাবে। ১ ডিসেম্বর লোকসভায় কর্পোরেট মন্ত্রকের কাছে পাঠানো একটি প্রশ্নের উত্তরের পরিপ্রেক্ষিতে লিখিত আকারে তথ্যটি প্রকাশ করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী হর্ষ মলহোত্র এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন লোকসভার অন্দরে।
লোকসভায় যে প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়েছিল তাতে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, সরকার ২০১৩ সালের সংস্থা আইনের অধীনে শেল কোম্পানি বা ভুয়ো সংস্থাগুলিকে চিহ্নিত করার জন্য কী পরিকল্পনা করেছে? এই ধরনের ধূসর সংস্থাগুলির উপর নজরদারি এবং অবৈধ কার্যকলাপ প্রতিরোধে কী পদক্ষেপ করছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রক, জানতে চাওয়া হয় সংসদে।
ভুয়ো অ্যাপের মাধ্যমে ঋণ দেওয়ার নাম করে প্রতারণা নিয়ে বহু দিন ধরেই সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞেরা। এর ফাঁদে পা দিয়ে আত্মহত্যার অভিযোগও উঠেছে, যা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক এবং কর্তৃপক্ষগুলির সঙ্গে আলোচনা করেছিল সরকার। সেই সময়েই একাধিক বার এই ধরনের অ্যাপগুলিকে কড়া হাতে নিয়ন্ত্রণের বার্তা দিয়েছিল কেন্দ্র।
কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রক জানিয়েছে যে, ঋণ অ্যাপের মাধ্যমে অনলাইন ঋণ প্রদানে জড়িত সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়লেই যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। একই সঙ্গে মন্ত্রক আরও স্পষ্ট করে জানিয়েছে যে, অবৈধ সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও, ২০১৩ সালের কোম্পানি আইনে ‘শেল কোম্পানি’ শব্দবন্ধটি যথাযথ সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। এই জাতীয় সংজ্ঞা আইনে যোগ করার কোনও প্রস্তাব নেওয়া হয়নি।
মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী হর্ষ জানিয়েছেন, ২০০০ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের আওতায়, ইলেক্ট্রনিক্স এবং তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রক ক্ষতিকারক ডিজিটাল বিষয়বস্তুতে সাধারণ মানুষের প্রবেশের অধিকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। প্রয়োজনীয় আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর ৮৭টি অবৈধ ঋণ প্রদানকারী অ্যাপকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে সরকার।
লাগামহীন ভাবে তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি, তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষায় শিথিলতা, বকেয়া আদায়ে অনৈতিক পদক্ষেপ, চড়া সুদ, গ্রাহকের ক্ষমতা যাচাই না করে ঋণ দেওয়ার মতো ঝুঁকি রয়েছে ডিজিটাল ঋণের ক্ষেত্রে। গ্রাহক তথ্যের নিরাপত্তা, ঋণ মঞ্জুরের প্রক্রিয়া, বকেয়া উদ্ধারে অনৈতিক প্রক্রিয়া, মাত্রাতিরিক্ত সুদ ঠেকাতে এই পদক্ষেপ করেছে কেন্দ্র।
সাত থেকে ১৫ দিনের জন্য ঋণ দেওয়া হয় অ্যাপগুলির মাধ্যমে। তার জন্য ‘প্ল্যাটফর্ম ফি’ (ওই অনলাইন অ্যাপ ব্যবহার করে ঋণ নেওয়ার জন্য মূল্য) বাবদ মোট ঋণের ৩০-৪০ শতাংশ কেটে নেওয়া হয়। যাঁরা সেই টাকা দিতে পারেন না, তাঁদের বিভিন্ন ভাবে চাপ দেওয়া হয়। এমনকি তাঁদের ব্যক্তিগত তথ্যও হাতিয়ে নিয়ে হুমকি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ।
অনলাইনে ঋণের নামে ২০টিরও বেশি রাজ্যে কয়েক হাজার মানুষকে ভুল বুঝিয়ে ফাঁদে ফেলা হয়েছে। এই ঋণ শোধ করার জন্য ‘কড়া নিয়ম’ রয়েছে অ্যাপগুলির। অনেক সময় না বুঝেই ফাঁদে পা দেন সাধারণ মানুষ। ফলে ঋণ শোধ করতে না পেরে অনেকে আত্মহত্যার পথও বেছে নিয়েছেন অতীতে।
ভুয়ো অ্যাপের মাধ্যমে ঋণ দেওয়ার নাম করে প্রতারণা নিয়ে বহু দিন ধরেই নজরদারি চালাচ্ছে কেন্দ্র। সময় বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং সচেতনতাই এই ফাঁদ থেকে সতর্ক থাকার উপায় বলে পরামর্শ দিয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রক। ডিজিটাল ব্যবস্থায় ঋণ পরিষেবা নিয়ে বহু দিন ধরেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কও।
রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের নজরদারিতে ধরা পড়েছে ব্যাঙ্ক, এনবিএফসি কিংবা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অধীনে থাকা সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে বা নিজেরাই ইন্টারনেট এবং অ্যাপের মাধ্যমে ঋণের ব্যবসায় পা রাখছে বিভিন্ন প্রযুক্তি সংস্থা। এতে গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা বিঘ্নিত হচ্ছে কি না, মাত্রাতিরিক্ত হারে সুদ নেওয়া হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখার জন্য একটি কমিটিও রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের।
এই ধরনের অ্যাপগুলির মাধ্যমে প্রায় ২৮,০০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে ইডির তদন্তে উঠে এসেছে। এর মধ্যে অনেক অ্যাপেই চিনা প্রতারকদের যোগ রয়েছে বলে সন্দেহ করছেন তদন্তকারীরা। ইডির রিপোর্টের ভিত্তিতে ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, তাৎক্ষণিক ঋণ দেওয়ার এই অ্যাপগুলি বেশির ভাগই বেআইনি।